শেষের পাতা

ছয় মাসেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ সরকারের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২৯ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ৯:১০ পূর্বাহ্ন

২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। কিন্তু ৬ মাসেই তার চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা বেশি নিয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭.৫ শতাংশ কম। এদিকে কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য, এ বছর বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরের ছয় মাসের মধ্যেই সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সরকার। সর্বশেষ গত ১২ই জানুয়ারি পর্যন্ত এ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৫১ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার থেকে ইতিমধ্যে ৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার।
কোন খাত থেকে কত টাকা ধার করতে হবে, তার একটি লক্ষ্যমাত্রা অর্থবছরের শুরুতেই ঠিক করে নেয় সরকার। বাজেটে তার ঘোষণা থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংক, উভয় উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। অন্যদিকে, রাজস্ব আদায়ে গতি না থাকায় উন্নয়ন ব্যয়ের ঘাটতি পূরণ করতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে, ছয় মাসেই ব্যাংক ঋণের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে সরকার। রাজস্ব আদায় কম হওয়া এবং ব্যাংক থেকে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার বেশি ঋণ নেয়াকে অর্থনীতির জন্য অস্বস্তি হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের ধীর গতি দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। সরকারি মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে এবং বেসরকারি ঋণ প্রবাহে গতি সঞ্চার হবে। সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের ফলে তার বিক্রি কমে গেছে। ফলে, ব্যাংক ব্যবস্থা হতে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস থেকে শুরু হওয়া রাজস্ব আহরণের নিম্নগতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতি মাসেই রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে মোট লক্ষ্যমাত্রার ১৪.৭ শতাংশ, যা গত বছরের চেয়ে কম। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে এতথ্য জানিয়ে বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাকি সময়ে কাজের গতি বাড়ানো হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে আদায় হয়েছে ৫৫ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭.৫ শতাংশ কম।
এনবিআরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর ১৯ পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫ মাসে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। আর রাজস্ব আদায়ের গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫.৬ শতাংশ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার যেভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে তা নজিরবিহীন। এই ঋণ নেয়ার ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকট আরো বাড়বে এবং এটি শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিখাতকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি ধার করার রেকর্ডটি ছিল বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই বছর ধারের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। এবার ৬ মাসেই সেই রেকর্ড ভেঙে গেছে। ৬ মাসের ধারসহ ব্যাংক ব্যবস্থার কাছে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা। অথচ গত জুনেই এই পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৯৫ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শেষের দিকে সরকারের টাকার চাহিদা আরো বাড়বে। যেভাবে চলছে, তাতে অর্থবছর শেষে সরকারের ধারের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি হয়ে যেতে পারে। এতে ব্যাংক ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের ঋণের ভাগ কমে যাবে এবং বিনিয়োগ ব্যাহত হবে।
ব্যাংককাররা জানান, ব্যাংকগুলো তারল্য নিয়ে আরো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। এ জন্য বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের মতে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অর্থ ধার বাড়লেও এবার সঞ্চয়পত্র কম বিক্রি হওয়ার একটা সুফল পাবে সরকার। কারণ, সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হলে গ্রাহকদের উচ্চ হারে যে সুদ দিতে হতো, তা এবার কম দিতে হবে।
এদিকে, অর্থবছরের ৫ মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের কম সংগ্রহ হয়েছে ৭৩ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৫ হাজার ৮৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এ বছর সঞ্চয়পত্রের বিক্রি আগের বছরের চেয়ে ৭৩ শতাংশ কমে গেছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২৮ হাজার ৮৬২ কোটি ৯২ লাখ টাকা। আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয় ১২ হাজার ৮০৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৮৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা ধরা হয়েছে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা। বাকি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা ঘাটতি (অনুদান বাদে)। এই ঘাটতিরই একটি অংশ সরকার পূরণ করছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার করে। তবে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আসবে বলে সরকার আশা করছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status