মত-মতান্তর

১৫ দিনের দুর্যোগকালীন ছুটি জরুরি

মো. কামাল হোসেন চৌধুরী

১৬ মে ২০২০, শনিবার, ৭:৪১ পূর্বাহ্ন

দিন দিন বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। দেশ এক অজানা গন্তব্যে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে পারছেন না, কবে শেষ হবে করোনার প্রকোপ। জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে আমরা এখন দ্বিধা-বিভক্ত। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস, দোকানপাট বিভিন্ন কারণে খুলে দিতে বাধ্য হয়েছি। এতে সংক্রমণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দীর্ঘ দেড় মাসের সাধারণ ছুটিও রক্ষা করতে পারছে না। সবাই এখন ঘরবন্দী থাকলেও মানুষ তার নিত্যপ্রয়োজনে বিশেষ করে কাঁচাবাজারের কারণে হলেও ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছে।

একে একে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা আজ করোনায় আক্রান্ত। অনেক উন্নত দেশ লকডাউন চালিয়ে যেতে সামর্থ্ হলেও আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশ বেশিদিন সাধারণ ছুটি চালিয়ে যেতে পারবে না। অবশ্যই সাধারণ ছুটি শেষ করতে হবে। জীবন-জীবিকাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সকলের সমন্বিত উদ্যোগ। আমরা যদি করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সামর্থ না হই, তাহলে সামনে বিশাল অন্ধকার। অর্থনীতি, শিক্ষা ও চিকিৎসা মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং আগামীতে হবে। এর ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হবে। বিপুল পরিমাণ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ আমাদের সকলের। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রিয় দেশকে করোনা থাবা থেকে রক্ষা করতে পারি। আমরা যদি নিউজিল্যান্ড এর মত ১৫দিন কঠোরভাবে গৃহবন্দী থাকতে পারি, তাহলেই করোনার প্রকোপ থেকে মুক্ত হতে পারবো। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো। এখন কথা আসতে পারে, দেড় মাসে যেটা পারলাম না, সেটা কিভাবে ১৫ দিনে অর্জন করতে পারবো? মনে রাখতে হবে, দেড় মাসের লকডাউন আমরা মেনে চলি নাই। কিভাবে লকডাউন কার্যকর হবে, সেটা বুঝতেই সময় নিয়ে নিয়েছি বেশি। সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়িয়েছি বিভিন্ন মেয়াদে। সাধারণ ছুটির মধ্যে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গমন করেছি। যেমন অনেকে বিভিন্ন শহর (যেমন ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম) থেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছে। গার্মেন্টস কর্মীরা পায়ে হেঁটে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা শহরে ছেড়েছে এবং এসেছে। ত্রাণের কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে সুস্থ্ ব্যক্তিরা কিভাবে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যু কোলে ঢলে পড়েছেন তাও দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, ডাক্তার, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন এই করোনার সংক্রমণে।

আমি শব্দ হিসাবে অন্যান্য বিদেশী শব্দ যেমন লকডাউন, কোয়ারেন্টিন-এর মত কঠিন শব্দ ব্যবহারের বিপক্ষে। আমার মতে, অবশ্যই সহজ ও বোধগম্য শব্দ ব্যবহার করতে হবে, যাতে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ কথাগুলো বুঝতে পারে। এজন্য গৃহবন্দী শব্দটি বেছে নিচ্ছি। যদি ১৫ দিন কার্যত গৃহবন্দী থাকতে পারি তাহলে নতুন সংক্রমণের পরিমাণ কমে আসবে। নতুন সংক্রমণ না হলে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।

এই ১৫ দিনের গৃহবন্দীকালীন সময়ে সকল গণপরিবহন যেমন বাস, সিএনজি, রিক্সা, ভ্যান, মোটরসাইকেল, সাইকেল, এমনকি মালামাল বহনকারী ট্রাকও বন্ধ থাকবে। শুধুমাত্র সরকার অনুমোদিত যানবাহন চলাচল করতে পারবে। দেশের সকল কাঁচাবাজার বন্ধ থাকবে। যার যা কাচাবাজার লাগবে তা অবশ্যই এই গৃহবন্দী সময়ের আগে সংরক্ষণ করতে হবে। এ সময়ে কোনভাবেই ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। জরুরি সেবা ছাড়া সকল দোকানপাট, অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আড়ত, ত্রাণ বিতরণ এমনকি নিয়মিত বাজার সব কিছুই বন্ধ থাকবে। যার যা কার্যক্রম করার দরকার, তাকে অবশ্যই গৃহবন্দী সময়ের আগেই করতে হবে এবং গৃহবন্দী কাল শেষ হলে করতে হবে। এখন কথা আসতে পারে, এই সময় যদি মানুষ অসুস্থ হয় সে কিভাবে হসপিটালে যাবে। এজন্য সংশ্লিট এলাকায় সরকার অনুমোদিত যানবাহনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যদি কারো খুব জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, সে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট থানার সাথে যোগাযোগ করবেন এবং তারা প্রয়োজনবোধ করলে রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন। এ সময়ে সকল রোগী করোনা পজিটিভ সাসপেক্ট হিসাবে চিকিৎসা পাবেন। চিকিৎসা কর্মীরা পর্যাপ্ত প্রটেকশান নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেবেন। কারণ, কোন চিকিৎসা কর্মী যদি সংক্রমিত হন, তাহলে গৃহবন্দী থাকাটা বৃথা হয়ে যাবে।

