বিশ্বজমিন

বাড়িতে মৃত্যু: করোনায় ইতালির অদেখা হাহাকার

মানবজমিন ডেস্ক

৫ এপ্রিল ২০২০, রবিবার, ৮:৫৬ পূর্বাহ্ন

সিলভিয়া বেরতুলেত্তির ৭৮ বছর বয়সী পিতা আলেসান্দ্রো তীব্র জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তাকে দেখতে আসার জন্য চিকিৎসকদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন বেরতুলেত্তি। টানা ১১ দিন উন্মাদের মতো ফোন করার পর চিকিতসকদের ফোন করেন তিনি। অবশেষে ১৮ই মার্চ একজন চিকিৎসক তার বাড়িতে যান। ততদিনে বেশ দেরি হয়ে যায়। ১৯শে মার্চ সকালে আলেসান্দ্রোকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য এম্বুলেন্স ডাকা হয়েছিল। সে এম্বুলেন্সও আসে দেরিতে। আলেসান্দ্রোকে মৃত ঘোষণার ১০ মিনিট পর এসে পৌঁছায় এম্বুলেন্স। বেরতুলেত্তির সঙ্গে ফোনালাপে আলেসান্দ্রোকে কিছু পেইনকিলার ও অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দিয়েছিলেন এক চিকিৎসক। একমাত্র চিকিৎসা হিসেবে সেটুকুই ছিল আলেসান্দ্রোর প্রাপ্তি।

বেরতুলেত্তি বেরগামোর বাসিন্দা। করোনা ভাইরাসে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রাণহানীর দেশ ইতালির সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত অঞ্চল এটি। সেখানে শনিবার পর্যন্ত এই ভাইরাসে শিকার হয়ে মারা গেছেন ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ২৪ হাজারের বেশি মানুষ। করোনার আগ্রাসনের মুখে দেশটির অসহায়ত্ব বিশ্বজুড়ে আর্তনাদ জাগিয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে সেখানকার জনগণের অসহায়ত্বের একাংশ ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনটিতে যথাযথ চিকিৎসা সেবা না পেয়ে বাড়িতে থেকে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের শোকাবহ বর্ণনা উঠে এসেছে। বেরুলেত্তির পিতার মৃত্যু তেমনই এক ঘটনা।

৪৮ বছর বয়সী বেরুলেত্তি বলেন, আমার বাবাকে বাড়িতে থেকে, কোনোরকমের সাহায্য ছাড়া, একা একা মরার জন্য রেখে দেয়া হয়েছিল। সোজাভাবে, আমাদের ফেলে রাখা হয়েছিল। কারো সঙ্গেই এমনটা হওয়া উচিৎ নয়।
চিকিৎসক, পরিবার ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স জানিয়েছে যে, বেরুলেত্তির মতো পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন অনেকে। বাড়িতে চিকিৎসা না পেয়ে মরছেন অগণিত ইতালীয়। ফোনে দেয়া পরামর্শ পর্যাপ্ত নয়। সাম্প্রতিক মৃতের হিসাব নিয়ে করা এক গবেষণা অনুসারে, বেরগামোতে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাবের দ্বিগুণ হতে পারে। সেখানে কেবলমাত্র হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীদের হিসাব রাখা হচ্ছে।

করোনা মোকাবিলায় বিশ্বজুড়েই নজিরবিহীন চাপের মুখে আছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। দেশে দেশে দেখা দিয়েছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট। তবে মৌলিক চিকিৎসাসেবার অভাবও কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিতে সক্ষম নয় বা ইচ্ছুক নয় বলে জানিয়েছেন অনেক চিকিৎসক। বেরগামোর এক চিকিৎসক রিকার্দো মুন্দা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে বহু পারিবারিক চিকিৎসক কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের রোগীদের দেখতে যাচ্ছেন না। আমি তাদের দোষও দিচ্ছি না। রোগী দেখতে না গিয়েই তারা নিজেদের বাঁচাচ্ছেন। মুন্দা বর্তমানে একাই দুজন চিকিৎসকের কাজ করছেন। কয়েকদিন আগে তার এক সহকর্মীর মধ্যে করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। তিনি বলেন, বাড়িতে চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো গেলে আরো অনেক প্রাণ বাঁচানো যেত। কিন্তু চিকিৎসকরা সেজন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম পাচ্ছে না। চিকিৎসকরা ফোনের মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা দেন। কিন্তু তা কাজ না করলে, সে অবস্থা কোনো চিকিৎসক যাচাই না করলে বা ওষুধ যথাযথভাবে কাজ না করলে, রোগীরা মারা যান।
ইতালিতে হাসপাতালকর্মীরা সুরক্ষা সরঞ্জাম পেলেও, পারিবারিক চিকিৎসকরা জানান, তারা পর্যাপ্ত পিপিই, মাস্ক বা গ্লভস পাননি।

