প্রথম পাতা

কাওরান বাজারের অপারেশন থিয়েটারে খবরের বেঁচে থাকার লড়াই

সাজেদুল হক

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শনিবার, ৭:৩৬ পূর্বাহ্ন

ভোট কেবল শেষ হয়েছে। বলে নেয়া ভালো, ৩০শে ডিসেম্বরের ভোট। পত্রিকায় তখনও নির্বাচনী বাতাস। কাওরান বাজারের অপারেশন থিয়েটারে কাটাছেঁড়া চলছে। অপারেশনের পর অপারেশন। নিজে নিজে সংবাদ চেপে যাওয়ার যুগ! কী যাবে? কী যাবে না? চিন্তার শেষ নেই। বহুরাতে গভীর ঘুমেও দুঃস্বপ্ন হানা দেয়। কিছু চলে গেলো নাকি। সে যাই হোক। ভোট নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে খুলনায় মামলা হলো ঢাকা ট্রিবিউন ও মানবজমিনের রিপোর্টারের বিরুদ্ধে। সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া। খবরটা তখনও ভালো করে জানি না। গ্রাম থেকে মায়ের ফোন। তোদের কী কোন সমস্যা হয়েছে? তোদের কোনো সাংবাদিক কি গ্রেপ্তার হয়েছে? জিজ্ঞাস করলাম কোথা থেকে শুনলেন? মা জানালেন, কে যেন ফেসবুকে উনাকে দেখিয়েছেন।

এই যে জুকারবার্গের সাধারণ কিন্তু অদ্ভুত এক আবিষ্কার। যোগাযোগের ইতিহাসকে কীভাবে বদলে দিলো! প্রচলিত সব ধারণা তছনছ করে দিলো। ঢাকা থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম, যেখানে এই সেদিনও বিদ্যুৎ ছিলো না। সেখানকার মানুষেরও খবর পাওয়ার প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে ফেসবুক। এই ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংবাদপত্রের প্রধান চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। ছাপা খবরের কাগজ টিকবে কি-না সে প্রশ্ন পুরনো হতে চলেছে। আক্ষরিক অর্থেই দেশে দেশে সংবাদমাধ্যম বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ক’ দিন পরপরই খবর মেলে ওমুক পত্রিকায় ছাঁটাই চলছে। তমুক সংবাদপত্রের মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও ভয়াল এক সংকটের মুখোমুখি। এ সংকট অবশ্য শুধু অনলাইনের সর্বগ্রাসী প্রভাব কেন্দ্রিক নয়। ঢাকায় পন্ডিতরা এ নিয়ে প্রায়ই কথা বলেন। সম্ভবত, আসল কথাটি বলেন না। সংবাদপত্র গণতন্ত্রেরই অন্যতম প্রধান  স্তম্ভ। গণতন্ত্র ছাড়া সংবাদমাধ্যম বাঁচে না এটা এই বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা পন্ডিতদের কে বুঝাবে। গত কয়েক বছরে ঢাকায় টেলিভিশনের সংখ্যা হুহু করে বেড়েছে। পত্রিকার সংখ্যা এতো বেশি হুট করে মনে রাখাও কঠিন। রাষ্ট্র প্রায়শ’ই সংবাদমাধ্যম যে স্বাধীন তা বুঝাতে গিয়ে এসব সংখ্যা বলে থাকে।

কিন্তু কেমন আছে এসব টিভি চ্যানেল? বিপুল সংখ্যক পত্রিকাইবা চলছে কীভাবে! সংবাদকর্মীদের দীর্ঘশ্বাস কি কেউ শুনতে পান? তারা অবশ্য ইদানিং খবর হচ্ছেন অন্য কারণে। প্রায় সাংবাদিকরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ভোটের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন সাংবাদিক। রক্তের রংতো একই। তারকা এক সাংবাদিক অবশ্য সেখানেও বিভাজনের রেখা টানার চেষ্টা করেছেন।

কাওরান বাজারের চায়ের দোকানে নানা বয়সী সংবাদকর্মীদের সঙ্গে প্রায়শ’ই আলাপ হয়। সম্ভবত, শতকরা ৯৫ ভাগ সংবাদকর্মীই নিজেকে নিয়ে এখন হতাশায় ভোগেন। তারা হয়তো একটি গৌরবের অংশীদার হতে এ পেশায় এসেছিলেন। দেখছেন, ক্রমশ তাদের মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক হতাশাই নয়, একজন সাংবাদিক যখন দেখেন তিনি যা দেখছেন তা লিখতে পারছেন না, বা বলতে পারছেন না তখন তার বিবেকের মৃত্যু হয়। বিবেকের মৃত্যুতো চিন্তারও মৃত্যু। চিন্তা করতে পারার স্বাধীনতাইতো মানুষকে আলাদা করে- অন্য সব প্রাণী থেকে, অন্য সব মানুষ থেকে। স্মরণ করতে পারি ডেকার্টের সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘আই থিংক, দেয়ারফোর আই অ্যাম’। আমি চিন্তা করতে পারি সেজন্যই আমি আছি। চিন্তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সংবাদকর্মীদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতারও মৃত্যু হয়েছে বহুলাংশে। বেশিরভাগ সংবাদ কর্মীই উদ্বিগ্ন তাদের ভবিষ্যত নিয়ে। তাদের প্রশ্ন একটাই-এ পেশায় কেনো এলাম। কিন্তু এই সংকটের সময়ে কিছু কিছু সাংবাদিকের অর্থনৈতিক সততা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে, যা আরো যন্ত্রণাদায়ক।

দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদের উত্থানও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ডনাল্ড ট্রাম্প সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা করে যতো টুইট করেছেন তার হিসাব রাখা দায়। ভারতেও ভিন্ন চিন্তা হামলার শিকার। সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘বাচ্চারা কেউ শব্দ কোরো না, কর্তাকে কেউ প্রশ্ন কোরো না’। এতে আরো লেখা হয়েছে, শাসক ‘উল্টোপাল্টা প্রশ্ন’ পছন্দ করে না, মানুষের প্রশ্ন করার স্পৃহাকে সে সর্বদা দমিয়ে রাখতে চায়। তবুও কিছু মানুষ শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ঘুণে ধরা সমাজকে পাল্টানোর দাবি তোলেন, শাসককে প্রশ্নবাণে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে প্রতিস্পর্ধী হওয়ার সাহস দেখান। আর এই প্রতিবাদীদের একেবারে সামনের দিকে থাকে উত্তাল আঠারো। কারণ ‘এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়।’ ‘ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ’ তামাদি হয়ে গিয়েছে কবেই। ছাত্রেরা বুঝতে পেরেছেন, শাসকের পছন্দসই এই লব্জ আসলে ‘মগজে কারফিউ’ জারি করার ছল। কিন্তু যাঁরা প্রশ্ন করতে শিখেছেন সব কিছুকেই, তাঁরা কেন বিনা তর্কে, বিনা বিচার-বিবেচনায় সব কিছু মেনে নেবেন? এই মেনে না-নেওয়ার তাগিদ থেকেই সব ভেদবুদ্ধি ও স্বার্থের সংঘাত অস্বীকার করে শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রেরা বারবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এ দেশে কিংবা বিদেশে। গত শতাব্দীতে তো বটেই, এই শতাব্দীতেও। তাঁদের আন্দোলন কখনও সফল হয়েছে, কখনও বা ব্যর্থ। তা বলে তাঁদের ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রচেষ্টায় ছেদ পড়েনি কোনও দিনই।

ভারতের চলমান ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে আনন্দবাজারের এই সম্পাদকীয়। শাসকবিরোধী কোনো আন্দোলনে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম কি এতোটা খোলামেলা? প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের জন্য কি গৌরব করার মতো কিছুই নেই। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে এদেশের সংবাদপত্র। শহীদদের তালিকায় জ্বলজ্বল করছে সাংবাদিকদের নাম। স্বৈরাচারের পতনেও সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল প্রধান। রাষ্ট্রের চলমান বাস্তবতা থেকে সংবাদপত্রকে আলাদা করা কঠিন। কেননা, সাংবাদিকরাতো আর ভিনগ্রহের বাসিন্দা নন।

একদিকে হতাশার ছবি, অন্যদিকে মুক্তির আশা। অদ্ভুত এক বৈপরত্য নিয়ে এগিয়ে চলছি আমরা। সপ্তদশ শতকে অ্যারিওপেজিটিকায় জন মিল্টনের উচ্চারণ ছিল: আমাকে চিন্তার স্বাধীনতা দাও, কথা কইবার স্বাধীনতা দাও, সবার উপরে আমাকে দাও মুক্তি। মুক্তির সেই লড়াই আজো চলছে। বিশ্বাসীদের হতাশ হওয়ার সুযোগ নেই। সংবাদমাধ্যমের বিপন্ন হওয়ার সময়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের বারান্দায় তরুণদের আনাগোনা, এটাই বোধকরি সবচেয়ে বড় আশার কথা। নানা অভিজ্ঞতা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন সংবাদমাধ্যম টিকে থাকবে। খবরের মৃত্যু নেই। সন্তান জন্মদানে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় মায়েদের। একটি সত্য সংবাদ রচনায় সংবাদকর্মীদেরও পোহাতে হয় যন্ত্রণা। হুমকি, কারাভোগ, এমনকি প্রাণদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাদের। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শেষ পর্যন্ত সত্য সাংবাদিকতারই জয় হয়। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, চাকরির অনিশ্চয়তা সবকিছুর পরও দিনের শেষে যখন চিন্তা করি আমরা সত্যের জন্য লড়ছি, এর চেয়ে বড় পাওয়াতো আর হয় না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status