বিশ্বজমিন

করোনা ভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব কেমন হবে? (পর্ব-২)

সাইমন মাইর

১ এপ্রিল ২০২০, বুধবার, ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন

বিশ্বজুড়ে নির্মম তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯)। কেড়ে নিয়েছে অজস্র প্রাণ। আক্রান্ত করেছে লাখো মানুষকে। ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে জারি হয়েছে লকডাউন। থেমে গেছে জীবনযাত্রা। বহু মানুষ কাজ হারানোর ভয়ে আছে। এমন অবস্থায়, এই মহামারির পরবর্তী অবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ ও হতে পারে তা নিয়ে দ্য কনভার্সেশনে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেছেন গবেষক সাইমন মাইর। তিনি ইউনিভার্সিটি অব সারে-এর সেন্টার ফর আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব সাসটেইনেবল প্রসপারেটির পরিবেশগত অর্থনীতির রিসার্চ ফেলো। গতকাল মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি অংশবিশেষ অনুবাদ প্রথম পর্ব হিসেবে মানবজমিনের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে। আজ বুধবার দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ করা হচ্ছে। আগামীকাল শেষ ও তৃতীয় পর্ব প্রকাশ করা হবে।

অর্থনীতি কিসের জন্য?
কভিড-১৯ মোকাবিলায় পদক্ষেপ বোঝার ক্ষেত্রে মুখ্য প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতি কিসের জন্য। বর্তমানে, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থের বিনিময়ের ব্যবস্থা করা। অর্থনীতিবিদরা এটিকে বলেন, ‘বিনিময় মূল্য’ (এক্সচেঞ্জ ভ্যেলু)।

সবচেয়ে জনপ্রিয় আইডিয়াটা হচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিনিময় মূল্য ও ব্যবহার মূল্য একই জিনিস। মূলত, মানুষ অর্থ খরচ করে তাদের প্রয়োজনীয় বা আকাঙ্ক্ষিত জিনিস কিনবে। অর্থের এ খরচ থেকে বোঝা যায়, মানুষ এর ব্যবহারের কতটা মূল্য দেয়। এজন্যই বাজারগুলোকে সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সেরা উপায় হিসেবে দেখা হয়। এতে মানুষ খাপ খাওয়ানোর সুযোগ পায়, ব্যবহারের মূল্যের সঙ্গে মিলিয়ে উৎপাদনের নিশ্চিতের সুযোগ পায়।
বাজার সম্বন্ধে আমাদের ধারণাগুলো কতটা ভুল তা ধরিয়ে দিচ্ছে কভিড-১৯। বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে সরকাররা আতঙ্কিত যে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাগুলো বিঘ্নিত হবে বা অত্যধিক চাপে পড়বে। এমন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে, সাপ্লাই চেইন, সোশ্যাল কেয়ার, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে স্বাস্থ্যসেবা। এর পেছনে অনেকগুলো নিয়ামক কাজ করে। তবে আপাতত দুটো নিয়ে আলোচনা করা যাক।

প্রথমত, বেশিরভাগ আবশ্যক সামাজিক সেবা থেকে অর্থ আয় করা অত্যন্ত কঠিন। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, লাভের অন্যতম চালক হচ্ছে শ্রম উৎপাদন প্রবৃদ্ধি: কম মানুষ দিয়ে বেশি কাজ করানো। অনেক ব্যবসায় কর্মী সংখ্যা খরচের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে, স্বাস্থ্যসেবার মতো ব্যক্তিগত সংস্পর্শ প্রয়োজন হয় সেগুলোতে এই ভূমিকার হার বেশি। ফলত, অর্থনীতির অন্যান্য খাতের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবায় উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক ধীর গতির হয়। এর খরচ গড়পড়তা অন্যান্য খাতের তুলনায় বেশি হয়।

দ্বিতীয়ত, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেবার কাজগুলো সমাজে উচ্চ পর্যায়ের মূল্যায়ন পায় না। সবচেয়ে বেশি বেতনের কিছু কাজ কেবল বিনিময়ের ব্যবস্থা নিশ্চিতেই বিদ্যমান: আয় করতে। সেগুলোর অন্যকোনো উদ্দেশ্য নেই। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য ও সোশ্যাল কেয়ারের মতো খাতগুলো থেকে অনেক সময় কর্মীরা বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়। কেননা, সেগুলোয় জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত আয় নেই।

অর্থহীন কাজ
বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ অর্থহীন কাজ করে। কভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতির করুণ অবস্থার একাংশের জন্য দায়ী এসব কাজ। এই মহামারী বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, অনেক কাজের কোনো দরকার নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে।

যে সমাজে অর্থনীতির মূল নীতিমালা হচ্ছে বিনিময় মূল্য ও জীবনযাপনের মৌলিক প্রয়োজন বাজারেই পাওয়া যায় সেখানে মানুষ অর্থহীন কাজ করতে আকর্ষণ বোধ করে। এর মানে হচ্ছে, আপনাকে সেগুলো কিনতে হবে। এজন্য প্রয়োজন আয়। আর এই আয় আসে চাকরির মাধ্যমে।

