শেষের পাতা

টকশোঃ ভেতরে-বাইরে

কাজল ঘোষ

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, রবিবার, ৮:৫৪ পূর্বাহ্ন

টকশো। নামের মধ্যেই ‘টক’ যুক্ত। কিন্তু আদতে এখন যে ধরনের টকশো হচ্ছে তার মধ্যে টক কতটুকু আর মিষ্টি কতটুকু? প্রশ্নটি সকলের উদ্দেশ্যে। নিজে একজন টক শো প্রযোজক। কাজ করছি দুই দশক ধরে। রাজনীতি ও সময়ের টানাপড়েনে টকশো বরাবরই তীরবিদ্ধ। সময়ের প্রয়োজনে বা দরকারে বিরোধী পক্ষ হয়ে ওঠেছে আপন। আবার সরকারের খাস লোককেও সময় বদলে না চেনার ভান করেছি। লাইনটুকু পুরোটাই ব্যক্তিগত। অতিথিরাও বোল পাল্টে ফেলেন কখনও প্রতিপক্ষ মাথায় রেখে; কখনও প্রতিষ্ঠান মাথায় রেখে। বিএনপি জমানায় যারা টেলিভিশনে জামাই আদর পেতেন তারাই দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে অচেনা তালিকাভূক্ত। ফের আওয়ামী জমানার বদলে আগের তালিকার সকলেই আদরণীয়। ভিন্ন সময়ও আছে ‘ওয়ান ইলেভেন’। এই দু বছর টক শো নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে প্রথম একবছর বেশিরভাগ আলোচক বিরাজনীতিকরণ, জাতীয় নিরাপত্তা, দুর্নীতি আর সুশাসনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। দ্বিতীয় বছর সকলেই ফের গণতন্ত্র চাই, মত প্রকাশ চাই, রাজনীতির প্রকাশ্য চর্চা চাই বলে ফেনা তুলেছেন। দিনশেষে দর্শকরাই আসল বিচারক। টিভি পর্দায় কথা শুনেই এরা বলে দেন, দালালি আর কত করবেন? অথবা টেলিভিশনে টক শো চলাকালে ফোন করে অমুক ভাল বলেছে বা এইসব দালালদের আপনারা আনেন কেন বলে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

বিকল্প পার্লামেন্ট ‘তৃতীয় মাত্রা’: টক শো নিয়ে কথা বলতে গেলেই যে নামটি জ্বলজ্বল করে তা হলো ‘তৃতীয় মাত্রা’। চ্যানেল আইয়ের পর্দায় নিয়মিত এই আয়োজন দেশের ইতিহাসে সকল টক শো’র ব্যাপ্তিকে হার মানিয়েছে। ২০০৩ সালের ৭ই জুলাই শুরু হওয়া জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনা ও পরিচালনায় ‘তৃতীয় মাত্রা’ ইতিমধ্যেই পাঁচ হাজারের অধিক পর্ব প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশ সময় প্রায় মধ্যরাতে প্রচারিত এই টক শোতে অধিকাংশ পর্বেই দুটি বড় রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিত্বরা অংশ নিয়ে থাকেন। দু’দলের নেতাদের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রচারিত হওয়ায় একে অনেকেই বিতর্ক পার্লামেন্টও বলে থাকেন। বিশেষত দিনের পর দিন দেশে যখন পার্লামেন্ট অচল তখন তৃতীয় মাত্রাই ছিল এর বিকল্প। তৃতীয় মাত্রায় সকল দলের নেতাদের উন্মুক্ত আলোচনায় এক টেবিলে বসা সত্যিই বিরল। চলমান যে কোন রাজনৈতিক ইস্যুতে বিস্তৃত আলোচনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তৃতীয় মাত্রার মাধ্যমেই। ডয়েচে ভেলের জরিপে বিশ্বের সাতটি টকশোর একটি নির্বাচিত হয় তৃতীয় মাত্রা।

