দেশ বিদেশ

দেশে ৭৪ লাখ তরুণ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত নেই: সিপিডি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২২ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ৯:০৪ পূর্বাহ্ন

দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুবক-যুবতীর সংখ্যা ২ কোটি। এর মধ্যে ৭৪ লাখ কোনো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত নেই। ফলে আন্তর্জাতিক যুব সূচকে ২০১৬ এ ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৪৬ তম। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে যুব নীতি গ্রহণের পাশাপাশি পর্যাপ্ত বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
গতকাল রাজধানীর লেকশোর হোটেলে ‘প্রান্তিক যুবসমাজের কর্মসংস্থানে সরকারি পরিষেবার ভূমিকা’ শীর্ষক সংলাপে উত্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। সিপিডি আয়োজিত সংলাপে এ তথ্য তুলে ধরেন, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপের সহযোগিতা করেছে দ্যা এশিয়া ফাউন্ডেশন, এসডিজি বাস্তবায়নের নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ। সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, নাইম রাজ্জাক ও রুমিন ফারহান এমপি এবং সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান এবং নির্বাহী পরিচালক ড.ফাহমিদা খাতুন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে এখন ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী সুবিধাবঞ্চিত ২ কোটি যুবক রয়েছে। যা মোট শ্রম ও জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে নতুন করে ৩ কোটি যুব-জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। কিন্তু সরকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি প্রকৃতি যেভাবে চলছে তাতে, ঊর্ধ্বে ১ কোটি ৪৯ লাখ, অর্থাৎ অর্ধেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আর বেকার থাকবে অর্ধেক যুবক। কারণ যুব-জনগোষ্ঠীর এখন জীবন ও জীবিকা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান চ্যালেঞ্জে মোকাবিলা করছেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি সার্টিফিকেট কেন্দ্রিক। এ শিক্ষাপদ্ধতি বেকারত্ব তৈরি করছে। এর থেকে বের হতে বাস্তব ও জীবনমুখী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তারা বলেন, কোন খাতে কত গ্র্যাজুয়েট দরকার, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। পরিকল্পনা ছাড়াই গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা হচ্ছে। এজন্য বেকারত্ব কমছে না। পরিসংখ্যান থাকলে সেক্টর অনুযায়ী চাহিদা মোতাবেক গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা যেতো, ফলে বেকারত্ব ঘুচানো যেতো। তারা আরো বলেন, ত্রুটিপূর্ণ ও মান্ধাতা আমলের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি যথাযথ ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের অভাবে প্রতিনিয়তই যুবকরা বেকার হচ্ছেন। তার সঙ্গে স্থায়ী আবাসন, জীবন ও জীবিকার চ্যালেঞ্জের কারণেও কর্মসংস্থাহীন হয়ে পড়ছে চার শ্রেণির যুবগোষ্ঠি। এই যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে এখনি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে। গ্রামে ও শহরের বৈষম্য দূর করতে হবে। তাহলেই দেশের উন্নতি হবে।
সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান বলেন, প্রবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে আমরা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির কথা বলি। সেটা না বলে, কতজনের নতুন করে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে সেই হিসাব করতে হবে। বাংলাদেশে একটি বাধ্যতামূলকভাবে যুবকর্মসংস্থান প্রকল্প বা একটি প্রোগ্রাম নেয়ার আহ্বানও জানান তিনি।
এ সময় মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, দুর্নীতির দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ রয়েছে। ফলে এইচএসসি, অনার্স এবং মাস্টার্স পাসের পর বেকারের হার বাড়ছে। তারা কেউ কেরানির চাকরি করতে চায় না। সবাই অফিসার হতে চায়। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। সময়ে উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে।
রুমিন ফারহানা এমপি বলেন, বেকারত্বের হার দিন দিন বাড়ছে অথচ সরকার বলছে প্রবৃদ্ধির কথা। প্রবৃদ্ধির হিসাব দেখানো হলেও প্রকৃত প্রবৃদ্ধি যে হচ্ছে না বেকারত্ব বৃদ্ধিই তার প্রমাণ। শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা রয়েছে। সরকার ফলাফলের ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে শিক্ষার মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, যুব সমাজের কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ মূলত জীবন চক্রের চ্যালেঞ্জ।
যুব সমাজের মধ্যে যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, তাদের চ্যালেঞ্জ আরো বেশি। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে যে নতুন তিন কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চায়, এজন্য অবশ্যই উদ্ভাবনী চিন্তা প্রয়োজন।
মোয়াজ্জেম বলেন, গবেষণায় অংশ নেয়াদের ৬০ শতাংশ মনে করেন, গ্রামীণ প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো কেবল নামে মাত্র দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে ঠিক মতো প্রশিক্ষণের ক্লাস হয় না, ভালো প্রশিক্ষক নেই।
বস্তিবাসী ও আদিবাসীদের মধ্যে শতভাগ যুবগোষ্ঠী এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮ শতাংশের কোনো বসতভিটা না থাকার তথ্য তুলে ধরে সিপিডির এই গবেষক বলেন, বাসস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা উভয়ই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। তারা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্মুক্ত স্থানে (বস্তি) অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
শিক্ষায় সরকার অনেক সাফল্য অর্জন করলেও প্রান্তিক যুবকেরা এর সুফল পুরোপুরি পায়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, সমতলের আদিবাসী ও সিলেট অঞ্চলের শহুরে যুবগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ শতাংশ মনে করেন তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় মানের প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে অর্ধেক নিম্নমানের।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা মনে করেন, তাদের বিজ্ঞান, গণিত বিষয়ের শিক্ষকের অভাব। এছাড়া স্কুলের বেতন ছাড়াও পড়ালেখাকেন্দ্রিক অন্যান্য খরচ বহন করতে না পারার কারণে অনেকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন।
মোয়াজ্জেম বলেন, জাতীয় যুবনীতিতে আয়, লিঙ্গ, ভৌগোলিক অবস্থান, জীবনচক্র, নাগরিক পরিচয়, শারীরিক অক্ষমতা, শিক্ষা ও দক্ষতা, স্বাস্থ্য, কর্ম, ধর্ম, সমপ্রদায়সহ মোট ১৬টি সূচক বিবেচনায় নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে গবেষণায় কেবল ধর্ম ও সমপ্রদায়, দুর্যোগ, শিক্ষা ও দক্ষতা ও ভৌগোলিক কারণে প্রান্তিক যুব জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত গাইবান্ধার যুবক সুমন খন্দকার বলেন, তিনি গ্রামের কয়েকজনকে একটি সরকারি প্রশিক্ষণে পাঠালেও সেখানে তিন দিনের বেশি ক্লাস হয়নি। তারা ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসাবে কিছুই শিখতে পারেনি। ওই প্রশিক্ষণকেন্দ্রিক সরকারঘোষিত এক লাখ টাকার ঋণ নিতে গিয়ে ১০ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছিল।
মাদ্রাসা শিক্ষক উছমান গনি বলেন, চাকরি ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকার পরেও মাদ্রাসাপড়ুয়াদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়।
কড়াইল বস্তির বাসিন্দা তানজিনা আক্তার তানিয়া বলেন, যখনই নিজেকে বাস্তুহারা মনে হয় তখনই পড়ালেখাসহ সব ধরনের কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়। তারা বসতভিটার অধিকার চান।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য ঝুমা বলেন, সরকার তাদেরকে স্বীকৃতি দিলেও যে উদ্দেশ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে সেটা পূর্ণ হয়নি। অর্থাৎ হিজড়াদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status