এই ব্যবস্থার অপর পিঠ হচ্ছে, কভিড-১৯ মোকাবিলায় সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়াগুলো বাজার ও বিনিময় মূল্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। বিশ্বজুড়ে সরকাররা এমনসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন যা, একমাস আগেও অসম্ভব লাগতো। স্পেনে বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারি আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বৃটেনে বিভিন্ন গণপরিবহণ সরকারি হওয়ার পথে আছে। ফ্রান্সে বড় ব্যবসাগুলোকে রাষ্ট্রীয় আওতায় আনতে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

একইভাবে শ্রমবাজারেও বদল দেখা যাচ্ছে। ডেনমার্ক ও বৃটেনের মতো দেশগুলো মানুষকে কাজে যাওয়া থেকে ঠেকাতে অর্থ দিচ্ছে। সফল লকডাউনের একটি বড় প্রয়োজন এটা। তবে এসব পদক্ষেপ এখনো শতভাগ কার্যকরী নয়। তবুও, মানুষের আয় করতে হলে কাজ করতে হবে এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে এটা একটা পদক্ষেপ।  এমন একটা ধারণার দিকে বিশ্ব পা বাড়াচ্ছে যে, মানুষ কাজ না করেও বেঁচে থাকতে পারবে।
এই আইডিয়া বিগত ৪০ বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাকে পাল্টে দিচ্ছে। সময়ের সঙ্গে বাজার ও বিনিময় মূল্যকে অর্থনীতি পরিচালনার সেরা উপায় হিসেবে দেখা হয়েছে। জনসেবাগুলোর বাজারিকরণের চাপ বেড়েছে। অর্থ আয়ের জন্য ব্যবসার মতো পরিচালনার দিকে ধাবিত করা হয়েছে। একইভাবে, শ্রমিকরা বাজারের উপর প্রতিনিয়ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

কভিড-১৯ এই ধারাকে পাল্টে দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা ও শ্রম পণ্যকে বাজার থেকে বের করে নিচ্ছে। রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিচ্ছে। রাষ্ট্র নানা কারণে উৎপাদন করে। কিছু ভালো কারণ, কিছু মন্দ। কিন্তু বাজারের মতো, রাষ্ট্রকে কেবল বিনিময় মূল্যের জন্য উৎপাদন করতে হয় না।

আমি এতে আশা পাই। এটা আমাদের অনেক প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ দেয়। এতে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের আভাসও পাওয়া যায়, যেগুলো আমাদের আরো সুখী করে তুলতে পারবে ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়ক হবে। এখানে আসতে আমাদের এতো দেরি হলো কেন? দেশগুলো উৎপাদন কমাতে এত কম প্রস্তুত ছিল কেন? এর উত্তর পাওয়া যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে: তাদের সঠিক মানসিকতা ছিল না।

আমাদের অর্থনৈতিক কল্পনা
৪০ বছর ধরে অর্থনীতি নিয়ে একটি বিস্তৃত ঐক্যমত বজায় রয়েছে। এতে রাজনীতিক ও তাদের উপদেষ্টাদের বিদ্যমান ব্যবস্থার ভুল ধরার সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে। এই মানসিকতার সঙ্গে দুই ধরনের বিশ্বাস জড়িত: এক, বাজার হচ্ছে উচ্চমানের জীবন সরবরাহকারী, তাই এটি রক্ষা করতে হবে। দুই, যেকোন সংকটের পরই বাজার সর্বদা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে যাবে।

বহু পশ্চিমা দেশে এসব দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। তবে এগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে। কভিড-১৯ মোকাবিলায় দুটি দেশের প্রস্তুতিই অপর্যাপ্ত। বৃটেনে একটি ব্যক্তিগত সরকারি বৈঠকের যোগদানকারীরা বলেছেন, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ সহযোগীরা অর্থনীতি রক্ষায় ‘হার্ড ইমিউনিটি’র মাধ্যমে ভাইরাসটি মোকাবিলা করতে চেয়েছেন। যার মানে হচ্ছে, কিছু মানুষ মারা যাবে, কিছু পেনশনার মারা যাবে। এতে খুব খারাপ কিছু হবে না। সরকার অবশ্য এ দাবি প্রত্যাখ্যান কররেছে। কিন্তু এটা সত্য হলেও, অবিশ্বাস করার মতো হবে না। এই মহামারীর শুরুর দিকে এক সরকারি অনুষ্ঠানে একজন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা আমায় বলেছিল, অর্থনীতি বিঘ্নিত করার কী দরকার আছে? আপনি যদি জীবনের আর্থিক মূল্য বিবেচনা করেন, হয়তো নেই।

এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অভিজাত শ্রেণির মধ্যে বেশি দেখা যায়। টেক্সাসের এক কর্মকর্তা যুক্তি দেখিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক মন্দায় ডুবে যেতে দেখার চেয়ে, মরে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন বৃদ্ধরা। এই দৃষ্টিভঙ্গি ঝুঁকিতেঁ মানুষকে আরো ঝুঁকিতে ফেলে। এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত।

কভিদ-১৯ সংকট অনেককিছুর সঙ্গে অর্থনৈতিক কল্পনাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশে দেশে সরকার ও নাগরিকরা এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে যা তিন মাস আগে অসম্ভব মনে হতো। একইভাবে বিশ্ব কীভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে আমাদের ধারণাও বেশ দ্রুত পাল্টাচ্ছে। দেখা যাক, এই কল্পনা আমাদের কোথায় নিয়ে যায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status