বেরগামো প্রদেশ অবস্থিত লম্বার্দি অঞ্চলে। সেখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বখ্যাত। অঞ্চলটির রাশট্র-পরিচালিত স্বাস্থ্য সংস্থা এটিএস পারিবারিক চিকিৎসকদের, ফোনের মাধ্যমে যথাসম্ভব সেবা দিতে বলেছে। সংক্রমণ এড়াতে বাড়ি যাওয়া কমাতে বলেছে। প্রসঙ্গত, এখন পর্যন্ত লম্বার্দিতে করোনার চিকিৎসা করতে গিয়ে কোয়ারেন্টিনে আছেন বা অসুস্থ হয়েছেন মোট ১৪২ জন চিকিৎসক।

বেরগামোর বেশ কয়েকটি গ্রামজুড়ে দাফনের কাজ করে থাকে জুচেলি নামের একটি সংস্থা। এর পরিচালক পিয়েত্রো জুচেলি জানান, গত দুই সপ্তাহে তারা যতগুলো লাশ দাফন করেছেন, এর ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে তাদের। এর আগে বেশিরভাগ লাশ আসতো হাসপাতাল বা নার্সিং হোম থেকে।
বেরুলেত্তির পারিবারিক চিকিৎসক বর্তমানে নিজেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তার বদলে অন্য আরেকজনকে ফোন দিয়েছিলেন বেরুলেত্তি। কিন্তু তার চিকিৎসায় লাভ হয়নি। ওই চিকিৎসক জানান, প্রতিদিন তার কাছে ৪০০ থেকে ৫০০ ফোনকল আসে। আর এই মুহূর্তে তিনি তার এক অসুস্থ সহকর্মীর রোগীদেরও দেখভাল করছেন। তিনি বলেন, আমাকে বেছে বেছে বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শুধু জ্বর ও কাশি হয়েছে এমন রোগীদের দেখার মতো ফুরসত নেই আমার। কেবল গুরুতর রোগীদেরই দেখতে যাচ্ছি।
বেরগামোর মেয়র গিয়রগিও গরি বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও সবাইকে হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সময় পরিবারের সদস্যরা অসুস্থদের বাড়িতেই রাখতে চান। তাদের ভয়, হাসপাতালে গেলে হয়তো শেষ দেখাও দেখতে পারবেন না তারা।
গরির মতো লম্বার্দিজুড়ে প্রত্যেক প্রদেশের মেয়ররাই সাহায্যের জন্য তীব্র আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন। বোরঘেত্তো লদিগিয়ানোর মেয়র গিয়োভানা গারগিয়োনি বলেন, আমাদের অনেক অসুস্থ নাগরিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। তাদের ফেলে রাখা হচ্ছে। আমি আপনাদের এরকম শত শত উদাহরণ দিতে পারবো।

করোনা ইতালির স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে চারপাশ থেকে চেপে ধরে রেখেছে। স্বাভাবিক সময়ে জরুরি সেবায় ফোন দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যেত এম্বুলেন্স। এখন এম্বুলেন্স পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। অক্সিজেন বোতলের সংকট দেখা দিচ্ছে। কোনো রোগী মারা গেলে তাৎক্ষণিকভাবে নার্সরা ছুটে যাচ্ছেন, তার জন্য ব্যবহৃত বোতলটি অন্য কাউকে দিতে।

বেরগামোতে স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তাকারী সংস্থা ইতিনারিসের এক নার্স মৌরা জুচেলি বলেন, আমরা মানুষকে মরতে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে মনে হয়, আপনি তাদের রাস্তার শেষ পর্যন্ত সঙ্গ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখন মানুষের বাড়িতে যাওয়ার আর ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যে রোগী মারা যাচ্ছে। এটা আরো খারাপ দিকে এগুচ্ছে। যেন যুদ্ধ চলছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status