অনলাইন

করোনার কাছে হেরে গেল স্বপন

মাহবুবা চৌধুরী

৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ২:৪৮ পূর্বাহ্ন

সেই কবেকার কথা। বিরানব্বই সাল। মতিউর রহমান চৌধুরী প্রকাশ করলেন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা। সঙ্গে এক ঝাঁক উদ্যমী তরুণ। পত্রিকাটি সংবাদপত্র জগতে একেবারে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। ফটোসাংবাদিক হিসেবে পেয়েছিলাম স্বপন হাইকে। কর্মচঞ্চল এক সাহসী তরুণ। আর্থিক সংকটে বাংলাবাজার বিক্রি করে দেয়ার পর অনেকেই চলে গিয়েছিল আমাদের ছেড়ে। থেকে গিয়েছিল স্বপন হাইসহ কিছু নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।মানবজমিন প্রকাশের পর নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সবাই। স্বপনও তার ব্যতিক্রম নয়। একদিন লাজুকমুখে বিয়ের কার্ড নিয়ে স্বপন  হাজির। বিয়ে করছে। কোনো ওজর আপত্তি শুনবে না। বিয়েতে যেতেই হবে। বিপদে পড়লাম। ওয়ার্কিং ডে। দুপুরে দাওয়াত। ছেলের স্কুল খোলা। কী করে ম্যানেজ করি। মাকে বাসায় রেখে বিয়েতে হাজির হলাম। বউ দেখে মুগ্ধ। স্বপন যেমন সুপুরুষ, বউটাও ভারি মিষ্টি। এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। সুখে দুঃখে এভাবেই আমাদের সাথে জড়িয়ে ছিল স্বপন। প্রতিবছরই আমার সহকর্মীরা অফিসে আমার জন্মদিন পালন করে। কোনো ওজর আপত্তিতে কাজ হয় না। বেশ ক’ বছর আগে জন্মদিনে অফিসে বসে আছি। স্বপন ওর কিশোরী মেয়ের হাত ধরে আমার কামরায় হাজির। মেয়েটির হাতে একটা সোনালী প্যাকেট। বললো, আন্টি আপনার জন্য। চমৎকার কিছু ইমিটেশন জুয়েলারি। বললাম, এগুলোতে তুমি পরবে সোনা, আমাকে কেন? বললো, আপনিতো খবর পড়েন, এগুলো টিভিতে পরবেন। কি মায়াবি ওর মুখটা। কাছে ডেকে প্রাণভরে আদর করলাম। স্বপনের শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বেঁধেছিল, সাথে উচ্চ রক্তচাপ। চোখেও সমস্যা হচ্ছিল। শরীরটা দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। একদিন বললো, আমি আমেরিকায় যাচ্ছি। নিউ ইয়র্কে আমার ভাই থাকে। ওখানে গেলে ভালো চিকিৎসা পাবো। স্বপন চলে গিয়েছিল। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। সবসময় খোঁজখবর পেতাম। ২০১৭ সালে আমরা  নিউ ইয়র্কে যাই। মতিউর অসুস্থ। একটা সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করি। খবর পেয়ে স্বপন হাই ছুটে আসে। প্রায় প্রতিদিনই একবার করে দেখা করে যায়। ওয়েল কর্নেল হসপিটালে মতিউরের বাইপাস হয়। অপারেশনের দিন সকাল বেলা ছুটে আসে স্বপন। অভয় দিয়ে বলে, ইনশাআল্লাহ কিচ্ছু হবে না। মতি ভাই সুস্থ হয়ে যাবেন। এটা অনেক উন্নত দেশ। আমারও ক’ বছর আগে বাইপাস হয়েছে। এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ। অপারেশনের পর আমরা দু’ মাস নিউ ইয়র্কে থাকি। প্রায় প্রতিদিনই স্বপন এসে মতিউরকে দেখে যেতো। চলে আসার দু’ দিন আগে পিঠার দাওয়াত দিল। বললো, আমার এক খালা খুব ভালো পিঠা বানায়, আমাদের বাসায় যেতে হবে। বললাম, বাসাতো তিন তলা, তাই না? মতিউরতো সিঁড়ি বাইতে  পারবে না। ডাক্তারের নিষেধ। স্বপন বললো, আমি কোলে করে নিয়ে যাবো। বললাম, পরেরবার আসলে অবশ্যই যাবো। এখন এতোবড় রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। আমরা যেতে পারিনি। স্বপন পাঁচ রকম পিঠা নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় হাজির। সে পিঠা প্রাণভরে খেয়েছি, অতিথিদেরও খাইয়েছি। স্বপনের মনে কষ্ট ছিল। বহুদিন দেশে আসতে পারে না। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা হয় না। আশা নিয়ে বেঁচেছিল স্বপন। কাগজপত্র ঠিক হয়ে গেলে দেশে ফিরতে পারবে। বছর দুয়েক আগে ওর কিডনি রোগ দেখা দিল। দু’/তিন বার হসপিটালেও থাকতে হলো। সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে গেল। তবে ডাক্তাররা বলে দিয়েছিল কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো ভারতে গিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হবে। এগিয়ে এলো বাংলাদেশ কমিউনিটি। কিছু ফান্ডও সংগ্রহ করা হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে করোনা কেড়ে নিলো স্বপনকে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status