শেষের পাতা

সংকটে কারিগরি শিক্ষা

পিয়াস সরকার

২৩ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৯:১৫ পূর্বাহ্ন

শিক্ষক সংকট, উপকরণের অভাব, অনুন্নত কারিকুলামসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের কারিগরি শিক্ষা। এছাড়াও কারিগরি বিভিন্ন বিষয়ে বিদেশে চাহিদা থাকলেও শিক্ষার মান উন্নয়নে আশাতীত কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ২০১৮ সালের তথ্যে দেশের কারিগরি শিক্ষার্থীদের হার মাত্র ১৪ শতাংশ। ২০২০ সালে যেটি করবার লক্ষ্য ২০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালে সেই লক্ষ্য ৩০ শতাংশ। তবে বাস্তবে আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা ও বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)’র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এটি মূলত ৮.৪৪ শতাংশ।

ব্যানবেইস’র ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ হাজার ৮৬৫টি। এরমধ্যে সরকারি ৮৬৬টি ও বেসরকারি ৫ হাজার ৯৯৯টি। শিক্ষার্থী ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৪ জন। এতে যুক্ত করা হয়েছে ৬ মাস মেয়াদী বিভিন্ন শর্ট কোর্স। এই কোর্সের আওতাধীন ২ হাজার ৬শ’ টি ট্রেনিং সেন্টার। আর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের আলাদা করলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হয় ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৭৮৫।

আবার নবম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত কারিগরির আওতায় অধ্যয়ন করে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৪ শতাংশ। কিন্তু এসব সার্টিফিকেট কোর্স আন্তর্জাতিক কারিগরির শিক্ষার আওতায় পড়ে না। আবার কারিগরি শিক্ষার অধীনে রয়েছে ২ হাজার ৬১৭টি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট (বিএম) স্কুল ও কলেজ। এসব শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন করতে সেগুলো রয়েছে ব্যবসায় বিজ্ঞান শাখায়। এটিও কোনভাবেই কারিগরি শিক্ষার আওতায় পড়েনা। এছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে ডা. দীপু মনি বলেন, বিএম কলেজ নিয়ে আমরা চিন্তা করছি। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ে কারিগরি কোন জ্ঞান পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা।

কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের শর্ট কোর্সের উপ পরিচালক ড. ইন্দ্রানী ধর বলে, আমাদের শর্ট কোর্সগুলো দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৩ হাজার। আমাদের নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সমস্যা হয়। তবে আমরা এই সমস্যা দুর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের সদ্য একটি বৈঠক হয়েছে এতে আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের একসঙ্গে করে প্রথমবার বসতে যাচ্চি।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বিএম কলেজও কারিগরির অধীনে পড়ে না। কারণ তাদের অধ্যয়নের বিষয় সমুহ রয়েছে সাধারণ শিক্ষার ব্যবসায় প্রশাসনেও। এসব কলেজে অধ্যয়নরত আছেন ৩৫ হাজার ২২৫ শিক্ষার্থী। এই বিএম কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাদ দিলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩২ হাজার ২৫৯ জন। এই হিসেবে কারিগরিতে শিক্ষার হার ৮.৪৪ শতাংশ। যেখানে জর্মানীতে ৭৩ শতাংশ, জাপান ৬৬, সিঙ্গাপুর ৬৫, অস্ট্রেলিয়া ৬০, চীন ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়া ৫০, মালয়েশিয়ায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছেন কারিগরি মাধ্যমে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, সরকারের দেয়া এই হার সঠিক নয়। কারণ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এক নয়। বৃত্তিমূলক শিক্ষার পরের ধাপ কারিগরি শিক্ষা। সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে এক করে হিসাব করছে। এতে কারিগরির প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না।

আবার ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী করিগরিতে নারী শিক্ষার্থীদের অবস্থান অনেকটাই পিছিয়ে। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ৬৪ হাজার ২৬২ জন; ২৪.৭৬ শতাংশ। আর মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৫০ হাজার ৯৩১ জন। নারী শিক্ষকের সংখ্যা ১০ হাজার ২১২ জন। ২০.০৫ শাতংশ মাত্র।

কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নিয়ে আছে প্রশ্ন। সরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে সংকট। দেশের একমাত্র সরকারি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক্স একজন শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের শিক্ষকরা অধিকাংশই চুক্তিভিত্তিক। নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছেন অল্প কিছু শিক্ষক রযেছেন নিয়মিত। এসব শিক্ষকের দ্বারা আমরা খুব একটা উপক্রিত হতে পাচ্ছি না। এছাড়াও আমাদের প্রাকটিক্যাল উপকরণের অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী। যেমন, জ্য ক্রাশার, হ্যামার মিল, বল মিল ইত্যাদি। এসব গুরত্বপূর্ণ উপকরণ ছাড়াই প্রাকটিক্যাল করতে হচ্ছে আমাদের।

এছাড়া বেসরকারি পলিট্যাকনিক্যালের অবস্থা আরো ভয়াবহ। রাজধানীর বুকে পান্থপথে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং’র টেক্সটাইলে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। ছোট একটি ল্যাব থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ। এছাড়াও তারা প্রাকটিক্যালের জন্য নেই ভাড়ি উপকরণ।