প্রসঙ্গ মধ্যরাতের টকশো: নিজ অভিজ্ঞতার কথাই বলবো এই পর্বে। শুরুটা ছিল একেবারেই বিপরীত। প্রথম দিনগুলো অনেকের কাছেই এখনও বিস্ময়ের। রাতের প্রথম প্রহরে পত্রিকা নিয়ে আয়োজন দর্শক কীভাবে নেবে? আজকে টেলিভিশনে নব চাপলেই দেশের বিশটিরও অধিক টিভি পর্দায় কথা বলছেন এই আপনারাই। কথা বলছেন দেশ নিয়ে, সরকার নিয়ে, চলমান নানা সংকট নিয়ে। কিন্তু এই যাত্রা সব সময় মসৃণ এমনটি কখনোই নয়। কি সামরিক জমানা; কি গণতান্ত্রিক জমানা- শাসকদের কড়া নজরদারি আর খবরদারি এই অনুষ্ঠানকে নিয়ে যতখানি তা অন্য কোনো আয়োজনে আছে বলে জানা নেই। এক অন্তহীন চাপের মধ্য দিয়ে; নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এই আয়োজনের ধারাবাহিকতা রাখতে হয়েছে। এর কৃতিত্ব শতভাগ অনুষ্ঠান আয়োজক ও রূপকার চ্যানেল আইয়ের। বিশেষত চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও পরিচালক বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ প্রতিমুহূর্তেই ছায়ার মতো অনুষ্ঠানের সকল সংকটে পাশে দাঁড়িয়ে ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে উতরেছেন। দুনিয়াজুড়ে কোটি দর্শকের প্রত্যাশা ও নানা মহলের খবরদারিতেও নৈর্ব্যক্তিকতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির মঞ্চে থেকে অনুষ্ঠানের কান্ডারির ভূমিকায় আছেন মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে অমুককে আনা যাবে, অমুককে না আনলে ভালো হয়, স্বাক্ষরবিহীন গাইডলাইন, অনুষ্ঠান চলাকালেই পছন্দসই কথা প্রচারে নানান চাপ- এমন হাজারো ঘটনা যা লিখে শেষ করা যাবে না। অনুষ্ঠানশেষে অতিথিদের ফোনে হুমকি, বিরূপ মন্তব্য, কটুবাক্য বর্ষণ এটা অতি সাধারণ ঘটনা। সেনা-সমর্থিত সরকারের সময় উপস্থাপক, অতিথিদের গাড়ি অনুসরণ করা, বেনামি ফোনে অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়ার অনুরোধ- উপরোধ-হুমকি তো ছিলই। তা আজও আছে, তবে অন্য মোড়কে। এমন অগুনতি প্রশ্ন ছাপিয়ে ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানটির সূচনা ২০০৫-এর ৬ই আগস্ট। যা ছিল রাতের দর্শক জাগানিয়া আয়োজনের প্রথম পেরেক। রাতের প্রথম প্রহরে শুরু হওয়া এ জাতীয় অনুষ্ঠানের পাইওনিয়ার। এ-অনুষ্ঠান শুরুর পর থেকেই অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলে নানা মাত্রার সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠানের সূচনা।

