বই থেকে নেয়া

কোনটি মানবাধিকার আর কোনটি নয়

ড. আসিফ নজরুল

১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৬:৫০ পূর্বাহ্ন

ধর্ম পালনের অধিকার একটি মানবাধিকার। যেকোনো মানুষের তার ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। আমরা কোনো হতদরিদ্র মানুষকে, কোনো অপরাধীকে, কোনো নিরক্ষর মানুষকেও বলতে পারি না যে সে তার ধর্ম পালন করতে পারবে না। সংগঠন করার অধিকার আরেকটি মানবাধিকার। যেকোনো মানুষের রয়েছে সংগঠন করার অধিকার। গুলশানের মানুষের যেমন অধিকার আছে গুলশান ক্লাব গঠন করার, তেমনি খেতমজুর যারা, তাদেরও তাদের সমিতি করার অধিকার রয়েছে।

ওপরে যেসব অধিকারের কথা বললাম, সেগুলো আমাদের নাগরিক বা রাজনৈতিক অধিকার। যেমন জীবনের বা ধর্ম পালনের অধিকার হচ্ছে আমাদের নাগরিক অধিকার। আবার সভা-সমাবেশ বা সংগঠন করার অধিকার রাজনৈতিক অধিকার। এছাড়া আমাদের কিছু অর্থনৈতিক বা সামাজিক অধিকার রয়েছে। যেমন: খাদ্যের অধিকার বাসস্থানের অধিকার।

মানবাধিকারের সঙ্গে অন্য অধিকারগুলোর মূল পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটি সর্বজনীন। মানবাধিকার প্রত্যেক মানুষের প্রাপ্য, পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো জনগোষ্ঠীর, যেকোনো ধর্মের, যেকোনো সামাজিক অবস্থানের মানুষের ‘মানবাধিকার’ রয়েছে।

অন্য অধিকারগুলো যেকোনো মানুষের প্রাপ্য নয়। এসব অধিকার অর্জনের জন্য কোনো না কোনো যোগ্যতা থাকতে হয়। ঢাকার গুলশান এলাকা বড়লোকদের থাকার জায়গা। সেখানে বসবাস করা বাংলাদেশের কারও মানবাধিকার নয়। এই অধিকার অর্জন করতে হলে তাকে সম্পদশালী হতে হবে। টাকা দিয়ে গুলশানের কোনো বাড়ি কিনতে হবে বা তা ভাড়া নিতে হবে। অর্থাৎ যাদের সামর্থ্য আছে, সেখানে থাকার অধিকার শুধু তাদের।

কিন্তু মানবাধিকার ভোগ করার জন্য এমন কোনো সামর্থ্য বা সম্পদের প্রয়োজন হয় না। যেমন: গুলশান যত বড়লোকেরই জায়গা হোক না কেন, সেখানকার মসজিদে যেকোনো মানুষের নামাজ পড়ার অধিকার আছে। সরকার যদি এমন কোনো আইন প্রণয়ন করে যে গুলশানে যাদের নিজস্ব বাড়ি আছে, শুধু তারা সেখানে নামাজ পড়তে পারবে, তাহলে তা হবে অন্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘন।

মানবাধিকারের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি হস্তান্তরযোগ্য নয়। অন্য বহু অধিকার আছে যেগুলো বেচাকেনা করা যায়, অর্থাৎ এক হাত থেকে অন্য হাতে অর্পণ করা যায়। যেমন আমি একটি বাড়ি কিনলে সে বাড়িতে থাকা আমার অধিকার। এই অধিকারটি টাকার বিনিময়ে আমি ভাড়াটের কাছে হস্তান্তর করতে পারি, বাড়িটি কারও কাছে বিক্রি করে দিতে পারি।

কিন্তু মানবাধিকার বিক্রি বা ভাড়া দেওয়া যায় না। যেমন: একটা গ্রাম বা মহল্লার মানুষ সবাই মিলে কাউকে বলতে পারে না, ভাই, আমাদের কিছু টাকা পয়সা দিন, আমরা আমাদের বাক্স্বাধীনতা আপনার কাছে বিক্রি করতে চাই।
মানবাধিকারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একে মানুষের সহজাত অধিকার হিসেবে দেখা হয়। অর্থাৎ এ অধিকার মানুষ সহজাতভাবেই ভোগ করার অধিকারী, এটি কাউকে দিতে হয় না। তবে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে যে মানবাধিকারকে সংবিধান বা আইনের দ্বারা নিশ্চিত করতে হয়।

মানবাধিকার রক্ষার মূল দায়িত্ব সরকারের। তবে আয়ারল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বিভিন্ন দেশের আদালতের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, বেসরকারি পর্যায়ে যেমন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও মানবাধিকারকে রক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ বহুজাতিক কোম্পানি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ব্যক্তিরও দায়িত্ব রয়েছে অন্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘন না করার।

জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে যে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে বিভিন্ন আইন ও নীতির মাধ্যমে বেসরকারি পর্যায়েও মানবাধিকার নিশ্চিত করা। যেমন: নারী গার্মেন্টস শ্রমিকরা যেন পুরুষদের তুলনায় বেতন ও সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার না হন, সরকার আইন দ্বারা তা নিশ্চিত করতে পারে। তবে বেসরকারি পর্যায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় কি না, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে।

সূত্র: ড. আসিফ নজরুল প্রণীত, প্রথমা প্রকাশিত ‘মানবাধিকার’ বই থেকে
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status