শেষের পাতা

পেট্রোলের আগুনে পুড়ে ছাই ওদের ঠিকানা

কামালপুর-হাজীপুরে সন্ত্রাসী থাবা

জাবেদ রহিম বিজন ও আমিরজাদা চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

১৬ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৯:০৪ পূর্বাহ্ন

আগুনে পুড়ে ছারখার সবকিছু। ঘরবাড়ি-গাছপালা বাঁচেনি কোনোটাই। আর তাতে সর্বস্বান্ত ৩০টি পরিবার। খোলা আকাশের নিচে এখন তাদের ঠিকানা। বইপত্র পুড়ে যাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশোনাও বন্ধ। বিলের মাছ ধরাতে বাধা হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের কামালপুর ও হাজীপুরে তাণ্ডব চালিয়েছে ইউপি সদস্য কাউসার আহম্মেদ ও হিরালালসহ আরো কয়েকজন। পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন তারা মানুষের ঘরবাড়িতে। ভয়াবহ এই ঘটনার শিকার হওয়াদের একজন জোসনা। আক্রোশের আগুন সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে তাকে। দু’মেয়ে আর তার পরনের কাপড় ছাড়া বাঁচেনি কোনো কিছুই। বই-স্কুল ড্রেস, সবই পুড়ে ছাই হয়েছে মেয়ে দু’টির। এখন দূরে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। অমানবিক এই ঘটনায় মামলা দিতে গেলে থানায় মামলাও নেয়নি। ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের দুর্দশার বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানিয়েও ফল পাননি।

৩রা নভেম্বর হরষপুর ইউনিয়নের বিল হুগলী নিয়ে বিরোধে জড়ায় দু’-পক্ষ। ওই সময় পেট্রোল ঢেলে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেন বিলের ইজারাদাররা। এর আগে ২রা নভেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপরও হামলা হয়। আহত হয় কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এ সময় ১১৬ রাউন্ড রাবার বুলেট, টিয়ার সেল ও পিস্তলের গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ।
সরজমিন গিয়ে জানা গেছে- এই বিল নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা দীর্ঘদিনের। বিলের সীমানা নির্ধারণ না করে বিল ইজারা দিয়ে প্রশাসন আগুনে ঘি ঢালার মতো ব্যাপার করেছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সুপারিশ উপেক্ষা করে আগের মতোই বিল ইজারা দেয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবার। বড় উঠান মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে ওই বিল গত বছরের জুন মাসে জেলা প্রশাসন তথা জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি ইজারা দেয়। বাংলা ১৪২৫ থেকে ১৪২৭ সাল পর্যন্ত ৩ বছরের জন্য ২৪ একর ৮৮ পয়েন্ট আয়তনের এই বিলের ইজারা মূল্য নেয়া হয় ১ লাখ ৫১ হাজার টাকা। অভিযোগ রয়েছে বড় উঠান সমিতির সভাপতি হীরালাল ইজারা নিয়ে সেটি আবার ৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন বুল্লা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য ফুল ইসলাম ও তার ছেলে বর্তমান ইউপি সদস্য কাউসার আহম্মেদের কাছে। তারা কৃষকদের ব্যক্তিগত জমি থেকে মাছ আহরণ শুরু করলে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়।

হাজীপুর গ্রামের বদরুল আলম খান জানান-হুগলী বিল থেকে মাছ ধরা নিষেধ করে দেড়মাস আগে আদালত আদেশ দেয়। তারপরও বুল্লার কাউসার মেম্বারের নেতৃত্বে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরা চলতে থাকে। ২রা নভেম্বর তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইউএনও এবং ওসি’র ওপর আক্রমণ করে। পরদিন জোর করে মাছ ধরার সময় হাজীপুর, পাইকপাড়া বাগদিয়া ও বুল্লার মানুষের সঙ্গে ঝগড়া হয়। তিনি জানান- বিলে সরকারি অংশ অনেক কম। আমাদের জায়গা-জমিই বেশি। কিন্তু আমরা বারবার আবেদন-নিবেদন করলেও প্রশাসন সেটা পরিমাপ করেনি। হরষপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম জানান- বুল্লা, বড় উঠান, বড়ছাল, নয়াহাটি ও মাইঝপাড়ার ৭/৮শ’ লোক একত্রিত হয়ে নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর এই ঘটনার নেতৃত্ব দেন বোল্লার সাবেক ইউপি সদস্য ফুল ইসলাম, তার ছেলে বর্তমান ইউপি সদস্য কাউসার আহমেদ, আশু মিয়া, হীরা লাল, নারায়ণ দাশ ও আজিজুল। কামালপুর গ্রামের ফুল মিয়ার ৫টি ঘরই পুড়ে গেছে আগুনে। ফুল মিয়া ও তার ছেলে জজ মিয়া জানান- তাদেরকে প্রথমে মারধর করা হয়। পরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বিলের বিরোধের সঙ্গে তারা জড়িত নয় বলে জানান। কিন্তু এখন তাদেরকে বাড়ি ছাড়া করার হুমকি দেয়া হচ্ছে। নাসিরের স্ত্রী জেসমিন আক্তার বলেন- বিলের ঝগড়ায় আমাদের সব শেষ। কোনো মালপত্র ঘর থেকে সরানোর সুযোগ পাইনি। আশু এসে হুমকি দিতাছে- ‘বাড়িতো পুড়ছি, এখন দেশছাড়া করমো’। সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী ফলেজা খাতুন ও ফায়েজ মিয়ার স্ত্রী সাবিনা বলেন- আমরা অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি।

