এক্সক্লুসিভ

মৃত্যুর কারণ যখন বায়ুদূষণ

মরিয়ম চম্পা

১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৭:৪৭ পূর্বাহ্ন

মানুষের মৃত্যুর ১০টি কারণের মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে বায়ুদূষণ। আর এ বায়ুদূষণে বছরে বাংলাদেশের এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। এ তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। সংস্থাটি ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। দেশের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ প্রায় আট হাজার ইটভাটা। ঢাকার বায়ুদূষণ পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষকরা বলছেন, গত মাসে ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। এয়ার ভিজ্যুয়াল রাজধানীর সাতটি এলাকার বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসের এক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ ছিল কারওয়ান বাজার এলাকায়। এরপরই মোহাম্মদপুর ও গুলশান এলাকা। এর বাইরে উত্তরা, মিরপুর ও নর্দ্দা এলাকার বায়ুর মানও বেশ খারাপ। এলাকাভিত্তিক বায়ুর মানের রকমফের থাকলেও সামগ্রিকভাবে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর বলে জানান গবেষকরা। অন্যদিকে বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ ও ৬ নভেম্বর ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্প থেকে দেশের আটটি শহরের বায়ুর মান প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে দুই মাস ধরে ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা শহরের বায়ুর মান মারাত্মক ও খুব অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হলো রাজধানী ঢাকা। এরপর রয়েছে রাজশাহী। বরিশাল সবচেয়ে কম দূষিত শহর হলেও এর বায়ু মানমাত্রার চেয়ে খারাপ, অর্থাৎ আশঙ্কাজনক।                                  

পরিবেশ অধিদপ্তর বাংলাদেশের ১১টি জেলায় প্রতিদিনের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) বায়ুমান নির্ণয় করেছে। অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী গত এক মাসে ঢাকার বিভিন্ন জেলার বায়ুমানে দেখা গেছে জেলাগুলোর মধ্যে নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ঢাকা, রংপুরের বায়ুমান ছিল খুব অস্বাস্থ্যকর। এর মধ্যে সবচেয়ে কম দূষিত শহর ছিল সিলেট ও খুলনা। মাসের শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জের বায়ুমান ছিল সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ময়মনসিংহ। এসময় চট্রগ্রামের বায়ুমান ছিল সহনীয়।

চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিবেশ অধিদপ্তরের মিলনায়তনে এক সেমিনারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বায়ুর মান তুলে ধরেণ পরিবেশ অধিদপ্তর। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) ১০টি সংগঠন ‘বায়ুদূষণ ও করণীয়’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে। এখানে দেখা গেছে, ঢাকা ও গাজীপুরের বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় আছে। বরিশাল, রংপুর, সিলেট ও কুমিল্লায় বায়ুর মান সহনশীল অবস্থানে। সাভার, ময়মনসিংহ অঞ্চলের বায়ুর মান সতর্কাবস্থায়। আর সবচেয়ে দূষিত বায়ু নারায়ণগঞ্জে। সেখানকার বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুর মানের দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী।

বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সাধারণত নভেম্বর মাস থেকে মার্চ পর্যন্ত ঢাকার বাতাস বেশি দূষিত থাকে। ২০০২ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত গত ১৭ বছরের জরিপে দেখা গেছে ঢাকার বাতাসের দূষণের ব্যাপ্তি ধারাবাহিকক্রমে বেড়ে চলেছে। এরমধ্যে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে বায়ু দূষণের মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিইউএইচও) ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইপিএর হিসাবে কোনো একটি শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। সূচক ২০০ ছাড়ালে ওই শহরের মানুষকে মাস্ক পরার পরামর্শ দেয়া হয়। ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হয়, সাইকেলে চড়তে নিষেধ করা হয়। এবং শিশু ও বৃদ্ধদের খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতে নিরুৎসাহিত করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের প্রায় ৭১ শতাংশ ইটভাটাকে আমরা পরিবেশবান্ধব করেছি বা কম দূষণের তালিকায় নামিয়ে আনতে পেরেছি। দেশের ৩৩টি জেলায় এখন পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় আছে। প্রতিটি জেলায় পরিবেশ আদালত আছে। তবে এটা ঠিক, আমাদের আরও কাজ করার আছে। বায়ুদূষণের বিষয়ে মানুষকেও সচেতন হতে হবে।

বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বাতাসে ভারি ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তকণা বেড়ে গেলে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। দেশের বায়ুদূষণের অবস্থা একদিকে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বায়ুদূষণ রোধে মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। দূষণ ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করেছে অধিদপ্তর; কিন্তু তা দূষণ কমাতে খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না। যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর উদ্যোগ নেই বলে জানান পরিবেশকর্মীরা। আর দূষণের অন্যতম উৎস নির্মাণকাজের ধুলা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগও তেমন নেই। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনসহ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মতামত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

বাংলাদেশে বায়ুদূষণের উৎস নিয়ে চলতি বছরের মার্চে একটি গবেষণা প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংক। তাতে দেখা যায়, দেশে বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি উৎস ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজ। যেটা গত আট বছর ধরে ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৩ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে দেশের ইটভাটাগুলোর ওপরে একটি জরিপ করা হয়। তাতে দেখা যায়, দেশে ইটভাটার সংখ্যা ৪ হাজার ৯৫৯। পরে ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে ৭ হাজার ৯০২ হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৮৭টি ইটভাটা ঢাকা বিভাগের মধ্যে গড়ে উঠেছে। ২০১০ সালে দেশে মোট যানবাহনের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৭। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৬ লাখ ১৯ হাজার ৬৫৪।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর ঢাকার মতই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। বিশ্বের যে সকল দেশ বায়ু দূষণ মোকাবিলা করেছে তারা সমন্বিত উদ্বোগের মাধ্যমে মোকাবিলা করেছে। এবং সময়ভিক্তিক, আগ্রাসি উদ্যোগ ও নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে করেছে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রথম যে কাজটি করতে হবে সেটা হল বায়ু দূষণ যে সিরিয়াস একটি সমস্যা এবং এটা জনগনের জীবনের অধিকারের উপরে হস্তক্ষেপ করছে সেই বাস্তবতাকে রাজনৈতিকভাবে মেনে নিতে হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পোড়ানো ইট থেকে সরে আসতে হবে। বিকল্প নির্মাণ সামগ্রির দিকে যেতে হবে। বিকল্প সামগ্রি ইটের চেয়ে পরিবেশের জন্য অনেক ভালো এটা সরকারকে প্রচার করতে হবে। ইট ভাটাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। এছাড়া আমাদের নগরগুলোতে সবুজ ফিরিয়ে আনতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সিলেটে পর্যাপ্ত গাছপালা থাকায় সেখানকার বায়ুমান যথেষ্ট ভালো। নগরে গাছ লাগিয়ে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে ধুলা নিয়ন্ত্রণের সঠিক কর্মপরিকল্পনা না দেখে ছাড়পত্র দেয়া বন্ধ করতে হবে। পরবর্তীতে এগুলো মনিটর করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল-আলম বলেন, বায়ু দূষণে যতগুলো উপকরণ দরকার তার সবগুলোই নারায়ণগঞ্জে রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে অপরিকল্পিতভাবে অনেক কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলোর সুতা, রং ইত্যাদি কারণে বাতাস দূষিত হচ্ছে। এখানে অনেক ইটের ভাটা রয়েছে। কল-কারখানা, ইটের ভাটা ইত্যাদি যত দূরে হবে তত বায়ু দূষণ কম হয়। কাছে হলেই বায়ু দূষণ বেশি হয়। ইট পোড়ানোর কারণে যে গ্যাস তৈরি হয় সেটা পরিবেশের জন্য সাংঘাতিক ক্ষতিকর। ফলে বায়ু দূষণ থেকে এখন অজানা রোগে মানুষ বেশি ভুগছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status