এক্সক্লুসিভ

ওদের সান্ত্বনা দেবে কে?

রোকনুজ্জামান পিয়াস ও সজল আহাম্মদ খান, কসবা (ব্রাহ্

১৩ নভেম্বর ২০১৯, বুধবার, ৭:৩৩ পূর্বাহ্ন

নির্বাক রুহুল আমিন মোল্লা। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। একেবারে ভাবলেশহীন। মুখে কোনো কথা নেই। শুধু চেয়ে আছেন। মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন। সেই চাহনিতে রাজ্যের যন্ত্রণা। পাশেই বসে তার ছোট মেয়ে তিথি মনি। বয়স ২৫ হবে হয়তো। তার আহাজারিতে হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে উপস্থিত মানুষের। একনাগাড়ে বিলাপ করছেন তিনি। কেউ কেউ সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো কিছুই তার মর্মস্পর্শী আহাজারি থামাতে পারছে না। কখনো বিলাপ, কখনো শুধু কেঁদেই চলেছেন। একই স্থানে বসে রয়েছেন জাহাঙ্গীর। মাঝে মাঝে এর-ওর সঙ্গে কথা বলছেন, মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। এই তিনজনই অপেক্ষা করছেন একজোড়া লাশের। এদের একজন মজিবুর রহমান, অন্যজন কুলসুম। সম্পর্কে তারা স্বামী-স্ত্রী। সোমবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে তাদের। অপেক্ষারত নুরুল আমিন কুলসুমের পিতা, তিথি মনি ছোট বোন আর জাহাঙ্গীর কুলসুমের দেবর অর্থ্যাৎ মজিবুরের ছোট ভাই । তারা সবাই দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বায়েক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখা মজিবুর-কুলসুম দম্পতির লাশ গ্রহণ করতে এসেছেন। লাশ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতার জন্য অপেক্ষা তাদের। শুধু মুজিবুর-কুলসুমের স্বজনই নয়। লাশের জন্য সেখানে ভীড় করেন দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো মানুষজন। এ অপেক্ষা তাদের গতকাল সকাল থেকেই।

বেলা তখন তিনটা। ওই সময়ের মধ্যে অনেকেই তাদের স্বজনের লাশ নিয়ে গেছেন। কয়েকটি লাশ তখনও হস্তান্তর করা হচ্ছিলো। আবার কারো কারো স্বজন বায়েক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে পৌঁছাননি। দুর্ঘটনাস্থল কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলস্টেশন এলাকার চাঁন্দখোলায় সরজমিনে এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে। মর্মান্তিক এ ঘটনার শোক শুধু নিহতের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এলাকা ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষজনকেও নাড়া দেয়। তারা চোখের পানি ফেলেছে। মনে হয়েছে লাশগুলো নির্দিষ্ট কোন পরিবার বা এলাকার না। নিহতরা তাদের অতি আপনজন।

সোমবার রাত ২টা ৫০ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তুর্ণা নিশিতা ও সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং অসংখ্য আহতের ঘটনা ঘটেছে। সরজমিনে দেখা যায়, দুর্ঘটনাস্থলের সবচেয়ে কাছের বাড়িটি লেবানন প্রবাসী জাহের মিয়ার। সমপ্রতি লেবানন থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। দুর্ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৫০ গজের মতো দূরত্বে তার বাড়িটি। স্বাভাবিকভাবে তারাই প্রথম দুর্ঘটনার বিষয়টি জানতে পারেন। ঘটনাস্থলেও এ পরিবারের লোকজনই প্রথম ছুটে আসেন।

জাহের মিয়ার ভাষায়, তখন তারা গভীর ঘুমে। হঠাৎ এক বিকট শব্দে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। রেল লাইনের দিক থেকে চিৎকার আর আহাজারি ভেসে আসে। এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে ছুটে যান রেল লাইনের দিকে। গিয়ে দেখেন ট্রেনের তিনটি বগি উল্টে পড়ে আছে। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, কেউ কেউ জানালা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তবে তাদের বেশিরভাগই আটকা পড়েছে ট্রেনে। ভোরের আলো ফুঁটতে তখনও বেশ দেরি। অন্ধকার চারিদিক। এরমধ্যে আশেপাশের এলাকা থেকে আরও অনেকেই ছুঁটে এসেছেন। তারা মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখার চেষ্টা করছেন। ওই আলোতেই তারা উদ্ধার কাজ শুরু করে দেন। একজনকে বের করলেই পাশের জনের আকুতি তাকে উদ্ধারের। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিজিবি, তারও কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল। স্থানীয়রা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিসের দল মিলে উদ্ধার কাজ চলে সকাল পর্যন্ত। জাহের মিয়া বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের বগিতে বেশিরভাগই নারী যাত্রী ছিলো বলে তাদের মনে হয়েছে। এরই মধ্যে এক নারীর দুই পা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দেখতে পান।

