মত-মতান্তর
আগে মানুষের জীবন বাঁচান, মানুষই অর্থনীতি ও দেশ বাঁচাবে
ড. রেজা কিবরিয়া
১১ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ৩:৪০ পূর্বাহ্ন
কভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে আমরা যেই সংকটের সম্মুখীন, তাতে খুবই ভিন্ন দু’টি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা ও মানুষের প্রাণহানি যতটা সম্ভব কমানো। এটি মূলত জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ইস্যু। এতে সফল হলেই কেবল আমরা দ্বিতীয় অর্থাৎ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারবো। অনেক দেশই জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম চালাতে গিয়ে স্বল্প-মেয়াদে অর্থনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিল। এর ফলে শুধু ভাইরাস অনেক বেশি সংক্রমিত ও অতিরিক্ত বহু মানুষের মৃত্যুই হয়নি, বরং লকডাউনের মেয়াদও বেড়েছে, যার ফলে শেষ অবদি অর্থনীতি আরও ক্ষতির শিকার হবে।
জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই এই খাতের বিশেষজ্ঞদের কথা শুনতে হবে। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই একমত যে, বাংলাদেশে শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা শোচনীয়ভাবে কম। এই নিবন্ধে এই মহামারির দরুন সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যার বিপরীতে কী কী নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া যায়, শুধুমাত্র তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এই সংকটের সরকারি ব্যবস্থাপনা জাতির আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। করোনাভাইরাস ও মহামারী পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি হয়তো মাসের পর মাস আমাদের নাগরিকদের সম্মিতলিতভাবে আত্মত্যাগ করতে হবে। মানুষকে সামনের কঠিন সময় সম্পর্কে সতর্ক করা প্রয়োজন। সরকার ও সরকারের দেওয়া যেকোনো তথ্যের ওপর (বিশেষ করে করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ে) আস্থাহীনতা বিরাজ করলে, এই সংকট উৎরে আসতে যেই জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন, তা গড়া কঠিন হয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী ৫ই মার্চ জাতির উদ্দেশে যেই ভাষণ দিয়েছেন, তাতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নেওয়া পদক্ষেপের ওপর আরও তথ্য দেওয়া যেত। “সাধারণ ছুটি” ঘোষণা করা হয়েছে অনেক দেরিতে। অল্প কয়েকদিনের জন্য এই ছুটি একবার করে বাড়ানো হয়। এ থেকে গুরুতর পরিকল্পনাহীনতার বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠে। “সাধারণ ছুটি”র সময় কোন কোন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে ও তাদের সহায়তায় কী করা হবে, তা বলা হলে ভালো হতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষজন এই “লকডাউনে” যেন অনাহারে না ভোগেন, সেজন্য সরকারের পরিকল্পনা কী, তার বিস্তারিত জানাতে প্রধানমন্ত্রী ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও রশদের বিষয়ে খোলামেলা কথা বলা প্রয়োজন। সামরিক বাহিনী ও সুনামধন্য এনজিও কি খাদ্য বিতরণের কাজ দেখভাল করবে? নাকি এই দায়িত্ব দেওয়া হবে শাসক দলের অঙ্গসংগঠনগুলোকে? ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব আওয়ামী লীগকে দেওয়া হলে কী হয়, তা আমরা সবাই জানি।
খাদ্যের মজুত ও সরবরাহের মাত্রা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকার। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও অন্যান্যরা যেমনটি দেখিয়েছেন, মূল বিষয় হলো যে, গরিব মানুষের খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাদের যদি কোনো আয় না থাকে, তাহলে যতই খাদ্যেরই মজুত থাকুক না কেন, তারা খাদ্য কিনতে পারবে না। যেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম আগের পর্যায়ে আসতে আসতে, অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত লাখ লাখ পরিবারকে খাদ্য সরবরাহের পরিকল্পনা অবশ্যই করতে হবে সরকারকে।