আর রাজধানীর বাইরে চলছে নাম সর্বস্ব অবস্থায়। ইমেজ পলিটেনিক্যাল ইন্সটিটিউট, রংপুরের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা পলিট্যাকনিক্যালে পড়ছি মুখস্ত বিদ্যা নিয়ে। এখানে নেই কোন শিক্ষক। নেই কোন প্যাকটিক্যাল উপকরণ। এটাকে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কেনা বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না।

এসব প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামের অবস্থাও প্রতিষ্ঠানের মতোই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে না এসব কারিকুলাম। চলতি বছরের বাজেটে এটিকে এগিয়ে নেবার জন্য অনেক উদ্যোগের কথা বলা হয়। বলা হয় ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ইন্টারনেট অব থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বন্ডচেইন টেকনোলজিসহ আধুনিক বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু কারিকুলাম রয়ে গেছে সেই আগেও মতোই।

এছাড়াও কারিগরি শিক্ষায় পুরেনো কোর্স থাকায় চাকরীর বাজারেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। যেমণ ডিপ্লোমা ইন মাইনিং। কিন্তু খনিজ সম্পদ আহরণে এই প্রশিক্ষত শিক্ষার্থীরা চাকরীর বাজারে চাহিদা না থাকায় এই বিষয়ে পড়ে কোন কাজে আসছে না। তবে ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ এর রয়েছে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক চাহিদা। ৩ বছর আগে বিষয়টিযুক্ত হলেও রীতিমতো ধুকছে।

বগুড়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের এই বিষয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী মুত্তাসিম আহমেদ বলেন, প্যাকটিক্যাল ছাড়াই চলছে আমাদের কার্যক্রম। আমাদের কোন একজন শিক্ষক নেই প্রশিক্ষিত। অনেক বলার পর সবে মাত্র আসতে শুরু করেছে কিছু ফ্রিজ, ওভেন, ক্যাটেলিং ইত্যাদি। আমাদের এখন পর্যন্ত নেই কোন হাউজকিপিং ল্যাব, রিসার্জ সেল। ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ক্লাস করানো হয় কোন সামগ্রী ছাড়া। এছাড়া এখন পর্যন্ত কয়েকটি হোটেল পরিদর্শন করানো হলেও কোন আধুনিক মানের হোটেলেও নিয়ে যাওয়া হয়নি।

এই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রবির কুমার সকল সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে বলেন, আমি বারবার শিক্ষক চেয়েও ব্যর্থ হয়েছি। এছাড়াও বারবার প্রশাসনের কাছে প্রাকটিক্যাল পণ্য চেয়েও পাই না। তবে এখন কিছু কিছু পণ্য আসছে।  
বিশ্বে কারিগরি শিক্ষাকে জোড় দিয়েছে ব্যাপক। চীন কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারে খুবই তৎপর দেশগুলোর একটি। ২০০১ সালে চীনে ১৭ হাজার ৭৭০ টি কারিগরি প্রতিষ্ঠান ছিলো। যাতে অধ্যয়নরত ছিলেন ১ কোটি ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করতেন। তাদের কারিগরি শিক্ষার প্রসারের ফলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের পণ্য।

আর বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী লেদার, প্লাস্টিক, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইল, এয়ারলাইনস, নার্সিং এসবে চাহিদা থাকলেও তৈরি হচ্ছে না যথেষ্ট। ফলে বিশ্বে বাংলাদেশে থেকে দক্ষ শ্রমিক যোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সিঙ্গাপুরে ইলেকট্রেশিয়ান হিসেবে দীর্ঘ ৮ বছর ধরে কাজ করেন তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমারা এখানে এসে কাজ শিখেছি। অন্যান্য দেশ থেকে যারা আসেন তারা কাজ শিখে আসেন। যার কারণে তাদের বেতন আমাদের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। দীর্ঘ দিন কাজ করবার কারণে আমরা তাদের থেকেও অধিক দক্ষ। কিন্তু তারপরেও তাদের অধীনে কাজ করতে হয় আমাদের। তিনি আরো বলেন, সিঙ্গাপুরে দক্ষ শ্রমিকের অনেক বেতন। মেলে সুবিধা। এখানে দক্ষ হয়ে আসছে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান থেকে। কিন্তু এই বাজারটা ধরতে ব্যর্থ হচ্ছি।

কারিগরি শিক্ষায় অনাগ্রহী হবার কারণ আছে অনেক। এরমধ্যে অন্যতম এসএসসি পাশের পর এইচএসসি’তে পড়তে হয় ২ বছর। আর ডিপ্লোমা কোর্স করতে হয় ৪ বছরে। সেইসঙ্গে সরকারিভাবে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম থাকায় আগ্রহ হারাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। আর রয়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরর সঙ্কট। শুধু রয়েছে একটি মাত্র ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (ডুয়েট)। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগের পক্ষে আর্থিক কারণে তা সম্ভব হয় না।  

কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের পরিদর্শক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল কুদ্দুস সরদার বলেন, আমাদের প্রধান সমস্যা আমরা যথেষ্ট পরিমাণ প্রণোদনা পাই না। ফলে আমাদের অবকাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। ল্যাবরেটরির সমস্যার পাশাপাশি একটি সমস্যা হচ্ছে বিশ্ব এতোটা এগিয়ে গেছে যে নতুন সারঞ্জাম আনার কয়েক বছর পরেই সেটি পুরনো হয়ে যাচ্ছে।

কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোরাদ হোসেন মোল্ল্যা কারিগরি শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা বলেন। এছাড়াও তিনি বলেন, আমরা অনেক কাজ হাতে নিয়েছি যা থেকে কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে গুনগত মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status