দেশ বিদেশ

‘স্যার, আমি শরীফার বাবা, ফোন রিসিভ করেন না কেন’

জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে

৭ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৮:৪৩ পূর্বাহ্ন

শরীফার পরিবারের কোনো অনুনয়-বিনয় শুনছে না পুলিশ। তদন্তকারী কর্মকর্তা ফোন পর্যন্ত রিসিভ করেন না। ফোন করে করে হয়রান মেয়ে হত্যার বিচারপ্রার্থী বাবা। এরপর মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে কথা বলার আকুতি জানান। কিন্তু দারোগা সবসময় ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রাখছেন তাদের। শরীফার মৃত্যুর প্রায় ৩ মাস হলেও বাস্তবে অগ্রগতি শূন্য। আসামি ধরার কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। এমনই অভিযোগ নিহত শরীফার পরিবারের। শুধু তাই নয়, অভিযোগ আরো আছে তাদের। মামলাও পুলিশের ইচ্ছেমতোই হয়েছে। আসামি হিসেবে একজনের নাম রেখে বাকিদের নাম কেটে দেন জেলা পুলিশের পদস্থ এক কর্মকর্তা। তার কলমের খোঁচায় হত্যা মামলা হয়ে যায় আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সেলিম উদ্দিন দাবি করেন বাদীর নিয়ে আসা অভিযোগটিই রেকর্ড করেছেন তিনি।

শহরের কলেজপাড়ার একটি বাসা থেকে গত ১০ই সেপ্টেম্বর সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত শরীফা আক্তারের (২৪) মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা, প্রাথমিকভাবে শরীফার মৃত্যুর এই কারণ প্রকাশ পায়। তবে পরিবারের লোকজন শুরু থেকেই দাবি করে আসছিলেন তাকে হত্যা করা হয়েছে। ৩রা নভেম্বর শরীফার ভিসেরা ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেয়া হয়। যাতে তাকে হত্যা ও ধর্ষণ করার উল্লেখ রয়েছে।

শরীফার মৃত্যুর বিচার চাওয়ার শুরু থেকেই হয়রানির শিকার এই পরিবার। লাশ উদ্ধারের দিন দিবাগত রাত ১ টার দিকে জেলার পদস্থ এক পুলিশ কর্মকর্তা শরীফার পিতাকে থানায় লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। অভিযোগ লেখাতে ডিউটি অফিসার শিরিন আক্তারের কাছে গেলে হুমকি-ধামকি দিয়ে বিদায় করা হয় তাদের। এর দু-দিন পর ১২ই সেপ্টেম্বর নবীনগরের বিদ্যাকুট গ্রামের মো. মজিবুর রহমান তার মেয়েকে হত্যার অভিযোগ নিয়ে থানায় যান। কিন্তু এই অভিযোগও পাল্টে দেয়া হয়। মজিবুর রহমান জানান- ৬ জনের বিরুদ্ধে তার মেয়েকে হত্যার অভিযোগ নিয়ে থানায় গিয়ে সেটি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সামনে এগিয়ে দেন। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সেলিম উদ্দিন হাতে না নিয়ে মিনিট দশেক সেটি টেবিলের ওপর ফেলে রাখেন। পরে হাতে নিয়ে জেলার পদস্থ এক পুলিশ কর্মকর্তার হাতে দেন। এরপরই ওই কর্মকর্তা বলতে থাকেন এটা আত্মহত্যা। ৬ জন আসামি, কিসের আসামি। ৬ জনে মারছে? এরপর তিনি এজাহার কলম দিয়ে কাটাকাটি করতে শুরু করেন। পর সেটি ওসি (তদন্ত) আতিকুর রহমানের হাতে দিয়ে বলেন, আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়ে মামলা লিখতে। তারা সিগন্যাচার করলে করবে না করলে নাই। শরীফার বড় বোন জোনাকী জান্নাত বলেন- তদন্ত স্যাররে অনেক অনুরোধ করে বলেছি, স্যার আমার বোনরে মারছে। সে আত্মহত্যা করেছে এটা আমরা মানি না। কারা কারা মারছে, সবই আমি জানি। কিন্তু থানার এই কর্মকর্তাও তার অপারগতা প্রকাশ করেন। বলেন, স্যার বলে গেছেন এভাবে লিখতে। এর বাইরে আমি কিছু করতে পারবো না। তোমাদের খুশি বা ইচ্ছে, সাইন দিলে দেও, না দিলে নাই। তখন বাধ্য হয়েই আমরা সিগন্যাচার করি। আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলার একমাত্র আসামি বিদ্যাকুটের আক্কাস মিয়ার ছেলে সোহেল ওরফে হোসাইন (২৫)। কিন্তু তারা যে মামলাটি দিয়েছিলেন সেখানে সোহেলের বন্ধু গোপালগঞ্জের নোমান, শরীফার পাশের কক্ষের ভাড়াটিয়া আফরোজা ও তার স্বামী আবদুল আজিজ এবং সোহেলের বাবা আক্কাস মিয়া ও মা ফাতুনী বেগমকে আসামি করা হয়েছিলো। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছিল আরো ৪/৫জনকে।

