বিশ্বজমিন

আতঙ্কে বিলিয়নিয়াররা!

নাজমুল আহসান

১২ নভেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১০:৫৭ পূর্বাহ্ন

আটলান্টিকের দু’ পাড়ে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যে শ’ শ’ কোটি ডলারের মালিক ধনকুবেরদের উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে! যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ক্রমেই অবস্থান পোক্ত হচ্ছে প্রগতিশীল দুই মনোনয়ন প্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স ও এলিজাবেথ ওয়ারেনের। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দুই জনের অবস্থানে এতটাই মিল যে তাদেরকে পৃথক করা খুব কঠিন। জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে ওয়ারেন আর মধ্যমপন্থী মনোনয়ন প্রত্যাশী ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে শীর্ষস্থানের লড়াই হচ্ছে। খানিকটা পেছনেই আছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তবে স্যান্ডার্স ও ওয়ারেন একে অপরকে আক্রমণ করছেন না বললেই চলে। ব্যক্তিজীবনেও ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই দুই মার্কিন সিনেটর।
নিউ ইয়র্ক থেকে নির্বাচিত আলোচিত কংগ্রেস সদস্য আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও কোর্তেজ যখন বার্নি স্যান্ডার্সকে সমর্থন দিলেন, তখন এলিজাবেথ শিবিরের এক শীর্ষ কর্তা বললেন, আমাদের খুব হিংসে হচ্ছে! কিন্তু এ-ও সত্য, দিনশেষে আমরা এক শিবিরেরই।
কোর্তেজ কংগ্রেস সদস্য হওয়ার আগে বার্নি স্যান্ডার্সের গত বারের নির্বাচনী শিবিরের সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্যে রসায়ন তুঙ্গে। তিনি জবাবে লিখলেন, ওয়ারেন খুবই চমৎকার একজন প্রার্থী। আমরা ভাগ্যবান যে আমরা একসঙ্গে স্যান্ডার্স ও তাকে পেয়েছি। দিনশেষে আমরা আসলে এক শিবিরের হয়েই লড়বো।
দুই শিবিরের এমন মনোভাব থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে, নির্বাচনী প্রচারণার শেষের দিকে ওয়ারেন বা স্যান্ডার্স - দু’ জনের একজন হয়তো সরে যাবেন। আর সমর্থন দেবেন অপরজনকে। সেই হিসাবে দেখলে বলা চলে, বাইডেনের চেয়ে অনেকখানিই এগিয়ে আছে প্রগতিশীল শিবির। ফলে এই দুই প্রগতিশীল প্রার্থীর মধ্যে একজন ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন, এমন সম্ভাবনা প্রবল। আর বর্তমান জরিপ অনুযায়ী, ডেমোক্রেট দলের যেকোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধেই নির্বাচনে পরাজিত হবেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য পরে এই চিত্র পালটে যেতে পারে। কিন্তু স্যান্ডার্স বা ওয়ারেনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা আমেরিকার শীর্ষ ধনীরা মোটেই হালকাভাবে নিচ্ছেন না।
স্যান্ডার্স ও ওয়ারেনের অসংখ্য অভিন্ন নীতিমালার মধ্যে একটি হলো ‘ওয়েলথ ট্যাক্স’। অর্থাৎ, আয়ের ওপর নয়, সম্পদের ওপর করারোপ। যারা শ’ শ’ মিলিয়ন ডলার থেকে বিলিয়ন ডলারের মালিক তাদের সম্পদের ওপর কর আরোপের কথা বলছেন স্যান্ডার্স ও ওয়ারেন। সেখান থেকে যেই বিপুল পরিমাণ কর আদায় হবে, তা দিয়ে ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার বা সকল নাগরিকের জন্য সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা চালুর কথা বলছেন তারা। আর তাতেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বিলিয়নিয়ারদের কপালে।
বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ও মাইক্রোসফটের চেয়ারম্যান বিল গেটস সেদিন বললেন, শীর্ষ ধনীদের ওপর ওভাবে করারোপ করা হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। বিলিয়নিয়ার বিনিয়োগকারী লিও কুপারম্যানও বললেন একই কথা। তবে আরও চাঁছাছোলা ভাবে। তার মতে, ওয়ারেনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ‘আমেরিকান ড্রিম’ ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম ব্যাংকগুলোর একটি জেপিমরগ্যান চেজ-এর প্রধান নির্বাহী জেমি ডিমন টেলিভিশনে এসে বললেন, ধনীদের সম্পর্কে ওয়ারেনের মন্তব্য অনেক কর্কষ। অনেকে হয়তো বলবেন, ওয়ারেন রীতিমতো ধনীদের বিরুদ্ধে দ্বেষ জাগিয়ে তুলছেন। এ নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখেছে, যার শিরোনাম: ‘দ্য বিলিয়নিয়ার্স আর গেটিং নার্ভাস’।
ওদিকে সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়ারেন যদি মনোনয়ন পেয়ে যান, তাহলে ডেমোক্রেট দলকে অর্থ বন্ধ করা, এমনকি ট্রাম্পকে সমর্থন দেওয়ার কথাও চিন্তা করছেন ওয়াল স্ট্রিট ও বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ডেমোক্রেট দাতারা।  
