দেশ বিদেশ

বায়েজিদ পরিবারের সুইসাইড এবং কিছু কথা

ডা. আলী জাহান

৭ নভেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:২৭ পূর্বাহ্ন

১০ই অক্টোবর ছিল বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। বাংলাদেশে এ দিবসের সবচেয়ে করুণ এবং মর্মান্তিক কাহিনী হলো ঢাকার মিরপুরে গার্মেন্ট মালিক বায়েজিদ সাহেব, তার স্ত্রী ও কলেজ পড়ুয়া ছেলের একই সঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনা। এটিকে মেডিকেলের ভাষায় সুইসাইড প্যাকট (Suicide pact) বলা হয়।

পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, বায়েজিদ সাহেব গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আর তার স্ত্রী কোহিনূর এবং ঢাকা কমার্স কলেজে অধ্যয়নরত ছেলে ফারহান বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে স্ত্রী এবং সন্তানকে বিষ খাইয়ে নিজে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। গা শিউরে ওঠার মতো সংবাদ। এ খবর তেমন কাউকে আলোড়িত করেনি বলেই মনে হচ্ছে। কাউকে এ নিয়ে কথা বলতে দেখলাম না। না পত্রিকা, না ফেসবুক, না টকশোয়। জাঁদরেল সব মনোবিজ্ঞানীর এ নিয়ে কোনো লেখাও চোখে পড়েনি। দেশে প্রতিদিন এতো হত্যা, আত্মহত্যার খবরের ভিড়ে বায়েজিদ পরিবারের আত্মহত্যা নিয়ে কার সময় আছে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার? অকালমৃত্যু বাংলাদেশে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ যেন পাথর হয়ে গেছে। হত্যা আর আত্মহত্যার খবর পড়তে পড়তে মনুষ্যত্ববোধ এখন বিদায় নিয়েছে। প্রশ্ন হলো এ ভয়াবহ আত্মহননের ঘটনা বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের দিনে কেন হলো? আসলে স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক সবকিছুতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। যেহেতু প্রেম-ভালোবাসা বা রাজনীতি- এ তিনটির কোনোটাই এ আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িত নয়, তাই এ নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। আলোচনা অনুষ্ঠান নেই, মানববন্ধন নেই, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি নেই, টিভিতে ফলোআপ সংবাদ নেই। কথা বলার কেউই নেই। বায়েজিদ সাহেবের মৃত্যুর ঘটনা অনেক কারণেই আলোচনার দাবি রাখে। বায়েজিদ সাহেব একজন সফল গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। তার একটি সুখের সংসার ছিল। ভালো কলেজে পড়াশোনা করা ছেলে ছিল। শিক্ষিত স্ত্রী ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার একটি ব্যাংক ঋণ ছিল। এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সে ঋণের টাকাই বায়েজিদ সাহেব এবং তার পরিবারের আত্মহননের কারণ।

মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? একজন সুস্থ-সবল মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে না। আত্মহত্যার পেছনে মানসিক কোনো না কোনো সমস্যা বা রোগ যেমন অস্থিরতা, বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার ইত্যাদি থাকতেই হবে। কখনো তা বাইরে থেকে দেখা যায় আবার কখনো তা বাইরে থেকে দেখা যায় না। মানুষ ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে। আত্মহননের মাধ্যমে সে প্রজ্বলনের সমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারছেন না এ সংখ্যা হাজার হাজার। কিন্তু সবাই তো বায়েজিদ সাহেবের মতো পরিবারসহ আত্মহননের পথে পা বাড়ায়নি। তার মানে বায়েজিদ সাহেবের মনোজগতে এমন কিছু ছিল- যা ঋণগ্রস্ত অন্য যারা আত্মহত্যা করছে না তাদের মধ্যে ছিল না। আর সেই ‘অন্য কিছু’ ডায়াগনোসিস করা এবং সে অনুসারে বায়েজিদ সাহেবকে সহায়তা করা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব ছিল। পত্রিকার ভাষ্যমতে, বায়েজিদ সাহেব গত কয়েক মাস ধরে গার্মেন্ট ব্যবসায় ক্ষতির মধ্যে ছিলেন। তার কিছু ব্যাংক ঋণ ছিল। ঋণ পরিশোধে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। এ থেকে ধরে নেয়া যায়, ঋণের কারণে তিনি মানসিক অস্থিরতা ও বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। অথচ তার থেকে আরো অনেক বড় বড় বিপদ নিয়েও লোকজন আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে না। তাহলে বায়েজিদ সাহেব পরিবার নিয়ে কেন এই মর্মান্তিক পথে পা বাড়ালেন? পরিকল্পনা করে স্ত্রী এবং সন্তানসহ কেন তিনি আত্মহত্যা করলেন? তার মানে হলো বায়েজিদ সাহেবের মনোজগতে এমন কিছু ঘটেছিল বা মানসিকভাবে তিনি আত্মহত্যার প্রবণতার মধ্যে ছিলেন যা অন্যদের ক্ষেত্রে হয়তো নেই। যদি আমরা এ ঝুঁকিকে আগেই নির্ণয় করতে পারতাম তাহলে বায়েজিদ সাহেব, তার স্ত্রী এবং সন্তানসহ আত্মহননের পথে পা বাড়াতেন না। বলতে গেলে তার আত্মহত্যার সম্ভাবনাকে আমরা কমিয়ে আনতে পারতাম। হয়তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি এখনো জীবিত থাকতেন।