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় সাব ইন্সপেক্টর ধর্মজিৎ সিনহাকে। তদন্তকারী কর্মকর্তার তৎপরতাও অনুকূলে নয় শরীফার পরিবারের। শরীফার পিতা মো. মজিবুর রহমান ও বড় বোন জোনাকী জান্নাত অভিযোগ করেন- আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করার সবই করেছি। কিন্তু (পুলিশ) উনাদের পক্ষ থেকে কোন তাগিদ নেই। প্রথমে বলেছে, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আসার আগে কিছু করতে পারবে না। এই রিপোর্ট এসেছে একমাস। কিন্তু আগের মতোই নীরব তদন্তকারী কর্মকর্তা। ১০/১২ বার ফোন করলেও তিনি আমাদের ফোন ধরেন না। অন্য নাম্বার থেকে ফোন করলে ধরেন। কিন্তু পরিচয় পেয়ে বিজি আছেন বলে ফোন রেখে দেন। বারবার এসএমএস পাঠাই। কোন সাড়া দেন না।

জোনাকী তার মোবাইল বের করে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে পাঠানো একাধিক এসএমএস দেখান। ২রা ডিসেম্বর পাঠানো একটি এসএমএসে লেখা হয়েছে- ‘স্যার, আমি শরীফার বাবা মজিবুর রহমান, কলেজপাড়ার মোকদ্দমা। আপনাকে ফোন দিলে রিসিভ করেন না কেন? আপনার সাথে বসে কথা বলবো, এইটুকু সময় আপনি আমাদের দিচ্ছেন না। সবসময় বিজি দেখাচ্ছেন। আপনার সাথে কালকে কখন দেখা করতে পারবো টেক্স করবেন।’  তারা বলেন, সরাসরি আসলে বলেন করতাছি। এসব করে ৩ মাস পার করে দিয়েছেন। কলেজপাড়ার ওই কক্ষটি ছাড়া তদন্ত করতে তিনি আর কোথাও যাননি। এই পর্যন্ত আসামির বাড়ি বিদ্যাকুটে একবারও যাননি। আমরা তাকে অভিযুক্ত সোহেলের নাম্বার দিয়েছি। তার লোকেশন জানিয়েছি। পাসপোর্টের ফটোকপি এনে দিয়েছি। তার পুরো পরিবারের নাম্বার দিয়েছি।