ভূমিহীন শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা চালক, হকার ও এ ধরণের শ্রমজীবী মানুষ যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে চলেন, তাদের আয় পড়ে গেছে। সঞ্চয় ও সম্পত্তি না থাকায় অনাহার কিংবা তার চেয়েও খারাপ কিছু হওয়ার ঝুঁকি তাদের বেলায় বেশি। তাদের খাদ্য ও সরাসরি নগদ অর্থ দিতে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আলাদা করে রাখতে হবে। বিশেষ করে, গরিব পরিবারের শিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি রয়েছে প্রবল। এ থেকে যেন স্থায়ী ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করা যাবে ও অবশ্যই করতে হবে। এ ধরণের সহায়তা কত পরিবারকে কত দিন ধরে দিতে হবে ও সেজন্য কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হতে পারে, সেই ব্যাপারে সরকার ইঙ্গিত দিলে জাতি ভরসা পাবে।
সরকারের ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ যেভাবে কিছু অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ স্বাগত জানিয়েছেন, তা দেখে আমি হতাশ। একে ৭২,৫০০ কোটি টাকার প্যাকেজ বলাটা সৎ হবে না। কেননা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য এখানে প্রধান সুবিধা হলো হ্রাসকৃত সুদের হার। এই “প্যাকেজে”র আওতায় যেসব অর্থ ধার দেওয়া হবে, তা শেষপর্যন্ত ইচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এরপর এক পর্যায়ে জনগণের অর্থে ব্যাংকগুলোতে পুঁজি সরবরাহ করতে হবে। ফের আরও একবার মুষ্টিমেয় কিছু লোকের চুরির দেনা পরিশোধ করা হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের পকেট কেটে।
রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ভর্তুকিকৃত সুদে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে সরবরাহ করা হবে। কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থা আগে থেকেই ব্যপক খেলাপী ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত। বস্তুত, এই প্যাকেজের আওতায় ঋণ সংগ্রহের নতুন সুযোগ দেওয়া হলো শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। যেসব মানুষ প্রত্যাশা করছেন যে এই অর্থ ফেরত যাবে, তারা এটি ভেবেও চিন্তিত হবেন যে, ব্যবসার যেই অনিশ্চিত পরিস্থিতি, তাতে এই লোকগুলো কীভাবে এই অর্থ পরিশোধ করবেন! যাদের অর্থ পরিশোধের কোনো ইচ্ছাই নেই, তারাই এই কাতারে আগে দাঁড়িয়ে পড়বেন। এই শাসকগোষ্ঠী যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন ঋণ পরিশোধের জন্য কোনো চাপ অনুভব করবেন না তারা। অর্থ সচিবও এই ঋণদানের বিষয়ে “নৈতিক বিপত্তি” সম্পর্কিত কিছু উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই আমরা ঋণের গাইডলাইনের জন্যই অপেক্ষা করি।
যদি আমরা চাই অর্থনীতি শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়াক, তাহলে এই কঠিন সময়ে ব্যবসায়ি সমাজকে সহায়তা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ঋণ বিতরণে হয়তো রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব দেখা যাবে। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়বে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত ও অনানুষ্ঠানিক খাতের ঋণ পেতে যেসব সমস্যা পোহাতে হয়, তা এই প্যাকেজে কার্যকরভাবে ঠিক করা হয়নি। কিছু সান্ত্বনার বাক্য আছে যে সমাজের প্রত্যেক খাত এই প্যাকেজের আওতায় লাভবান হবে। কিন্তু বাস্তবে ইতিবাচক ফলাফল নির্ভর করবে কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়নের উপর। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের অতীত ইতিহাস থেকে ভরসা পাওয়া যায় না।