বায়েজিদ সাহেবের জন্য সমাজের কোনো ভূমিকা নেই? সোশ্যাল ওয়ার্কারের কোনো ভূমিকা নেই? আত্মীয় স্বজনের কোনো ভূমিকা নেই? বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের কোনো ভূমিকা নেই? যে ব্যাংক তাকে ঋণ দিয়েছে এবং সে টাকা উদ্ধারের জন্য তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে সেই ব্যাংকের কী কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আসা দরকার। শুধু মৃত শরীরের নয়, পুরো ঘটনার পোস্টমর্টেম হওয়া দরকার। ভুল থেকে আমাদের শিখতে হবে। না হলে ভুলের পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। প্রস্তুত থাকতে হবে পরবর্তী দুঃসংবাদ শোনার জন্য।

আচ্ছা, এ তিনটি আত্মহত্যা বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ডাক্তার, নার্স, সোশ্যাল ওয়ার্কার, সমাজ ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রের কাউকে কি জবাবদিহিতা করতে হবে? না, কাউকেই এজন্য জবাবদিহিতা করতে হবে না।

একই ঘটনা যদি বিলেতের মতো দেশে ঘটতো তাহলে কী হতো? এ প্রশ্ন খোঁজার আগে বৃটেনের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়া যাক। সেখানে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার নাম NHS-National Health Service. বৃটেনের প্রতিটি এলাকা বা গ্রাম বা ওয়ার্ডের জনসংখ্যা অনুপাতে অনেকগুলো মেডিকেল সেন্টার বা সার্জারি বা জিপি প্র্যাক্টিস থাকে। এ সেন্টারগুলোকে বাংলাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ের মেডিকেল সেন্টার হিসেবে তুলনা করা যায়। এ সেন্টারগুলোতে মূলত কম জটিল রোগের চিকিৎসা দেয়া হয় থাকে। রোগের ধরন জটিল বা মারাত্মক হলে এসব মেডিকেল সেন্টার থেকে হাসপাতালে কনসালটেন্টকে দেখানোর জন্য রেফার করা হয়। কোনো রোগীর পক্ষে সরাসরি হাসপাতালে কনসালটেন্টকে দেখানোর সুযোগ নেই। ব্যতিক্রম হলো ইমারজেন্সি। এক্ষেত্রে হঠাৎ করে কারো স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হলে তখন রোগী বা রোগীর লোকজন ৯৯৯-এ কল করলে অ্যাম্বুলেন্স এসে রোগীকে সরাসরি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাবে। রোগ যেহেতু জটিল তাই ইমার্জেন্সি বিভাগ থেকে রোগীকে মূল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর তখনই সংশ্লিষ্ট বিভাগের কনসালটেন্ট জরুরি ভিত্তিতে এ রোগীকে দেখবেন। এরকম পরিস্থিতি ছাড়া কোনো রোগীর পক্ষে সরাসরি কনসালট্যান্টকে দেখানোর সুযোগ নেই। রোগীর ব্যক্তিগত সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিচয়ও এ নিয়মের কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না।