সমাজ পরিবর্তনে টকশো’র ভূমিকা: একটা সময় সকালের পত্রিকা আর সন্ধ্যার বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকাই ছিল আপামর মানুষের ভরসা। কিন্তু দিন বদলেছে। এখন মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় রাতের টকশোতে কোন পত্রিকায় এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণ ছাপা হলো তার বিস্তারিত কিভাবে জানা যাবে তার খোঁজে। দুই দশকের বেসরকারি টেলিভিশনের ইতিহাসে এই পরিবর্তন ও সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে টকশোগুলোই। টকশো’র এই পরিবর্তনের ধারা দু’ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়- একটি সমাজিক, অন্যটি জাতীয় জীবনে। সামাজিক পরিবর্তন বিশেষত জনগণ সরাসরি সম্পৃক্ত এমন ইস্যু। দ্রব্যমূল্য, যানজট, জলাবদ্ধতা, বিলবোর্ড, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, কৃষিপণ্য, নিরাপত্তা- এসব বিষয়ে টকশোতে একযোগে আলোচনা করে অনেক সুফলও এসেছে। স্থানীয় উন্নয়নে সরকারি ব্যর্থতা বরাবরই মিডিয়ায় আলোচনায় আসায় জনপ্রতিনিধিরা বাধ্য হয়ে তা পরিবর্তন করেন। যখন যে দলই সরকারে থাকে না কেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় আর তার ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করে টকশো। বাংলাদেশের পরিবর্তিত বাস্তবতায় বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ বরাবরই তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার এজেন্ডা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তাদের কাছে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যু বেশিরভাগ সময়ই অবহেলিত। আর টকশোতে আসা আলোচকরা নৈতিকতা বিবেচনায় জাতীয় পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় সব ইস্যু নিয়েই কথা বলেন, প্রতিবাদে সোচ্চার হন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় খাতে দুর্নীতি, লুটপাট, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের বিশ্লেষণ সর্বোপরি সুশাসন। দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার পরিধি বেড়েছে; বেড়েছে পত্রপত্রিকানির্ভর আয়োজনও। মানুষের মধ্যে বেড়েছে রাজনৈতিক সচেতনতা। একসময় যেখানে রাজধানীতে কোন ঘটনা ঘটলে তা ঢাকার বাইরের মানুষ জানতো দু’দিন পর। সেখানে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কল্যাণে মানুষ সেকেন্ডেই তা জেনে যাচ্ছে। কোন টকশোতে কোন আলোচক কি বলছেন- তা ভুল না সঠিক বা সেই আলোচকের রাজনৈতিক মতাদর্শগত অবস্থান কি তা নিয়েও বিস্তৃত আলোচনা হচ্ছে। আলোচিত ইস্যুগুলো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতেও নাগরিকরা নিজস্ব মতামত তুলে ধরছেন। বর্তমান সরকারের সময় র‌্যাবের গুলিতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া লিমন ইস্যু, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, ফেনীর নুসরাত হত্যা, নির্বাচনে জালিয়াতি ব্যাপক আলোচনায় এসেছে টকশো’র কারণেই। যেখানে রাজনীতি দিশা হারিয়েছে অথবা বলা যায়, স্থবির হয়ে আছে। সেখানে টক-শোই হয়ে দাঁড়িয়েছে জবাবদিহির শক্তিশালী মাধ্যম। টক-শোতে আলোচিত বিষয়গুলো সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে প্রতিবাদের নতুন ভাষারূপে হাজির হচ্ছে বর্তমানে।

শুধু তাই নয়, গত তিন দশক বিবেচনায় নিলে আমাদের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা তাদের অপকর্ম বা দুর্নীতির জন্য কোন জবাবদিহিতা করতেন না তাদের মেয়াদকালে। মিডিয়ায় আলোচনা হওয়ায় পরিস্থিতি বদলেছে। ওয়ান-ইলেভেনের শুরুতে টকশোতে সেনাসমর্থিত সরকারের সংস্কার প্রস্তাবকে প্রথম দিকে সমর্থন দেয়া হলেও তাদের নানা অগণতান্ত্রিক চরিত্র প্রকাশিত হলে মিডিয়া সব ঝুঁকি নিয়ে; টকশো’র আলোচকরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেছেন শেষ পর্যন্ত। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০০৮ সালের একুশে আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। সেই টালমাটাল পরিস্থিতিতেও, কারফিউর মধ্যেও টকশোতে আলোচকরা বন্দুকের নলের মুখেও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সেনাসমর্থিত সরকারের সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে প্রয়াত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, আতাউস সামাদ এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা এক যুক্ত বিবৃতিতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সময়েও মিডিয়ার চাপেই পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে প্রভাবশালী দুই ক্ষমতাধর ব্যক্তি উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ অবস্থাও ইতিবাচকতারই ইঙ্গিত বহন করে। আর এ ইতিবাচক পরিবর্তনে টকশো ছায়ার মতো প্রতিটি ইস্যু নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কথা বলেছে। এ অংশটি শেষ করতে চাই, বর্তমান সরকারের আগের জমানার একটি জরিপের ফলাফল দিয়ে। চলতি টার্মের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর সরকারের করা এক জরিপে বলা হয়েছিল, তাদের পরাজয়ে যে কারণগুলো দায়ী তার মধ্যে টকশোও একটি।