যদি গভীর মন্দায় পড়ে অর্থনীতি, যখন ব্যবসা ও গ্রাহকের আস্থা একেবারেই তলানির দিকে, তখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে হবে আর্থিক নীতির মাধ্যমে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে নিজের ভূমিকা বাড়াতে হবে রাষ্ট্রের, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও। সারা বিশ্বজুড়ে তা-ই হচ্ছে। মন্দার সময় বড়জোর দ্বিতীয় সহায়কের ভূমিকা রাখে আর্থিক নীতি। জন কেয়নিস যেমনটা বলেছেন, অর্থনীতিকে বেগবান করতে আর্থিক নীতি ব্যবহার করা অনেকটা চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও অর্থের জোগান দেওয়ার সমতুল্য। বৈশ্বিকভাবেই পরিস্থিতি যখন খারাপ দেখাবে, তখন যত কম সুদের হারই দেওয়া হোক না কেন, খুব কম প্রকৃত ব্যবসায়ীই ঋণ নেবেন বা বিনিয়োগ করবেন।
এমন পরিস্থিতি যদি দাঁড়ায় যে সরকারের রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়া ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, তখন আর্থিক অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে বেশি কিছু জানা যায়নি। বারবারই খুবই আশাবাদি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, এই সংকটের মাত্রা কতটা ভয়াবহ, তা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেননি নীতিনির্ধারকরা। এটি এমনিতেই ভয়াবহ। ইতিমধ্যেই মেয়াদোর্ত্তীর্ণ হয়ে পড়া এডিবি’র প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসকে আমলে নিলে কাজের কাজ কিছু হবে না।
জনস্বাস্থ্য, ত্রাণ, রশদ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর অতিরিক্ত ব্যয় পুষিয়ে নিতে বাজেট কীভাবে পুনর্গঠন করা হবে, তা নিয়ে কোনো ইঙ্গিত দেয়নি সরকার। যেসব বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের ব্যায় বাজেট থেকে বড় আকারে বহন করার কথা, সেগুলো হয়তো স্থগিত কিংবা বাতিল করতে হতে পারে। শ্রমনিবিড় কর্ম প্রকল্পগুলো বাড়ানো হলে গরিব মানুষের আয় বাড়বে। এতে করে প্রান্তিক অর্থনৈতিক অবকাঠামোও হয়তো শক্তিশালী হবে।
গরিব মানুষের জন্য করোনাভাইরাস কোনো “আর্থিক ক্ষতি” বা “সামগ্রিক সম্পদ হ্রাস” করবে না; বরং, রাষ্ট্র সহায়তা না করলে, গরিব মানুষ স্রেফ না খেয়ে বেঘোরে মারা যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এটি অবশ্যই হতে দিতে পারি না। শুধুমাত্র নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে নয় শুধু, এ কারণেও যে আমাদের মানবসম্পদই আমাদের দেশের সম্পদ। তারাই আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবেন।
ঢাকা। এপ্রিল ৭, ২০২০।
জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই এই খাতের বিশেষজ্ঞদের কথা শুনতে হবে। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই একমত যে, বাংলাদেশে শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা শোচনীয়ভাবে কম। এই নিবন্ধে এই মহামারির দরুন সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যার বিপরীতে কী কী নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া যায়, শুধুমাত্র তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এই সংকটের সরকারি ব্যবস্থাপনা জাতির আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। করোনাভাইরাস ও মহামারী পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি হয়তো মাসের পর মাস আমাদের নাগরিকদের সম্মিতলিতভাবে আত্মত্যাগ করতে হবে। মানুষকে সামনের কঠিন সময় সম্পর্কে সতর্ক করা প্রয়োজন। সরকার ও সরকারের দেওয়া যেকোনো তথ্যের ওপর (বিশেষ করে করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ে) আস্থাহীনতা বিরাজ করলে, এই সংকট উৎরে আসতে যেই জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন, তা গড়া কঠিন হয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী ৫ই মার্চ জাতির উদ্দেশে যেই ভাষণ দিয়েছেন, তাতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নেওয়া পদক্ষেপের ওপর আরও তথ্য দেওয়া যেত। “সাধারণ ছুটি” ঘোষণা করা হয়েছে অনেক