জোনাকী বলেন- যদি দারোগাকে বলি আসামিতো আরো আছে। তাদেরকে ধরেন, তখন বলেন- এদেরকে আমি কিভাবে ধরবো। সিনিয়র অফিসাররা আমাকে চাপ দেবেন। তিনি বলেন- আমরা যে ক্ষতিগ্রস্ত, আমার বোনরে যে মাইরা ফেলছে, রিপোর্টে যার স্পষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু তাদের কাছে গেলে মনে হয় আমরাই আসামি। জোনাকী অভিযোগ করেন, ঘটনার রাতে থানায় গেলে জেলা পুলিশের এক বড় কর্মকর্তা আমাকে বলেন- তোমার বোন কি সিগারেট খায়, কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো। একপর্যায়ে তিনি আমি এবং আমার আরেক বোনের স্বামী কোথায় থাকে তা জানতে চান। আমি যখন জানাই তারা বিদেশে, তখন বলেন তাহলে তোমরা থাকো কিভাবে। আমরা বোন হারিয়েছি, আমাদের মানসিক অবস্থা কি? সে জায়গায় উনি আমাদেরকে এসব কথা বলতে থাকেন।  

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ধর্মজিৎ সিনহা বলেন- এজাহারনামীয় আসামি এলাকায় নেই। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট কালেকশন করেছি। এখন সিআইডি’র এক্সপার্ট রিপোর্ট পেলে কনফার্ম হয়েই হিট করবো। বাদী পক্ষের লোকজন পরশু দিনও এসেছিলো। আজকে (শুক্রবার) একজন স্বাক্ষীকে আসতে বলেছি।

ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেলিম উদ্দিন বলেন- আসামি ধরার চেষ্টা চলছে। ওইদিন সিনিয়র স্যাররা ছিলেন। আমার সঙ্গে তাদের বেশি কথা হয়নি। তারা আমার কাছে যে অভিযোগ নিয়ে এসেছেন সেটিই আমি রেকর্ড করেছি। শরীফা শহরের কলেজপাড়ার খালেক ম্যানেজারের বাসার নিচতলার একটি কক্ষে ভাড়া থাকতেন। এর আগে শহরের কান্দিপাড়ায় বড়বোন জোনাকীর সাথেই থাকতেন শরীফা। বড় বোন ঢাকায় চলে যাওয়ার পর কলেজপাড়ায় ওই কক্ষটি ভাড়া নিয়ে গত প্রায় বছর দেড়েক ধরে বসবাস করছিলেন পড়াশুনার জন্যে। একাউন্টসে সম্মানসহ মাস্টার্স পাশ শরীফার একটি বেসরকারি ব্যাংকে নিয়োগ হয়েছিলো। বাসাটিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই বাসায় বসবাসের শেষ দিনেই জীবন সাঙ্গ হয় তার। পরিবারের সদস্যরা জানান- বিদ্যাকুট গ্রামের সোহেল নামের এক বখাটে ২০১২ সাল থেকেই উত্ত্যক্ত করে আসছিলো শরীফাকে। তার কাছে শরীফাকে বিয়ে দেয়ার জন্য বারবার পরিবারকে চাপ দেয়। বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় রাস্তাঘাটে সোহেল তাকে মারধরও করে। কলেজপাড়ার ওই বাসায় এসেও উত্ত্যক্ত করতো। তার যন্ত্রণা থেকে বাচতে অন্তত ১০ বার মোবাইলের সিম পরিবর্তন করে  সে। শরীফার মৃত্যুর খবর সোহেলই তার বন্ধু নোমানের মোবাইল থেকে ফোন করে শরীফার বড় বোন সোনিয়াকে জানায়। বলে তোর বোন মইরা রইছে। শরীফার পাশের কক্ষেই থাকেতো আফরোজা নামের এক নারী। সোহেল তার সহায়তাতেই ঘটনার সময় শরীফার ঘরে ঢুকেছে বলে পরিবারের লোকজনের ধারণা। এবিষয়ে আফরোজা সব জানে বলে জানান শরীফার বাবা ও বোনেরা।
তারা বলেন, আফরোজাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আমরা বারবার বলেছি। কিন্তু নির্বিকার পুলিশ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status