তারা তাকে উদ্ধার করেন। দুই পা হারালেও তিনি জীবিত ছিলেন বলে জানান। জাহের মিয়া, তার ভাতিজা শরিফুল ইসলাম মিলে একে একে উদ্ধার করেন ২৫-৩০ জনকে। তবে কোন মৃতদেহে হাত দেননি তারা। এভাবে উদ্ধারকারীদলের সঙ্গে পুরোদমে যোগ দেয় এলাকাবাসী। যারা নিজে নিজে ট্রেন থেকে বের হয়ে এসেছিলেন এবং সুস্থ্য অবস্থায় যাদেরকে উদ্ধার করা হয়েছিলো, তাৎক্ষণিকভাবে তারা আশেপাশের বাড়িতেই অবস্থান করেন। বাড়ির নারী সদস্যরা তাদের সেবা করেছেন। পানি পান করিয়েছেন, ক্ষত স্থানে মলম লাগিয়ে দিয়েছে। এভাবেই নিরবে চলেছে তাদের মানবসেবা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা যায়, ঘটনাস্থল থেকে কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গেলেও মালিক পাওয়া যায়নি। এসব মালামালের মালিক বেঁচে আছে না মারা গেছে তাও জানা নেই। এমনই একটি লাগেজ পাওয়া যায় ঘটনাস্থলের অদূরে। সেই লাগেজে রয়েছে একটি পুরাতন লুঙ্গিসহ পুরাতন শীতের কাপড়। একজোড়া পুরাতন কেড্‌স।

এছাড়া ব্যাগের মধ্যে ছিলো একটি জাতীয় পরিচয়পত্র, ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যায়নপত্র। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ-ই এর মালিকের দেখা পাননি। জতীয় পরিচয়পত্র এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দেয়া প্রত্যয়ন অনুযায়ী, ওই ব্যাগের মালিকের নাম আতর আলী, পিতা- আসব আলী, জন্ম-১৯৩৭ সালের ১১ই অক্টোবর, বাড়ি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার ডুলটির পাড় গ্রামে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো তিনি বেঁচে আছেন। হাসপাতালের তথ্য অনুয়ায়ী, আতর আলী প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। তবে হাসপাতালের দেয়া তথ্যানুযায়ী, পিতার নাম এবং স্থায়ী ঠিকানার সঙ্গে মেলেনি। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আতর আলীর বয়স ৭০। পিতার নাম আশরাফ আলী, বাড়ি, দূর্গাপুর, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী।

দুর্ঘটনায় নিহতের লাশ রাখা হয়েছে স্থানীয় বায়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে রাখা ১৬ লাশ। সরজমিনে সেখানে গিয়ে চোখে পড়ে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যে। বেলা তিনটার দিকে দেখা যায়, একজোড়া লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন, বৃদ্ধ নুরুল আমিন, তার ছোট মেয়ে তিথি মনি এবং তার মেয়ের দেবর জাহাঙ্গীর। নুরুল আমিনের মেয়ে কুলসুম এবং জামাই মজিবুর রহমান দু’জনই এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। জাহাঙ্গীর জানান, তাদের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার নাটেহড়া গ্রামে। তার ভাই নিহত মজিবুর ব্যবসা করেন। তিন ছেলে রয়েছে নিহত এই দম্পতির। বড় ছেলেটার বয়স ১৮, মেজো ছেলেটার ১৫ আর ছোট ছেলের বয়স ১৩ বছর। জাহাঙ্গীর জানান, তার ভাই-ভাবী গত ১৫ দিন আগে শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে যান। সেখান থেকেই ফিরছিলেন সোমবার রাতে। তিনি বলেন, ভোর ৪টায় তার ভাইয়ের মোবাইল থেকে ফোন করে তাদের মৃত্যুর সংবাদ দেয়া হয়। সে খবর পেয়েই ছুটে আসেন স্বজনরা। ঘরে তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা। তিন সন্তান। এ ঘটনায় গ্রামের লোকজনের মধ্যে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। জাহাঙ্গীর বলেন, বৃদ্ধ পিতা-মাতা এবং তিন সন্তানকে কিভাবে তারা সামলে রাখবেন? কুলসুমের ছোট বোন মনি এক নাগাড়ে বিলাপ করে যাচ্ছেন। তার কান্না-আজাহারিতে  বায়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের উপস্থিত মানুষের চোখেও পানি চলে আসে। আর নুরুল আমিন? তিনি একেবারেই নিরব। যেনো বোধশক্তিহীন এক মানুষ।

এদিকে, ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে এর আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে তাদের দেখা, এটাই সবচেয়ে বড় এবং মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। তাদের ভাষ্য, কর্তৃপক্ষ সচেতন হলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না। এদিকে ঘটনাস্থলে থাকা তুর্ণা নিশিতার সম্মুখভাগ চালকের স্থানে ছোপ ছোপ দাগ লেগে থাকতে দেখা গেছে। এই চালকের ভাগ্যে কি ঘটেছে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তা জানা যায়নি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status