দেরিতে। অল্প কয়েকদিনের জন্য এই ছুটি একবার করে বাড়ানো হয়। এ থেকে গুরুতর পরিকল্পনাহীনতার বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠে। “সাধারণ ছুটি”র সময় কোন কোন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে ও তাদের সহায়তায় কী করা হবে, তা বলা হলে ভালো হতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষজন এই “লকডাউনে” যেন অনাহারে না ভোগেন, সেজন্য সরকারের পরিকল্পনা কী, তার বিস্তারিত জানাতে প্রধানমন্ত্রী ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও রশদের বিষয়ে খোলামেলা কথা বলা প্রয়োজন। সামরিক বাহিনী ও সুনামধন্য এনজিও কি খাদ্য বিতরণের কাজ দেখভাল করবে? নাকি এই দায়িত্ব দেওয়া হবে শাসক দলের অঙ্গসংগঠনগুলোকে? ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব আওয়ামী লীগকে দেওয়া হলে কী হয়, তা আমরা সবাই জানি।
খাদ্যের মজুত ও সরবরাহের মাত্রা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকার। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও অন্যান্যরা যেমনটি দেখিয়েছেন, মূল বিষয় হলো যে, গরিব মানুষের খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাদের যদি কোনো আয় না থাকে, তাহলে যতই খাদ্যেরই মজুত থাকুক না কেন, তারা খাদ্য কিনতে পারবে না। যেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম আগের পর্যায়ে আসতে আসতে, অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত লাখ লাখ পরিবারকে খাদ্য সরবরাহের পরিকল্পনা অবশ্যই করতে হবে সরকারকে।
ভূমিহীন শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা চালক, হকার ও এ ধরণের শ্রমজীবী মানুষ যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে চলেন, তাদের আয় পড়ে গেছে। সঞ্চয় ও সম্পত্তি না থাকায় অনাহার কিংবা তার চেয়েও খারাপ কিছু হওয়ার ঝুঁকি তাদের বেলায় বেশি। তাদের খাদ্য ও সরাসরি নগদ অর্থ দিতে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আলাদা করে রাখতে হবে। বিশেষ করে, গরিব পরিবারের শিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি রয়েছে প্রবল। এ থেকে যেন স্থায়ী ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করা যাবে ও অবশ্যই করতে হবে। এ ধরণের সহায়তা কত পরিবারকে কত দিন ধরে দিতে হবে ও সেজন্য কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হতে পারে, সেই ব্যাপারে সরকার ইঙ্গিত দিলে জাতি ভরসা পাবে।
সরকারের ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ যেভাবে কিছু অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ স্বাগত জানিয়েছেন, তা দেখে আমি হতাশ। একে ৭২,৫০০ কোটি টাকার প্যাকেজ বলাটা সৎ হবে না। কেননা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য এখানে প্রধান সুবিধা হলো হ্রাসকৃত সুদের হার। এই “প্যাকেজে”র আওতায় যেসব অর্থ ধার দেওয়া হবে, তা শেষপর্যন্ত ইচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এরপর এক পর্যায়ে জনগণের অর্থে ব্যাংকগুলোতে পুঁজি সরবরাহ করতে হবে। ফের আরও একবার মুষ্টিমেয় কিছু লোকের চুরির দেনা পরিশোধ করা হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের পকেট কেটে।
রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ভর্তুকিকৃত সুদে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে সরবরাহ করা হবে। কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থা আগে থেকেই ব্যপক খেলাপী ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত। বস্তুত, এই প্যাকেজের আওতায় ঋণ সংগ্রহের নতুন সুযোগ দেওয়া হলো শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। যেসব মানুষ প্রত্যাশা করছেন যে এই অর্থ ফেরত যাবে, তারা এটি ভেবেও চিন্তিত হবেন যে, ব্যবসার যেই অনিশ্চিত পরিস্থিতি, তাতে এই লোকগুলো কীভাবে এই অর্থ পরিশোধ করবেন! যাদের অর্থ পরিশোধের কোনো ইচ্ছাই নেই, তারাই এই কাতারে আগে দাঁড়িয়ে পড়বেন। এই শাসকগোষ্ঠী যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন ঋণ পরিশোধের জন্য কোনো চাপ অনুভব করবেন না তারা। অর্থ সচিবও এই ঋণদানের বিষয়ে “নৈতিক বিপত্তি” সম্পর্কিত কিছু উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই আমরা ঋণের গাইডলাইনের জন্যই অপেক্ষা করি।
