শেষের পাতা

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি ও খাদ্য নিরাপত্তা

এম. সাফাক হোসেন

২৩ মার্চ ২০২০, সোমবার, ৮:৫২ পূর্বাহ্ন

করোনা ভাইরাস Covid-19 দ্বারা সংক্রমিত মানবদেহে বিস্তার ও প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এই মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সহ অন্যান্য ডিজিটাল মিডিয়াতে আলোচ্য বিষয়। ইতিমধ্যে এই ভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী ভাইরাস ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

আমি যেহেতু বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের এনএইচটিটিআই থেকে স্বাস্থ্যবিধি ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর প্রশিক্ষণ এবং সনদপ্রাপ্ত হয়েছি, পাশাপাশি বাংলাদেশ বিমান ক্যাটারিং সেন্টার থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট সম্পন্ন করেছি, সেই আলোকে মনুষ্য স্বাস্থ্যবিধি যা পারসোনাল হাইজিন পরিচিতি এবং খাদ্য নিরাপত্তা বিষয় নিয়ে লেখার আলোকপাত করার প্রয়াস নিলাম। মূল আলোকপাতে যাওয়ার আগে বর্তমানে আলোচিত করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কিছু তথ্য পাঠকদের সুবিধার্থে জ্ঞাত করার প্রয়োজন মনে করছি। এই ভাইরাসটি মার্স COD2 হিসেবে মানবদেহে সংক্রমিত হয়ে থাকে HCovid-১৯ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নামকরণ করেছে। গবেষণা বলে এই ধরনের ভাইরাস প্রায় ২০০ প্রজাতির। তাছাড়াও আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ভাইরাস রয়েছে যা মশাবাহিত যেমন-ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, জাপানিজ ইনসিফালাইটিস, ওয়েস্ট নাইল ইত্যাদি যা খুব দ্রুত বাংলাদেশে আরও একটি মহামারি আকারে রূপ ধারণ করবে বলে অনেক গবেষণায় বলা হচ্ছে। সবারই এ সকল বিষয় নিয়ে সতর্ক থাকার অনুরোধ রইলো। Covid-১৯ যেহেতু এক কোষ বিশিষ্ট একটি RNA ভাইরাস, অনেকটা কদম ফুলের মতো দেখতে যা হাঁচি-কাশি ও স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। ওজনে বায়ু থেকে ভারী হওয়ার কারণে মাটিতে পড়ে যায় যদি কোনো সংস্পর্শ না হয়।
যে কোনো ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস একটি পরজীবী প্রাণী। তাদেরকে বেঁচে থাকতে প্রয়োজন পানি, অক্সিজেন, খাদ্য এবং তাপমাত্রা ৫° সেলসিয়াস থেকে ৬০° সেলসিয়াস (৫°C to ৬০°C)। অতএব আমাদের তাপমাত্রা তাদের জন্য খুবই উপযোগী এবং দ্বিগুণ আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এই তাপমাত্রায়। মাইনাস তাপমাত্রায় এই ধরনের ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া অকার্যকর অবস্থায় থাকে তবে উল্লেখ্য তাপমাত্রায় তা আবার জীবিত হয়ে ওঠে। যে কারণে করোনা ভাইরাস থেকে প্রতিকার পেতে কোল্ড ফুড বা শীতল খাদ্য খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

পারসোনাল হাইজিন বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে কমবেশি প্রায় সকলকেই সতর্ক করা হয়েছে যেমনটা হাত ধোয়ার পরিপূর্ণ পন্থা, সেই সাথে পোশাক, নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং খাদ্য দ্রব্যাদি, ঘরবাড়িসহ ব্যবহৃত যে কোনো কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়। তবে পাশাপাশি আমাদেরকে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয় নিয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করা খুবই জরুরি। সঠিক মাত্রায় তাপমাত্রা বুঝে খাদ্য প্রস্তুত করা খুবই জরুরি। এই খাদ্যাভ্যাস থেকেই করোনা ভাইরাসের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল সম্প্রতি দেশগুলোয়। খাদ্যাভ্যাসসহ সঠিক তাপমাত্রায় রান্না না করলে শুধু করোনা নয় যে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া খাদ্যের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে আক্রান্ত করবেই। কিছু সংক্ষিপ্ত বিষয় শেষাংশে বর্ণনা করেছি।

বিশ্বব্যাপী এই করোনা ভাইরাস আমাদের দেশে বিস্তর আকারে ছড়ানোর আগে কিছু বিষয়ের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। সাধারণ জনগণের সতর্কতার জন্য করণীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকারও বেশকিছু ব্যবস্থা গ্রহণও করেছে। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব আকারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। এই ভাইরাস ছড়ানোর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো হচ্ছে- বিমানবন্দর, জল ও স্থলবন্দর যেখানে রয়েছে জনগণের দেশ-দেশান্তরে আশা-যাওয়া। বিশেষ করে বিমানবন্দর যা কি-না সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান। স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দিকে নজর দিয়ে সকল যাত্রীর জন্য মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস দেয়া উচিত সরকারি অথবা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে। যাতে তারা তা পরিধান করে যাতায়াত করেন। তাছাড়াও যাতায়াতের যানবাহন যেমন: বিমান, রেল, বাস, স্থল যানবাহন গুলোতে যাত্রী উঠানোর আগে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

