শেষের পাতা

করোনায় বাড়ছে আদা রসুনের দাম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:২৮ পূর্বাহ্ন

চীনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের নিত্যপণ্যের   বাজার। বিশেষ করে চীন নির্ভর আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। পিয়াজের অস্থিরতা না কমতেই রসুনের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আদাসহ মসলাজাতীয় পণ্যের দাম।
এদিকে মাস দুয়েক পরই শুরু হচ্ছে রমজান মাস। ওই মাসে সাধারণত প্রতি বছরই বেশ কয়েকটি পণ্য চড়া দামে বিক্রি হয়। বিশেষ করে পিয়াজ, বেগুন, ছোলা, ভোজ্যতেল, ডাল, খেজুর, চিনি ও আদার দাম বাড়ে। তৈরি হয় সঙ্কট। করোনা ভাইরাস এর কারণে পুরো বিশ্বের চীন নির্ভর পন্যের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রমজান সামনে রেখে দেশীয় বাজারে এর প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের দাবি, চীনে করোনা ভাইরাস দেখা দেয়ার পর রসুন ও আদা আমদানি বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে দাম বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রসুন আমদানিতে চীনের ওপর নির্ভরতা কাটানো কঠিন। রসুন আমদানির ৯৬% আসে চীন থেকে। তবে চীনের বাইরে ভারত ও মিয়ানমার থেকেও আমদানি হচ্ছে। যা চাহিদার তুলনায় কম। তবে চীনে করোনা ভাইরাসের অজুহাত দেখিয়ে আমদানিকারকরা বাজারে রসুনসহ কয়েকটি ভোগ্যপণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে তৈরি হয়েছে সরবরাহ সঙ্কট। বাজারে নতুন দেশি রসুন এবং আমদানি করা চীনা রসুনের সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছে। এতে নিম্নআয়ের মানুষদের ওপর চাপ বাড়ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে এখন রসুনের দাম ১৫০ থেকে ২১০ টাকা কেজি। এক মাস আগে তা ছিল ১৩০ থেকে ১৮০ টাকা। টিসিবির দর অনুযায়ী, বাজারে এখন এক কেজি আদার দাম ১০০ থেকে ১৮০ টাকা, যা এক মাস আগে ১০০ থেকে ১৬০ টাকা ছিল।
খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। দেশি নতুন রসুন পাওয়া যাচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিদরে। দেশি আদা ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হলেও চীনা আদা করেছে ডবল সেঞ্চুরি ২০০ টাকা।
ঢাকার কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা। খুচরা বাজারে বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা।
বিক্রেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে দাম আরো বাড়বে। দেশের রসুনের বাজার পুরোটাই চীননির্ভর। চীনা রসুনের মান ভালো হওয়ায় এটির চাহিদাও বেশি। দেশে কিছু রসুন উৎপাদন হলেও চাহিদার বড় একটি অংশের জোগান দিতে হয় চীন থেকে আমদানির মাধ্যমে। করোনা ভাইরাসের কারণে চীনে শিপমেন্ট বন্ধ। যারা আগে এলসি খুলেছিলেন, তাদের চালানও আসছে না। নতুন করে কেউ এলসিও খুলতে পারছেন না।
পুরান ঢাকার শ্যামবাজার মসলা পণ্যের আমদানিকারক আবদুল মাজেদ বলেন, মানুষ বড় আকারের চীনা রসুন কিনতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফলে এর চাহিদা থাকবেই। তবে এক মাস পর থেকে ভারতীয় রসুন আমদানি শুরু হবে। সেখানে নতুন মৌসুম শুরু হবে। এদিকে দেশীয় নতুন মৌসুমের রসুনও উঠতে শুরু করেছে। তখন দাম কমবে বলে জানান তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, দেশে সমুদ্রপথে আমদানি হওয়া রসুন শতভাগই আসে চীন থেকে। গত অর্থবছরে চীন থেকে ৬৪ হাজার ৭৯৬ টন রসুন আমদানি হয়। রসুনের মতো আদার ৬০ শতাংশই আমদানি হয় চীন থেকে। গত সেপ্টেম্বরে ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় চীন থেকে একটি বড় অংশ আমদানি করা হয়। কিন্তু ভাইরাসের প্রভাবে সেখানেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এতে সরবরাহ সঙ্কটে রসুনের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে সঙ্কট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে দামও।
ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন আমদানিকারকদের কারসাজিকে। তাদের অভিযোগ, আমদানিকারকরা করোনা ভাইরাসের অজুহাতে বাড়তি লাভের আশায় বাজারে চীনা রসুন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের প্রশ্ন, চীন থেকে জাহাজে পণ্য তুললে তা দেশে আসতে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগে। আগে যেসব রসুন দেশে এসেছে, সেগুলো কোথায় গেল?
সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে রসুন ও আদার চাহিদা ও  আমদানির পরিমাণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বছরে রসুনের চাহিদা প্রায় ৬ লাখ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রসুন উৎপাদিত হয়েছে ৬ লাখ ১৩ হাজার টন। সেখান থেকে পচে যাওয়া রসুনের হিসাব বাদ দিয়ে প্রকৃত উৎপাদন ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২২ হাজার টন। রসুনের চাহিদার ১৩ থেকে ২০ শতাংশ আমদানি করতে হয় বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন। অন্যদিকে আদার চাহিদা বছরে প্রায় ৩ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৯২ হাজার টন। পচে যাওয়া বাদ দিয়ে উৎপাদন ধরা হয় ১ লাখ ৭৩ হাজার টনের মতো। তাতে মোট চাহিদার ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে মোট ৫২ হাজার ৪৬১ টন রসুন আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশই এসেছে চীন থেকে। আর একই সময়ে আদা আমদানি হয়েছে মোট ৬৯ হাজার ৪৮১ টন। মোট আমদানির ৪১ শতাংশ চীন, ২৮ শতাংশ ভারত ও ২১ শতাংশ মিয়ানমার থেকে এসেছে।
বাজারে পিয়াজের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা কমে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। মিয়ানমারের আদার দাম কমে ১৩০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে।
টিসিবির হিসাবে, এক বছর আগের তুলনায় এখন আদার দাম ২৭ শতাংশ ও রসুনের দাম ১৭৭ শতাংশ বেশি। সবার চেয়ে এগিয়ে পিয়াজ, এক বছর আগের তুলনায় দাম বেশি ৩২২ শতাংশ।
ওদিকে নতুন করে দাম বেড়েছে চিনিগুঁড়া চালের। পাইকারি বাজারেই প্রতি কেজি চিনিগুঁড়া চাল ৯০ থেকে ৯২ টাকা। খুচরা বাজারে দর ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি। দুই মাসে বাড়তি কেজিপ্রতি ১২ টাকার মতো। আর সরু চালের কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা নিচে।
বাজারে মান ভেদে ছোলার কেজি ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। মশুর ডাল কেজিপ্রতি দাম ৬৫ থেকে ১২ টাকা। সয়াবিন তেল এক লিটার (বোতল) ১০০ থেকে ১১০ টাকা। খেজুর প্রতিকেজি ২৫০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। চিনি প্রতিকেজি ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা।
এদিকে বাজারে সবজির দাম কমছে না। প্রতি কেজি ঢেঁড়সের দাম এখন ১২০ থেকে ১৮০ টাকা। একেকটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি করলা। বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ১০০ টাকা কেজিদরে। এক কেজি কচুর লতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানায়, ২০১৯ সালে ১৮টি সবজির গড় দাম বেড়েছে ৮ শতাংশের কিছু বেশি। বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে।
মালিবাগের বাসিন্দা আতিক বলেন, শীতের ভরা মৌসুমে সবজির এতো দাম আগে দেখিনি। বরাবরের মতো এবারও শীতের শুরু থেকেই বাজারে ভরপুর সবজি আসছে, কিন্তু দাম কমেছে না। বাজারে কার্যকর তদারকি না থাকাতেই সবকিছুর দাম এমন চড়া।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status