যদি আমরা চাই অর্থনীতি শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়াক, তাহলে এই কঠিন সময়ে ব্যবসায়ি সমাজকে সহায়তা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ঋণ বিতরণে হয়তো রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব দেখা যাবে। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়বে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত ও অনানুষ্ঠানিক খাতের ঋণ পেতে যেসব সমস্যা পোহাতে হয়, তা এই প্যাকেজে কার্যকরভাবে ঠিক করা হয়নি। কিছু সান্ত্বনার বাক্য আছে যে সমাজের প্রত্যেক খাত এই প্যাকেজের আওতায় লাভবান হবে। কিন্তু বাস্তবে ইতিবাচক ফলাফল নির্ভর করবে কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়নের উপর। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের অতীত ইতিহাস থেকে ভরসা পাওয়া যায় না।
যদি গভীর মন্দায় পড়ে অর্থনীতি, যখন ব্যবসা ও গ্রাহকের আস্থা একেবারেই তলানির দিকে, তখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে হবে আর্থিক নীতির মাধ্যমে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে নিজের ভূমিকা বাড়াতে হবে রাষ্ট্রের, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও। সারা বিশ্বজুড়ে তা-ই হচ্ছে। মন্দার সময় বড়জোর দ্বিতীয় সহায়কের ভূমিকা রাখে আর্থিক নীতি। জন কেয়নিস যেমনটা বলেছেন, অর্থনীতিকে বেগবান করতে আর্থিক নীতি ব্যবহার করা অনেকটা চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও অর্থের জোগান দেওয়ার সমতুল্য। বৈশ্বিকভাবেই পরিস্থিতি যখন খারাপ দেখাবে, তখন যত কম সুদের হারই দেওয়া হোক না কেন, খুব কম প্রকৃত ব্যবসায়ীই ঋণ নেবেন বা বিনিয়োগ করবেন।
এমন পরিস্থিতি যদি দাঁড়ায় যে সরকারের রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়া ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, তখন আর্থিক অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে বেশি কিছু জানা যায়নি। বারবারই খুবই আশাবাদি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, এই সংকটের মাত্রা কতটা ভয়াবহ, তা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেননি নীতিনির্ধারকরা। এটি এমনিতেই ভয়াবহ। ইতিমধ্যেই মেয়াদোর্ত্তীর্ণ হয়ে পড়া এডিবি’র প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসকে আমলে নিলে কাজের কাজ কিছু হবে না।
জনস্বাস্থ্য, ত্রাণ, রশদ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর অতিরিক্ত ব্যয় পুষিয়ে নিতে বাজেট কীভাবে পুনর্গঠন করা হবে, তা নিয়ে কোনো ইঙ্গিত দেয়নি সরকার। যেসব বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের ব্যায় বাজেট থেকে বড় আকারে বহন করার কথা, সেগুলো হয়তো স্থগিত কিংবা বাতিল করতে হতে পারে। শ্রমনিবিড় কর্ম প্রকল্পগুলো বাড়ানো হলে গরিব মানুষের আয় বাড়বে। এতে করে প্রান্তিক অর্থনৈতিক অবকাঠামোও হয়তো শক্তিশালী হবে।
গরিব মানুষের জন্য করোনাভাইরাস কোনো “আর্থিক ক্ষতি” বা “সামগ্রিক সম্পদ হ্রাস” করবে না; বরং, রাষ্ট্র সহায়তা না করলে, গরিব মানুষ স্রেফ না খেয়ে বেঘোরে মারা যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এটি অবশ্যই হতে দিতে পারি না। শুধুমাত্র নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে নয় শুধু, এ কারণেও যে আমাদের মানবসম্পদই আমাদের দেশের সম্পদ। তারাই আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবেন।
ঢাকা। এপ্রিল ৭, ২০২০।