পাশাপাশি আমরা সম্ভাব্য, আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দিকে নজর দিতে গিয়ে তাদের কথাও যাতে না ভুলে যাই যারা এ সব এভিয়েশন, হোটেল ও ট্যুরিজম সেক্টরগুলোতে কর্মরত আছেন। আমারই সহপাঠী ও কিছু পূর্ব-সহকর্মীর সঙ্গে আলাপকালে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কথা ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে যারা এভিয়েশন উড়োজাহাজ অভ্যন্তরীণ এবং বিমানবন্দর সেবায় নিযুক্ত আছেন। তারাই বলেছিলেন, ‘যাত্রীসেবা নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে করছেন, এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারলে ভালো হতো। যদি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ নিতেন’, কিছুদিন আগে বিশ্বসংবাদে প্রকাশিত হয়েছে কিছু চিকিৎসক যারা করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবায় নিযুক্ত ছিলেন তারাও আক্রান্ত হয়েছেন। সুতরাং সেবাদানকারী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এবার আসি আমাদের সকলের মধ্যে হাইজিন এবং খাদ্য নিরাপত্তা কতটা জরুরি এবং এ সব থেকে প্রতিকারের করণীয় প্রসঙ্গে। হাইজিন বলতে আমরা শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নয়, অনুশীলনগুলোকে নিয়মিত আকারে পালন করাকে বোঝায়।

প্রথমত, পারসোনাল হাইজিন নিজেকে সুস্থ্য রাখার প্রথম ধাপ। শুধু তাই নয়, রান্নার ক্ষেত্রেও পারসোনাল হাইজিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, কোনো ব্যক্তির ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া খাদ্যের মাধ্যমে অন্যকে ছড়িয়ে দিতে পারে যা প্রথমেই উল্লেখ করে এসেছি।

দ্বিতীয়ত, বসবাসের স্থান, ঘর, রান্নাঘর এসব স্থানে সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই জরুরি, পাশাপাশি মেঝে, ঘরবাড়ি খাদ্যের পাত্র, হাঁড়ি পাতিল, চামচ, গ্লাস ইত্যাদি ধুয়ে শুকনা রাখতে হবে। নিয়মিত পেস্ট কন্ট্রোল ঢেকে ঘরবাড়ি পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ইঁদুর, তেলাপোকা মুক্ত রাখতে হবে। কেননা এ সমস্ত পেস্ট-এর মাধ্যমে বিভিন্ন ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়।

তৃতীয়ত, খাদ্য নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটা উপরে আলোচিত বিষয়গুলোতে পরিচ্ছন্নতা উঠে এসেছে, ঠিক তেমনি খাদ্য নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলেছি সঠিক তাপমাত্রায় খাদ্য রান্না করতে হবে। তাছাড়া শুকনা খাবারগুলো ঠাণ্ডা পরিচ্ছন্ন এবং শুকনা স্থানে রাখতে হবে। যে সকল খাবার ফ্রিজে রাখা হবে তা যেন অবশ্যই ৫° ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকে এবং পুনরায় গরম অবশ্যই ৬০° সেলসিয়াসের উপরে করতে হবে। যে কোনো কাঁচা খাবার ভালো করে সিদ্ধ করতে হবে কেননা যে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ৯০° থেকে ১০০° সেলসিয়াসে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

যে ব্যক্তি খাদ্য পরিবেশন করবেন, রান্না করা খাবার খালি হাতে ধরা থেকে বিরত থাকতে হবে, পাশাপাশি নিজেকে হাইজিন হতে হবে। অবশ্যই রান্নার সময় চুল ক্যাপ দ্বারা ঢাকতে হবে, কেননা মাথার চুলেও অনেক ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া আটকে থাকে। খাদ্য দ্রব্যাদি খাদ্য পরিবেশনের পূর্বে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়া উত্তম। নিম্নলিখিত কিছু বিষয় জেনে রাখা খুবই জরুরি।

যেমন: ১। খাবার পরিবেশনের সময় অবশ্যই ৬৩° সেলসিয়াস বা তার ঊর্ধ্বে রাখতে হবে, কেননা এই তাপমাত্রায় কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া খাদ্য স্পর্শ করতে পারে না।
২। যেহেতু করোনা ভাইরাসের প্রতিকারের অন্যতম নির্দেশনা হচ্ছে ঠাণ্ডা খাবার থেকো বিরত থাকা।
৩। প্রতিদিন কুসুম গরম পানি পান করা উত্তম অন্তত ৮ থেকে ১২ গ্লাস।
৪। সাইট্রিক এসিডযুক্ত ফল, ভিটামিনযুক্ত সবজি খাওয়ার চেষ্টা করুন যেমন- লেবু, কাঁচা মরিচ, কমলা, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি।
৫। একই পাত্রে খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৬। ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া কেউ আক্রান্ত হলে অবশ্যই বেশি করে ভিটামিন-সি ফল, সবুজ শাকসবজি, পেঁপের জুস, জিংক জাতীয় খাদ্যগ্রহণ করতে হবে, সঙ্গে প্রোটিন যেমন: ডিম, দুধ ইত্যাদি।
৭। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তের প্লেটলেট বাড়ানোর জন্য ওষুধ অথবা সাপ্লিমেন্ট সেবন করবেন, সেইসঙ্গে খাদ্য তালিকা নিয়ে নেবেন।
সকলের সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।


লেখক: হাইজিন, খাদ্য নিরাপত্তা ও HACCP সনদপ্রাপ্ত
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status