এই ১৫ দিনে যদি সংক্রমিতদের বের করে আনতে পারি তাহলে তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন সেন্টার বা হাসপাতালে রেখে দিতে পারবো। আমি কখনোই সংক্রমিতদের বাসায় রাখার পক্ষপাতি না। কারণ এতে করে পরিবারের অন্যান্যদেরও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এরকম একটা ব্যবস্থাপনা করার মত আমাদের প্রশাসনের তো এত লোকবল নাই। হ্যাঁ, আমরা জানি আমাদের সীমাবদ্ধতা। প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, র্যা ব এবং পুলিশসহ সকলকে একসাথে কাজ করবো। সবাই মিলে যদি চেষ্টা করি, তাহলে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারবো।

এখন কথা আসতে পারে, এই ১৫ দিন কখন থেকে শুরু হবে? আমার মতে, এইটা শুরু করতে হবে ২২শে মে ২০২০ থেকে এবং যা প্রলম্বিত হবে ৬ই জুন পর্যন্ত। সরকার ইতিমধ্যে ৩০শে মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। আমরা যদি এই ছুটিটা আরও ৬ দিন বাড়াতে পারি এবং সমন্বিতভাবে পালন করি তাহলে মহামারী থেকে রক্ষা পাব। আরেকটা কথা আসতে পারে, এ সময়ে গৃহবন্দী সময় দিলে তো মাঝে ঈদ আছে, মসজিদের নামাজ আছে, আরো বিভিন্ন সামাজিক কাজ-কারবার আছে, সেগুলোর কি হবে? উপলব্ধি প্রয়োজন যে, এটা দুর্যোগকালীন ছুটি, এ সময়ে এইসব ধর্মীয় সামাজিক আচার-আচরণ বন্ধ রাখতে হবে। একমাত্র গৃহবন্দী থাকার কারণেই দেশ ও মানুষকে রক্ষা পাবে- এটা মনে রাকতে হবে।

কথা আরো আসতে পারে। অভাবী মানুষের ঘরে এই ১৫ দিনের খাবার নাও থাকতে পারে।ঈদের সময় সকলের ঘরে কিছু না কিছু উদ্বৃত্ত খাবার থাকে। সবাই যদি অসহায় মানুষগুলোর পাশে বিভিন্ন দান (যেমন যাকাত, ফেতরাসহ অন্যান্য দানের) নিয়ে দাঁড়াতে পারি, তাহলে অভাবী মানুষগুলোর খাবারের অভাব পূরণ করতে পারবো। আর সরকার চাইলে এই ১৫ দিনের জন্য ২০ কেজি চাল, ২ কেজি ডাল, ২ কেজি তেল আর ৪ কেজি আলুর প্যাকেট এর ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে কারোরই ঘরের বাইরে যেতে হবে না। আমরা করোনার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে পারবো।

সবশেষে, আরেকটি কথা, যদি এই ১৫দিনের বন্ধে কোনভাবেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে আমরা কি আরো ১৫ দিনের ছুটি দিবো? আমি বলবো না। এই ছুটি আরো এক সপ্তাহ বাড়ানো যেতে পারে। যদি আমরা মোট ২২ দিনেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারি, তাহলে আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না। আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে সকল কিছু খুলে দিবো। যার যার ব্যক্তিগত সুরক্ষা রেখে ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে চলবো। এরপরও যদি মহামারীতে আক্রান্ত হই, তখন বলতে পারবো, সাধ্য মতো চেষ্টা করেছি। আর কি করার আছে?

এই ১৫ থেকে ২২ দিনের ছুটির বিষয়টি সরকার সকল মহলকে সরাসরি গাইডলাইন দিয়ে জানিয়ে দিতে পারে। সকল এলাকায় মাইকিং করে ছুটির বিষয়টি সর্বসাধারণকে জানাতে পারে। সকল ধর্মীয় উপসানালয় যেমন মসজিদ, মন্দির থেকে মাইকের মাধ্যমে ছুটির বিষয়টি জানানো যেতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি, সকলের প্রচেষ্টায় করোনা যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবো।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত), কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status