বই খাতা পুড়িয়ে ফেলায় ছেলেমেয়েরা পড়াশুনায় যেতে পারছে না। জোসনার স্বামী নেই। দু’- মেয়ে নিয়ে কষ্টের সংসার তার। স্বামী আরিজ মিয়া মারা যাওয়ার পর নানা টানাপোড়েনে জীবন-জীবিকা করছিলেন। তার দু’টি ঘরই পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এখন ছাই ছাড়া কিছুই নেই ঘরের। বলেন- আমি ঘরেই ছিলাম। আমাকে মারধোর করে ঘর থেকে বের করে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। কতো কষ্ট করে এগুলো জমাইছিলাম বলেই কাঁদতে শুরু করেন তিনি। হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েন তার এক মেয়ে আরমিন। আরেক মেয়ে শারমীন আক্তার পড়েন হাজীপুর ইসলামিয়া সুন্নি দাখিল মাদ্রাসায়। শারমিন বলেন- আমার বইখাতা সব পুড়ে গেছে। কীভাবে পরীক্ষা দিমু। এইটের সার্টিফিকেট পুড়ে গেছে। আগুনে ঘর পুড়েছে ফুল ইসলাম, আশ্রাফ আলী, আক্কাস মিয়া, মুখলেছ মিয়া, ছায়েদ মিয়া, হাকিম মিয়া, কালা মিয়া, ছুট্টু মিয়া, সাদু মিয়া, হীরা মিয়া, ফুল মিয়া, জজ মিয়া, ফায়েজ মিয়া, আলী আহমদ, রাজিয়া বেগম, শামীম মিয়া, জামাল মিয়া, নূর মিয়া, রফিয়া খাতুন, জোসনা বেগম, আবদুল হামিদের। ঘরবাড়ি নির্মাণ ও মালামালের ক্ষয়ক্ষতির জন্যে তারা ঘটনার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটি আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু প্রশাসন এ ব্যাপারে সারা দেয়নি। ঘটনার পর থেকে খোলা আকাসের নিচেই আছেন এসব মানুষ। থানা মামলাও নেয়নি এ ঘটনার। পরে ৬ নভেম্বর কামালপুর গ্রামের আলী আহম্মদ বাদী হয়ে আদালতে একটি মামলা দেন।

এতে ফুল ইসলাম, তার ছেলে কাউসার আহম্মেদ, হীরা লাল, আজিজুল বিল্লাল মিয়া, সহিদুল ইসলাম, কাজী তাহের মিয়া, আলী মিয়া এদেরকে আসামি করা হয়। থানায় মামলা না নেয়ার বিষয়ে সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল কবির বলেন- তারা যে অভিযোগ দিয়েছিলো তাতে অতিরিক্ত লেখা হয়েছে, সেজন্যে মামলা হয়নি। তিনি বলেন একটু প্রেসারে থাকুক, সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রেসারে থাকলে ভবিষ্যতের জন্যে ভালো হবে। অবশ্য পুলিশ বাদী হয়ে হাজার-বারোশ’ লোকের বিরুদ্ধে ২রা নভেম্বর পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় একটি মামলা করে। ওই মামলায় নির্বিচারে ধরছাড় বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলে এসআই জাহাঙ্গীর আলমকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়।
নেপথ্যের ঘটনা: বুল্লা বড় উঠান মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের বিল হুগলী ফিসারি জলমহালের ইজারা নিয়ে দেনদরবার চলছে অনেক দিন ধরেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ভুক্তভোগীরা প্রথমে একটি আবেদন করে বুল্লা বড় উঠান মৎস্যজীবী সমিতিকে ইজারা না দেয়ার এবং জলাশয়ের সীমানা নির্ধারণ করার দাবি জানান। তাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কাও ব্যক্ত করা হয়। এরপর ৫শ’ লোকের স্বাক্ষর নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে ৪ নং ওয়ার্ডের সদস্য আবুল কাশেম, ৫ নং ওয়ার্ডের মো. আবু হানিফ, ৬ নং ওয়ার্ডের সিরাজুল ইসলাম, ৩ নং ওয়ার্ডের মো. মধু মিয়া একটি আবেদন করেন। তাতে বলা হয় সেখানে থাকা তাদের মালিকানাধীন কৃষি জমিতে প্রতিবছর একবার ফসল ফলান। কিন্তু ইজারাদাররা সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে জমি ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানাধীন ডোবা ও পুকুরের মাছ ট্যালেট ও বিষপ্রয়োগ করে ধরে নিয়ে যায়। তাছাড়া মেশিনের সাহায্য শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে জমিতে চাষাবাদ করতে পারেন না তারা। সেখানে ৩ হাজার লোকের জমি রয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়।

গত বছর মার্চে এমন একাধিক আবেদন করা হয় জেলা প্রশাসকের কাছে। যাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ভূঁইয়া এবং স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানও সুপারিশ করেন। এইসব আবেদনে করা অভিযোগের সত্যতাও পান প্রশাসনের এক কর্মকর্তা তদন্তে এসে। কিন্তু তারপরও অজ্ঞাত কারণে ওই সমিতিকেই ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। পরে গত বছরের অক্টোবরে পাইকপাড়ার আবুল কাশেমসহ ৮৫ জন বাদী হয়ে বুল্লা বড় উঠান মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি, হরষপুর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি, বিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব ও জেলা প্রশাসককে বিবাদী করে আদালতে দেওয়ানি মোকদ্দমা (নং ৩৩০/২০১৮ ইং) দায়ের করেন। এ বছরের ১৪ই অক্টোবর সিনিয়র সহকারী জজ আলমগীর আল মামুন মোকদ্দমা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মৎস্য আহরণ থেকে বিরত থাকার আদেশ দেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান বলেন- বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status