কাঠগড়ায় টকশো: 'I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it' -Voltaire (১৬৯৪-১৭৭৮)।
মহামতি ভলতেয়ার সতেরো শতকেই বিরুদ্ধপক্ষের বক্তব্য প্রকাশে প্রয়োজনে জীবন দেয়ার কথা বলেছিলেন। অথচ একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমাদের নেতৃত্ব প্রতিদিনই কথা বলছেন, মুখে অহোরাত্র ফেনা তুলছেন, তাঁরা ভলতেয়ারের এই সহজ কথাটির মর্মার্থ এখনও অনুধাবন করতে পারেননি। গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তম্ভ বা থার্ড আই যে-নামেই মিডিয়াকে আখ্যায়িত করা হোক না কেন সামরিক জমানার চেয়ে গণতান্ত্রিক জমানায় মিডিয়ার অবস্থা যে খুব একটা উন্নত হয়েছে তা হলফ করে বলা যায় না। বাস্তবতা হচ্ছে- সামরিক জমানায় বুটের তলায় মিডিয়াকে পদদলিত করার চেষ্টা হয়েছে। কোনটি বলা যাবে কোনটি বলা যাবে না তার সেন্সরশিপ আরোপ হয়েছে। স্বাক্ষরবিহীন গাইডলাইন পাঠানো হয়েছে। পছন্দের তালিকা পকেটে পুরে দেয়া হয়েছে। আর এখন সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী-নেতারা পর্যন্ত যাঁরা টকশোতে আসেন, সরকারের নেয়া পদক্ষেপের যৌক্তিক সমালোচনা করে তাঁদের তুলোধুনো করছেন। পরোক্ষভাবে চলছে নানা গোয়েন্দা খবরদারি।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে টকশোতে কথা বলায় জাতীয় সাংবাদিকতুল্য প্রয়াত এবিএম মূসাকে শামীম ওসমান প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, দুই ঠ্যাং কবরে যাওয়া বুড়ো মূসাও ওনার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারকে ইঙ্গিত করে বলা হলো, গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর পাশে আমার ছবি দেখে তারা হতাশ হয়েছে। ভেবেছে শামীম ওসমান শেষ হয়ে গেছে। মিডিয়া আমাকে সন্ত্রাসী বানাবার চেষ্টা করেছে। মিডিয়ার আলোচনা যে কতটা গাত্রদাহ তৈরি করে তা অন্যদের কথাতেও খোলামেলাভাবেই এসেছে। সরকার প্রধানও বহু হাত নিয়েছেন টকশোর আলোচক, আয়োজকদের। তিনি খোলামেলাভাবেই বলেছেন, আগে আমরা জানতাম মধ্যরাতে সিঁধ কাটতে যায়। আর এখন টকশোতে যায় আমাদের মাথা কাটতে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক টকশো’র আলোচকদের জ্ঞানপাপী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর সাবেক নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানতো টকশোতে উত্তেজিত হয়ে হাতাহাতি করতে উপক্রম হয়েছিলেন। বিপক্ষের আলোচককে, ‘এই ব্যাটা চুপ জুতাপেটা করব, চোখ উপড়ে ফেলব’ বলে তেড়ে গিয়েছেন। তবুও রক্ষা এই যে, জর্ডানের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখানে হয় নি। জর্ডানে টকশোতে সরকারদলীয় মন্ত্রী উত্তেজিত হয়ে বিপক্ষের আলোচকের দিকে পিস্তল নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন।
সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু টকশো নিয়ে একচোখা নীতির কোনো পরিবর্তন নেই। বর্তমান সরকারও গত টার্মে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই টকশো নিয়ে নীতিমালা করার কাজটিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। নীতিমালা প্রণয়নে কমিটিও করেছিলেন। যে-কোনো বিষয়ে অতিরঞ্জিত করা বা বাড়িয়ে বলা বা অযৌক্তিকভাবে সরকারের সমালোচনা করা অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু যদি হয় যৌক্তিক সমালোচনা, তাহলে?

বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। দেশে যখন গণতান্ত্রিক সরকার থাকে তখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে এটা হলফ করে বলা যায়। রাজনৈতিক সরকারগুলো সবকিছুই রাজনৈতিক দৃষ্টি নিয়ে দেখবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সামগ্রিক চিত্র অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক সরকারের চেয়ে অনেক সুস্থ থাকে। নব্বইয়ের পটপরিবর্তনের পর গণতান্ত্রিক আমলের নয়া সংস্করণ দেখছি আমরা। খালেদা-হাসিনা। আবার হাসিনা-খালেদা। এখন চলছে হাসিনাযুগ। কথা হচ্ছে যখন যিনি ক্ষমতায়- মিডিয়া যেন তাঁর চিরশত্রু। আর বিরোধী দলে থাকলে মিডিয়া পরম বন্ধু। আমাদের নেতানেত্রীরা ভুলে যান শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মিডিয়াই এগিয়ে এসেছে। বন্দুকের নলের মুখে মিডিয়াকর্মীরাই, টকশোর আলোচকরাই মৌলিক অধিকার, মানুষের ভোটাধিকার আর ন্যায়বিচারের প্রশ্নে সোচ্চার হয়েছেন। ওয়ান ইলেভেনে যখন বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা কেউ জেলে, কেউ আত্মসমর্পণে, কেউ পালাচ্ছেন তখন মিডিয়াই আগলে ধরেছে গণতান্ত্রিক লড়াইকে। মাইনাস টু কোনো সমাধান নয়- এ-আওয়াজ মিডিয়াই তুলেছে। টকশোতে স্পষ্ট কথা বলে সামরিক ও গণতান্ত্রিক দু আমলেই বিরাগভাজন হয়েছেন অনেক আলোচক।

আলোচনায় থাকা বেশকিছু টক শো: চ্যানেল আইয়ের নিয়মিত আয়োজন তৃতীয় মাত্রা, আজকের সংবাদপত্র, ৩০০ সেকেন্ড ছাড়াও অন্যান্য টেলিভিশনের বেশকিছু আয়োজনও সাড়া ফেলেছে। বাংলাভিশনে ২০১০-এর নভেম্বরে শুরু হওয়া মতিউর রহমান চৌধুরীর উপস্থাপনায় ‘ফ্রন্টলাইন’ জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু পাঁচ বছর চলার পর আচমকা বন্ধ হয়ে যায়। এর বাইরে বাংলাভিশনের নিয়মিত আয়োজন ‘নিউজ ভিউজ’ দর্শকপ্রিয়তা পায়। শুরুর দিকে এর উপস্থাপনায় ছিলেন সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ। একাত্তর টিভির নিয়মিত আয়োজন ‘একাত্তর জার্নাল’। প্রতিদিনের সংবাদের বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা হয় এতে। মিথিলা ফারজানা ছাড়াও অনেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অনুষ্ঠানটির উপস্থাপনা করে থাকেন। ইনডিপেনডেন্ট টিভিতে প্রচারিত বিষয়টিভিত্তক টক শো ‘আজকের বাংলাদেশ’। শুরুতে উপস্থাপনা করতেন খালেদ মুহিউদ্দীন। ডিবিসি’র নিয়মিত আয়োজন ‘রাজকাহন’ প্রচারিত হয় রাত ১০টায়। এতেও রাজনীতির সামপ্রতিক ইস্যুগুলোই মূলত আলোচিত হয়। চ্যানেল ২৪-এর নিয়মিত আয়োজন ‘মুখোমুখি’। যমুনা টিভির ‘২৪ ঘণ্টা’ মূলত রাজনীতিকেন্দ্রিক। প্রথমদিকে এর উপস্থাপনায় ছিলেন কাজী জেসিন। বর্তমানে মীর আহসান এবং মাহফুজ মিশু অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক। নিউজ টোয়েন্টিফোর-এর টক শো ‘জনতন্ত্র গণতন্ত্র’ সঞ্চালনা করেন সামিয়া রহমান এবং রোবায়েত ফেরদৌস। আরটিভি’র রাজনৈতিক টক শো ‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন সৈয়দ আশিক রহমান।