আর মেডিকেল সেন্টারে শুধুমাত্র ওইসব রোগীকে দেখা হবে যারা মেডিকেল সেন্টারে বা জিপি প্র্যাকটিসে নিজেদের নাম রেজিস্ট্রি করেছেন। রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য এখানে কম্পিউটারে জমা থাকবে। অর্থাৎ যেকোনো মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে রোগীর নাম এবং জন্মের তারিখ দিলেই রোগের পুরো ইতিহাস সামনে চলে আসবে। বায়েজিদ সাহেব যদি বিলেতে থাকতেন, তাহলে কী হতো?
আমি নিশ্চিত তিনি প্রথমেই তার মেডিকেল সেন্টারের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতেন। ডাক্তার সাহেব যখন তার ঋণের কথা শুনতেন তখন সোশ্যাল সার্ভিসকে ফোন দিতেন। ডাক্তার সাহেবের কাছে যদি মনে হতো যে বায়েজিদ সাহেব আত্মহত্যা করতে পারেন তাহলে তাকে জরুরি ভিত্তিতে ইমারজেন্সি সাইকিয়াট্রি সার্ভিসে রেফার করতেন। সাইকিয়াট্রি সার্ভিসের ডাক্তার এবং নার্স তাকে ওই দিনই দেখতেন। সুইসাইডের ঝুঁকি থাকায় তাকে হয়তো হাসপাতালে ভর্তি করা হতো। ঋণের চাপ কমানোর জন্য তাকে Citizen Advice Bureau (CRB)-এ রেফার করা হতো। তারা জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলতো এবং বায়েজিদ সাহেবের ওপর চাপ দেয়া বন্ধ করতো। মানসিক চাপ কমানোর জন্য তাকে কিছু ওষুধ লিখে দেয়া হতো। হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন না হলে তাকে প্রতিদিন সাইকিয়াট্রি সার্ভিসের লোকজন ফোনে এবং সরাসরি দেখা করতো।

এরপরেও বায়েজিদ সাহেব আত্মহত্যা করলেন। তখন কী হতো?
প্রাথমিক মেডিকেল সেন্টারের ডাক্তার, নার্স, সোশ্যাল ওয়ার্কার, সেন্টারের ম্যানেজার, মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, মানসিক রোগের নার্স, মানসিক রোগের হাসপাতালের পরিচালক এবং ওয়ার্ডের ম্যানেজার, কমিউনিটিতে প্র্যাকটিসরত মেন্টাল হেলথ টিম এবং এর ডাক্তার, নার্স বা ম্যানেজারের অবস্থা কেমন হতো? এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর সবারই শান্তিতে রাতে ঘুম আসার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে যেত। তার কারণ হচ্ছে উপরে উল্লিখিত সবাইকে না হলেও অধিকাংশকেই একটি বিশেষ কোর্টে হাজির হতে হবে। প্রত্যেককেই জবাবদিহিতা করতে হবে। কোর্টের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কোনো অবহেলা ছিল কিনা তা বের করা। শুনানির পর কোর্ট প্রয়োজনে ভিকটিমের পক্ষ নিয়ে অন্যপক্ষকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিতে পারে। কারো দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা। ডাক্তার, নার্স, পুলিশ অফিসার বা হাসপাতাল পরিচালকের ব্যাপারে দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরি বডিতে রেফার করা। রেগুলেটরি বডি আরো তদন্ত করে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রফেশনালকে চাকরি থেকে বরখাস্ত বা আর্থিক জরিমানা অথবা দুটি একসঙ্গে করবে।

হতভাগ্য বায়েজিদ সাহেব যদি বৃটেনে থাকতেন তাহলে তার মর্মান্তিক আত্মহত্যার ঘটনাটি Coroner's Court-এ রেফার করা হতো। বায়েজিদ সাহেবের সঙ্গে যেসব প্রফেশনাল জড়িত ছিলেন তাদের সবাইকে বিচারে ডাকা হতো। আদালতে প্রত্যেককেই ব্যাখ্যা করতে হতো কেন বায়েজিদ সাহেবকে বাঁচানো গেল না।

বায়েজিদ সাহেবের দুর্ভাগ্য যে তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। কাজেই Coroner's Court-এর কিছুই হয়নি বা হবেও না। ডাক্তার, নার্স, সোশ্যাল ওয়ার্কার, ব্যাংক, রাষ্ট্র ও সমাজের কাউকেই এই সুইসাইডের জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে না। তাই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে পরবর্তী সুইসাইড সংবাদ শোনার জন্য। নিজের পরিচিত কারো আত্মহত্যার সংবাদ শোনার জন্য আমরা কী প্রস্তুত আছি?

লেখক: বিলেতে কর্মরত সাইকিয়াট্রিস্ট এবং প্রাক্তন ফরেনসিক মেডিকেল এক্সামিনার (বৃটিশ পুলিশ)। [email protected]
 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status