দেশ বিদেশ

মামলার এজাহার বদল, ওসি শাকিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ

স্টাফ রিপোর্টার

২ ডিসেম্বর ২০১৯, সোমবার, ৯:২৮ পূর্বাহ্ন

রাজশাহীর পুটিয়ার শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় এজাহার বদলে দেয়ার ঘটনায় তৎকালীন ওসি সাকিল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর বলে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। যা দণ্ডবিধির ১৬৬ ও ১৬৭ ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আদালত বলেছেন, দণ্ডবিধির ওই ধারা দুটি দুদক আইন ২০০৪ এর তফসিলভুক্ত। তাই রাজশাহীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং এ সংক্রান্ত নথি দুদকে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হলো। দুদক প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর দুদক আইন ও বিধি অনুসারে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেন আদালত। এছাড়া সাকিল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলামের মেয়ে, তার অধীনস্থ পুলিশ সদস্য ও তার শাশুড়ির দেয়া অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন।  আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।     রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও অমিত তালুকদার। দুদকের পক্ষে ছিলেন শাহীন আহমেদ।

আদালত রায়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালত বলেন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রেরিত অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য হতে এটি প্রাথমিকভাবে সুস্পষ্ট যে, পুটিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাকিল উদ্দিন আহমেদ শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় তার মেয়ে নিগার সুলতানা আট জনকে অভিযুক্ত করে প্রেরিত এজাহারটি গ্রহণ না করে পরবর্তীতে থানায় ডেকে জব্দ তালিকা, সুরতহাল প্রতিবেদনসহ কিছু সাদা কাগজের ওপর সই করিয়ে নেয়া হয়। পরবর্তীতে ওই সাদা কাগজে এজাহার টাইপ করে তা রেকর্ডভুক্ত করা হয়। নিগার সুলতানার (সংবাদদাতা) পাঠানো এজাহারের বর্ণনার সঙ্গে দায়েরকৃত এজাহারের বর্ণনার মধ্যে অসঙ্গতি বিদ্যামান। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মতো একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নিঃসন্দেহে গুরুতর। যা দণ্ডবিধির ১৬৬ ও ১৬৭ ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ওই ধারা দুটি দুদক আইন ২০০৪ এর তফসিলভুক্ত। সে কারণে রাজশাহীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং এ সংক্রান্ত নথি দুদকে প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হলো। দুদক ওই প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর দুদক আইন ও বিধি অনুসারে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হলো। আদালত প্রত্যাশা ব্যাক্ত করে বলেন, এই মামলাটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে( পিবিআই) নির্দেশ দেয়া হলো। পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার  মামলাটি তদারকীতে বিশেষ ভূমিকা রাখবেন। বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা/ সংস্থাকে অবিলম্বে কেস ডকেট হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়া হলো। তদন্তকালে পিবিআইকে সংবাদদাতার মূল এজাহারের বর্ননা, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী কতৃক অনুসন্ধান রিপোর্ট ও ওই অনুসন্ধান কার্যক্রমে সাক্ষীদেও সাক্ষ্য বিবেচনায় গ্রহনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।

আদালত আরো বলেন, সাকিল উদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে নুরুল ইসলামের মেয়ে, তার অধীনস্থ পুলিশ সদস্যসহ একাধিক ব্যক্তি, এমনকি তার শাশুড়িও বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করে প্রতিকার চেয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন। সাকিল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো দ্রুত তদন্তপূর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয়া হলো।

আদালত বলেন, এখানে উল্লেখ করা সংগত হবে যে আমরা দৈনন্দিন বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে ইদানিং লক্ষ্য করছি, দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা সহ পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। এসব বিষয়ে ভুক্তভোগীরা মহাপরিদর্শক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। কিন্তু অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না। বাংলাদেশ পুলিশ মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা ও  উন্নয়ন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ দমন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, জাতিসংঘ শান্তি মিশনের কার্যক্রমে যে অনবদ্য অবিস্বরনীয় ভূমিকা রেখেছে এবং বেখে চলছে তা শুধু পুলিশ বাহিনীর জন্য গৌরবের নয়, সমগ্র জাতির গৌরব। কিন্তু এই গৌরব গুটি কয়েক পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যে অন্যায়, বেআইনি আচরণ ও অপরাধের কারণে ম্লান হতে দেয়া যাবে না। সে কারণে আদালত প্রত্যাশ করেন, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে ওই  অভিযোগ সম্পর্কে দ্রুততার সাথে বিভাগীয় তদন্ত সম্পন্ন এবং দ্রুত আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আদালতের এ প্রত্যাশ বিবেচনায় নিয়ে মহা পুলিশ পরিদর্শক এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আইজিপি কমপ্লেইন্টস মনিটরিং সেল’র কার্যক্রম আরো গতিশীল করবেন বলে আদালতের দৃঢ় বিশ্বাস।

এছাড়া, পুটিয়া থানার আলোচ্য মামলায় গ্রেপ্তারকৃত এক শিশুর ফৌজদারী কার্যবিধি ধারা ১৬৪ অনুযায়ী প্রদত্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গণমাধ্যমে প্রকাশের বিষয়ে রাজশাহীর পুলিশ সুপারের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল । তার পক্ষে দাখিলকৃত হলফনামা পাঠ অন্তে ওই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা উদ্ধার করা আদালতের পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং এ বিষয়ে আমাদের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। শিশু আইন ২০১৩ এর ২৮ এবং ৮১ ধারা অনুসারে শিশু, আইনের সাথে সংঘর্ষিক শিশু বা  আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু যেই হোক না কেন, স্বার্থপরিপন্থী শিশুর কোনো ছবি বা তথ্য গণমাধ্যমে, ইন্টারনেটে প্রকাশ ও প্রচার করা যাবে না, যার দ্বারা শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়। ধারা ৮১ অনুযায়ী, গণমাধ্যম বা অন্য কোন সামাজিক মাধ্যমে এ ধরনের  তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আলোচ্য ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারকৃত একজন শিশুর তর্কিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করে রাজশাহীর পুলিশ  প্রশাসন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন এবং আইন ভঙ্গ করেছে, তা যে পরিস্থিতি বা বাস্তবতায় দিয়ে থাকুক না কেন। শিশু আইনের উদ্দেশ্য হলো শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ সংরক্ষণ করা। এই আইন সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। শিশুর জবানবন্ধী গণমাধ্যমে প্রকাশ করার বিষয়টি সম্পর্কে পুলিশের মহাপরিদর্শককে বিভাগীয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দেয়া হয়। রাজশাহীর পুলিশ প্রশাসনকে মামলার সংবাদদাতা, সাক্ষীগণ, ভিকটিম  মৃত নুরুল হকের পরিবার এবং তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হলো। প্রয়োজনীয় অবগতি ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অত্র রায়ের কপি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজশাহীসহ মহা পুলিশ পরিদর্শক, পিবিআই, রাজশাহী  জেলা পুলিশ সুপার, পুটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করার নির্দেশ দেন।
গত ২২শে, জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে ‘এজাহার বদলে দিলেন ওসি’ শীর্ষক প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকের প্রতিবেদন যুক্ত করে এই রিট করা হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status