সবশেষ: টকশো নিয়ে নানা আশঙ্কা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। এ-পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটুক আমরা সকলেই তা চাই। একসময় এরশাদ জমানায় সকাল-সন্ধ্যায় মানুষ চায়ের দোকানে বিবিসি বাংলা শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে ভিড় জমাত। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এখনও মানুষ ঘুম নষ্ট করে কী ঘটতে যাচ্ছে, দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, সংকটের উত্তরণ ঘটবে কীভাবে তা জানতে অপেক্ষায় থাকে- টকশো’র জন্য।

আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত টকশো কোনো না কোনোভাবে সরকারের তীক্ষ্ন নজরদারির কবলে পড়লেও পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার সাবেক স্পিকার শুনিয়েছেন অন্যরকম কথা। মিডিয়া প্রতিদিন যে- আলোচনামূলক অনুষ্ঠান করে তার মধ্যে বেশ কিছু বিচারাধীন বিষয় থাকে। বহু ছোট ছোট বিষয়কে মিডিয়া এমনভাবে হাইলাইট করে যে তা অনেক সময়ই বিচারপতিদেরও প্রভাবিত করে। এর ফলে বিচারপতিদের রায়ে তার প্রভাব দেখা যায়।

সরকার টকশোর আলোচকদের, সংবাদপত্রের কলামিস্টদের সহ্য করতে নারাজ। কখনো কখনো মিডিয়া বনাম সরকারের বাহাস ও লড়াই অস্বস্তিকর জায়গাতেও চলে যাচ্ছে। বিকল্প মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক নিয়েও সরকার নানান নির্দেশনা দিচ্ছে, সতর্ক করছে। সরকার যদি মিডিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে, সরকার ও মিডিয়ার মধ্যে লড়াই যদি বাড়তে থাকে তবে সরকারকেও তা সতর্ক করবে। অন্যদিকে মিডিয়ার বল্গাহীন অপসাংবাদিকতা করার প্রবণতা থাকলে তা রহিত হবে। প্রয়োজনে মিডিয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর, বাস্তবধর্মী নীতিমালা তৈরি হবে। অন্যদিকে সরকারের অযাচিত নাক গলানোর গলিপথ, চোরাপথ বন্ধ হবে। সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন দেশের যে কোনো সরকারকে যে কোনো অন্যায় কাজ করার আগে মিডিয়ার কথা ভাবতে হবে। কাজেই এই টাগ অফ ওয়ার বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সমাজে নতুন নীতি, আইন, নৈতিক মানদন্ড তৈরিতেই সহায়তা করবে। একজন টকশো প্রযোজক হিসেবে সেই সুদিনের অপেক্ষায়। শেষ করতে চাই স্যার উইনস্টন চার্চিলের কথা দিয়ে। তিনি বলেছেন, The best argument against democracy is a five minute conversation with the average voter.
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status