প্রথম পাতা

পি কে হালদারদের নেয়া ১৫৯৬ কোটি টাকার হদিস মিলছে না

স্টাফ রিপোর্টার

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বুধবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিকল্পনা (স্কিম) ছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডকে টিকিয়ে রাখা দুরূহ বলে মনে করেন খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। সর্বোচ্চ আদালতের ডাকে কোম্পানিটির সার্বিক অবস্থা জানাতে এসে আদালতের নির্দেশে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ এ অভিমত  দেন। তবে বাংলাদেশের ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, যদি কোম্পানিটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিলোপ, অপসারণ, নতুন নিয়োগ বা পুনর্গঠন করা হয়, তাহলে কোম্পানিটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব। গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে তিন বিচারকের আপিল বেঞ্চে এমন অভিমত দেন তারা।
আদালতে খন্দকার ইব্রহীম খালেদ বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটড খুব ভালমতই চলছিল। ২০১৬ সাল থেকে এর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এর পেছনে ‘কি পারসন’ (মূখ্য ব্যক্তি) হিসেবে কাজ করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। তার সঙ্গে আরো অনেকেই রয়েছে। এরা একসঙ্গে অনেক শেয়ার কিনে কোম্পানিটির আগের নেতৃত্বকে বের করে দিয়েছেন। পিকে হালদারসহ কিছু ব্যক্তি এই কোম্পানি থেকে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তা লেখা আছে। তলিয়ে দেখতে অনুমতি দেয়া হয়নি। সর্বশেষ কোন ব্যক্তি পর্যন্ত এই টাকা পৌঁছাল তাও অজানা। এই টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। টাকা কোথায় আছে সেটা আনট্রেসেবল। এই টাকা দেশেও থাকতে পারে, দেশের বাইরেও যেতে পারে। তবে এই টাকা উদ্ধার করতে রিকোভারি এজেন্ট নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের এজেন্ট দিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই ডেপুটি গর্ভনর বলেন, পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করা হয়েছে। এখন যদি একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডকেও অবসায়ন করা হয়, তাহলে আর্থিক খাতে ধ্বস নামতে পারে। আবার এ অবস্থায় এটাকে কতটা দাঁড় করানো যাবে, সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। আমি সাহস পাচ্ছি না। আমি তো এই কোম্পানির কোনো শেয়ারহোল্ডার নই। হাইকোর্টের আদেশে আমাকে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান করা হয়েছে। বাইরে থেকে এসে আমি এটাকে কতটা দাঁড় করাতে পারবো! শর্ষের মাঝে ভূত থাকলে আমি কি করতে পারি! তখন প্রধান বিচারপতি কোম্পানিটির আমানতকারীদের অবস্থা জানতে চাইলে ইব্রাহীম খালেদ বলেন, টাকা তো নাই। তারা চাইলেও টাকা ফেরত দেয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম  আদালতকে বলেন, এই (ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটড) কোম্পানিটির মূলধনে ৪৫০ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংক ঋণ আছে ৯৫৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সর্বমোট ঋণ হচ্ছে ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা।  বাংলাদেশ ব্যাংক এই পরিস্থিতিতে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, প্রধান বিচারপতি তা জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা দিয়েছি। কখনো কখনো বাস্তবায়ন করেছে কখনো কখনো বাস্তবায়ন করেনি। বিধিবহির্ভূতভাবে টাকা নিয়ে যাওয়ায় মূলধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনানশিয়াল ইনটিলিজেন্স ইউনিট বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমাও দিয়েছি। মোট ৪৮টি ঋণ হিসাবের সাথে ১২টি প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় ব্যক্তির বিপরীতে মোট ১৫৯৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এই ৪৮টি ঋণ হিসাবের লেনদেন ভাউচার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সুবিধাভোগী কারা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ কর্মকর্তা বলেন, নতুন নিযুক্ত স্বাধীন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কোম্পানিটি পুনর্গঠন করা সম্ভব বলে মনে করছি। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা দেখলাম একজনই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। আপনাদের হিসাব কি শুভঙ্করের ফাঁকি? নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, পিকে হালদারসহ অন্যান্যরা এই কোম্পানি থেকেই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আমরা পাইনি। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছে, আদালত জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা তাদের ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছি, শোকজ করেছি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, কিছু লোক কিছু লেখাপড়া শিখে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য। এরা হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল। এদের কাজই হচ্ছে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেয়া। পিকে হালদার কিভাবে চলে গেল সেটা আপনাদের (আদালতের) দেখা উচিৎ। কোম্পানি চলবে কি চলবে না, সে বিষয়ে আপনারা সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, আগে তো ব্যাংক ছিল না। মানুষ গোলায় ধান রাখত। এটাই ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির বৈশিষ্ট। কিন্তু মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখে। এখন অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুটের জন্য। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, পিকে হালদার কিভাবে পালালো সেটা আপনাদের দেখা উচিৎ। কোর্ট কি চোখ বন্ধ করে থাকবে? দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছে। কোর্টের আদেশ যদি স্থগিত করা হয় তাহলে যারা কোম্পানিটিকে ডুবিয়েছে তারাই লাভবান হবে। হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছে এর চেয়ে ভাল আদেশ হতে পারে না।  
হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের আবেদনকারী দুই কর্মকর্তার আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, এখানে (শুনানিতে)কোম্পানি অবসায়নের কথা এসেছে। কোম্পানি যদি ভেঙে যায় তাহলে কিছু থাকবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও বলেছে কোম্পানি পুনর্গঠনের কথা। অবসায়ন হয়ে গেলে আর ব্যবসা থাকবে না। অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও চাচ্ছে যে কোনোভাবে কোম্পানিটকে বাঁচাতে হবে। এ আইনজীবী আদালতকে বলেন, তারা ভাল মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংকও বলেছে কিছু ভাল পরিচালক আছেন। ভাল মানুষ স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে টিকতে পারবে না। পিকে হালদারকে যে শাস্তি দেন, দিন। আমাদের আপত্তি নাই। পিকে হালদারসহ জড়িতদের আমিও শাস্তি চাই। কিন্তু এদের জন্য যদি আমাদের মরতে হয় তাহলে ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার মক্কেলদের পাসপোর্ট জব্দ করে রাখা হয়েছে, তাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের তো ব্যবসা আছে। তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে। মাঝামাঝি কোনো পথ নেই, হয় কোম্পানিকে অবসায়ন করতে হবে, নয় কোম্পানিকে জীবীত রাখতে হবে।        
গত ১৯ জানুয়ারি এক আদেশে ইব্রাহিম খালেদকে আইএলএফএসএল-এর স্বাধীন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান চেয়ারম্যান, এমডি, বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারসহ ১৩ পরিচালকের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ, সকল সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের মা, স্ত্রী, ভাইসহ ২০ জনের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ, সকল সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া এই ২০ জনের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় এবং তাদের গত ৫ বছরের আয়কর রিটার্ন হাইকোর্টে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই আদেশ স্থগিত চেয়ে আইএলএফএসএল-এর দুইজন পরিচালক আপিল বিভাগে আবেদন করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status