বিলিয়নিয়াররা ডেমোক্রেট দলীয় এই দুই প্রার্থীকে নিয়ে কতটা আতঙ্কে আছেন, তার একটি চিত্র পাওয়া যায় পরিসংখ্যান থেকে। ওয়ারেন ও স্যান্ডার্স ছাড়া আরেক প্রার্থী উদারপন্থী শিবিরে জনপ্রিয় হচ্ছেন। তিনি হলেন প্রথম সমকামী মনোনয়ন প্রত্যাশী পিট বুটিগেগ। সমকামী অধিকার সহ কিছু ইস্যুতে জনপ্রিয় হওয়া বুটিগেগ আবার ধনীদের ওপর করারোপ ও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ইস্যুতে ওয়ারেন ও স্যান্ডার্সের সঙ্গে একমত নন। মার্কিন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের উপাত্তের বরাতে ফোর্বস জানিয়েছে, উদীয়মান প্রার্থী বুটিগেগের নির্বাচনী তহবিলে অর্থ ঢেলেছেন ২৩ জন বিলিয়নিয়ার! আরেক মধ্যপন্থী প্রার্থী করি বুকারের তহবিলে দিয়েছেন ১৮ জন, কামালা হ্যারিসকে ১৭ জন, বাইডেনকে ১৩ জন, অ্যামি ক্লোবুচারকে ৮ জন। সেই তুলনায় ওয়ারেনকে দিয়েছেন ৩ জন বিলিয়নিয়ার। আর স্যান্ডার্সকে একজনও দেননি! স্যান্ডার্সের পুরো তহবিল চলছে স্বল্প অঙ্কের অনুদানের ভিত্তিতে। লাখ লাখ দাতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুদানের অর্থে তৃণমূল প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন স্যান্ডার্স।
ওদিকে শোনা যাচ্ছে নিউ ইয়র্ক শহরের সাবেক মেয়র ও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ধনকুবের বিলিয়নিয়ার মাইকেল ব্লুমবার্গ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে নামার কথা চিন্তাভাবনা করছেন। অথচ, ব্লুমবার্গ এ বছরের শুরুতেই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের কথা নাকচ করে দিয়েছিলেন। খবর প্রকাশ হয়েছে যে, ব্লুমবার্গকে নাকি একবার নির্বাচন করতে উৎসাহিত করেছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজস। এক বিলিয়নিয়ারকে আরেক বিলিয়নিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে বলছেন, এ নিয়ে খোঁচা দিতে একদমই দেরি করেননি স্যান্ডার্স। ব্যাঙ্গ করে বলেছেন, এ হলো তাদের মধ্যে ‘শ্রেণী সংহতি।’
জেফ বেজস ও অ্যামাজন নিয়ে অনেকদিন ধরেই সোচ্চার ছিলেন স্যান্ডার্স। অ্যামাজনের কর্মীদের স্বল্প বেতন নিয়ে তার আন্দোলনের কারণেই বেতন বাড়াতে বাধ্য হয় প্রতিষ্ঠানটি। আজীবন বামপন্থী রাজনীতি করে আসা স্যান্ডার্স সবসময়ই ধনীদের ওপর আয়কর বৃদ্ধির কথা বলে এসেছেন। আমেরিকায় বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিলিয়নিয়াররা তাদের আয় ও সম্পদের তুলনায় অনেক কম আয়কর দিয়ে থাকেন। অনেক বিলিয়নিয়ার নাকি একজন মধ্যবিত্তের চেয়েও কম আয়কর দেন!
স্যান্ডার্সের মতে, কোনো সমাজে বিলিয়নিয়ারদের অস্তিত্বই থাকা উচিৎ নয়। তিনি এই স্লোগান নির্বাচনী পোস্টারেও ব্যবহার করছেন! এ নিয়ে আমেরিকায় বিতর্ক শুরু হয়েছে যে, একটি অর্থনীতিতে বিলিয়নিয়ারদের অস্তিত্ব থাকা উচিৎ কিনা। অপরদিকে উদারপন্থী বলে পরিচিত ওয়ারেন দীর্ঘদিন ধরেই আমেরিকার বৃহৎ ব্যাংক ও ধনীদের নাস্তানাবুদ করে আসছেন সিনেট শুনানিতে। এছাড়া ওয়ারেন বলে আসছেন যে, অত্যন্ত বৃহৎ যেসব ব্যাংক ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বাজারে মনোপলি বা একাধিপত্য ভোগ করে, তাদেরকে কয়েকভাগে ভাগ করা উচিৎ। এই তালিকায় ছিল ফেসবুকও। আর এ নিয়ে ওয়ারেনের ব্যাপারে এক অভ্যন্তরীণ বৈঠকে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী ও পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনী মার্ক জাকারবার্গ।
ওদিকে আটলান্টিকের অপর পাড়ে যুক্তরাজ্যেও শান্তিতে নেই বিলিয়নিয়াররা। সেখানে ইতিমধ্যেই আগাম নির্বাচনের প্রচার শুরু হয়েছে। বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। নিজের বন্ধু স্যান্ডার্সের মতো এই বৃদ্ধ বামপন্থী নেতাও বলছেন, ধনীদের ওপর ট্যাক্স বাড়ানো হবে বহুগুণ। আয়কর এড়ানোর ফাঁকফোকরও বন্ধ করা হবে। স্যান্ডার্সের সঙ্গে সুর মিলিয়েই তিনি টুইট করে বললেন, ‘যুক্তরাজ্যে ১৫০ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। অথচ, এই যুক্তরাজ্যেই ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যে বসবাস করে। সমাজ যদি সাম্যের হতো, তাহলে কোনো বিলিয়নিয়ারই থাকতো না। আর কাউকেই দারিদ্র্যে বসবাস করতে হতো না।’
আর সেদিনই গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, করবিন নির্বাচিত হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজেদের ব্যবসা-সম্পত্তি যুক্তরাজ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন শীর্ষ ধনীরা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status