শেষের পাতা

বেশি শাস্তিতে শৃঙ্খলা ফিরবে কি?

মারুফ কিবরিয়া

৩ নভেম্বর ২০১৯, রবিবার, ৯:১৩ পূর্বাহ্ন

সড়ক পরিবহনের নতুন আইন শুক্রবার থেকে কার্যকর হলেও এর প্রয়োগ নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। নতুন এই আইনে আগের তুলনায় শাস্তি বেড়েছে। মালিক সমিতি, চালকরা এ নিয়ে আগেই বিরোধিতা করেছেন। ধর্মঘটও পালন করেছেন। তাতে দমে যায়নি সরকার। নির্দিষ্ট সময়ে আইনটি কার্যকর করা হয়েছে।  কার্যকরের দুইদিন গড়ালেও প্রশ্ন উঠেছে নতুন আইনে শাস্তি বেড়েছে, কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কি? প্রতিনিয়ত সড়কে যে প্রাণ ঝরছে তা কি বন্ধ হবে? গত কয়েক মাসেও সড়কে মৃত্যুর হার কোনো অংশে কম নয়। রাজধানীসহ দেশের কোনো না কোনো স্থানে রক্ত ঝরছে।

নতুন আইনে শাস্তি বাড়লেও জনমনে শঙ্কা কমেনি কিছুতেই। রাজধানীতে চলাচলকারী যাত্রীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আইন পাস কিংবা কার্যকর হলেও তা মানেন না কেউ। গাড়ি চালানোর সময় ভুলে যান আইনের কথা। শুধু তাই নয়, আইন ভাঙলেও তা থেকে নানা কৌশলে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। এসব শঙ্কায় সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। রাজধানীর উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকার মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, নতুন এই সড়ক আইন সম্পর্কে জানি। পত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু এই আইন মানবে কিনা এটা বড় প্রশ্ন। তানহা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, নতুন সড়ক আইনে শাস্তি বাড়লো। কিন্তু দেখেন অনেক চালক এ ব্যাপারে জানেই না। তারা নিজেদের মতো করে গাড়ি চালাচ্ছে। আজ সকালেও কলেজে যাওয়ার পথে আমি বসে থাকা বাসটির চালক এক বৃদ্ধ লোকের গায়ে উঠিয়ে দিয়েছিল। অল্পের জন্য রক্ষা পায়। আইন চালু হলেও চালকদের না জানার কারণে দুর্ঘটনা কমবে না। আমরা গত বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছিলাম সেটার কিছু হয়নি। নতুন আইন হয়েছে। আইন তো আগেও ছিল। মানার হলে আগেও মানতো। এখনও আগের অবস্থা হবে। প্রগতি স্মরণি এলাকায় একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফ জানান, নিরাপদ সড়কের দাবিতে পর পর দুটি আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছি। কিন্তু এখনও সড়ক নিরাপদ হয়নি। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকলেও মনে হয় কোনো বাস এসে চাপা দিয়ে যাবে। কারণ আইন কার্যকর হওয়ার পরও আমরা দেখছি চালকরা আগের মতোই বাস চালাচ্ছেন। আরেক শিক্ষার্থী সামিউল হাসান বলেন, আইনটি হওয়াতে খুব ভালো হয়েছে। চালকরা বেপরোয়া গতিতে বাস চালানোর সময় ভাববে। তাছাড়া আইন মেনে বাস নিয়ে বের হবে। সব ঠিকভাবে পালন হলেও আমাদের অসচেতনতার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটবে। আমরা অনেকে এখনো ফুটপাথ, ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করে চলাচল করি না। নিজেদের ঠিকভাবে চলতে হবে।

এদিকে নতুন বাজার এলাকায় সরকারি চাকরিজীবী আফরোজা সুলতানা বলেন, আইন কার্যকর হওয়াতে ভালো হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় গলদ অন্য জায়গায় যেটা কখনো সমাধান হবে না। পরিবহন মালিক ও বিআরটিএ’র একটা যোগ সূত্র আছে। কোনো অঘটন ঘটলে দুই পক্ষের যোগসাজশে সামাধান করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। আর তাছাড়া চালকের লাইসেন্স প্রদান, গণপরিবহনের লাইসেন্স ও রুটপারমিট দেয়ার ব্যাপারে বড় ধরণের অনিয়ম থাকে। ফলে অযোগ্য চালকরা বৈধতা পায়। আর নিয়ম কানুন না জেনে ড্রাইভিং করে মানুষ মারে। এ ব্যাপারগুলো যদি সরকার দেখভাল না করে তাতে আইন আরো কঠোর করেও লাভ হবে না। শাহবাগ ট্রাফিক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা কলেজ শিক্ষার্থী ইউসুফ বলেন, আমার মনে হয় আইন সম্পর্কে জানা শোনা থাকা উচিত সব চালকের। তারা যদি এ বিষয়টি না জানে তাহলে আগের মতোই দুর্ঘটনা ঘটতে থাকবে। আর আমাদেরও সচেতন হতে হবে। রাস্তায় চলাফেরার সময় নিজেরা অনেক অসচেতনভাবে চলি। এই শাহবাগেই দুইটা ফুটওভার ব্রিজ আছে। এগুলো দিয়ে কেউ রাস্তা পারাপার হয় না। উপরে অনেকে আড্ডা জমায়। আমরা জেনেশুনে যদি নিয়ম না মানি তাহলে শৃঙ্খলা কখনো ফিরবে না। এদেশে আইন জারি হলেও তা প্রয়োগ হয় না এমনটা জানিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা ফারহানা রহমান বলেন, আমাদের দেশে আইন শুধু পাস হয়। সেটা ঠিকমতো মানে না কেউ। নতুন আইনে শাস্তি বাড়লো। কিন্তু এ আইনের বিষয়ে সচেতন করার জন্য কোনো প্রোগ্রাম গত কয়েক মাসে কোনো সংস্থা নেয়নি।

এতে লাভ কি হলো।  চালক জানলো কি জানলো না এসব সেটাও তো দেখার বিষয়। তাছাড়া পরিবহন সেক্টর থেকে শুরু করে সর্বত্র যে হারে করাপশন সেটা আইন দিয়ে কি হবে। করাপশন বন্ধ করতে হবে।  তারপর দেখবেন শৃঙ্খলাও ফিরবে। বাংলা মোটর এলাকার পথচারী হানিফ সরকার বলেন, আইন পাস হইছে শুনছি। কিন্তু কয়জন মানে। মানলে এত মানুষ মরে? সবসময় তো  কত কিছু সরকার করতে থাকে। বাসের ড্রাইভাররা তো আইনে কি আছে জানে না। জানলেও কোনো লাভ নাই। তাদের খুশিমত গাড়ি চালাইবো। মানুষ মরবো। আর তাদের নেতারা আবার জেল থেইকা বাইর কইরা আনবো। এসব জানা কথা।

উল্লেখ্য গত বছর জুলাই মাসে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনম্যান্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া ও করিম নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি পূরণের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ও ডিএমপির উদ্যোগে একাধিক কমিটি গঠন ও পদক্ষেপ নেয়া হলেও শুধুমাত্র সড়কে ট্রাফিক সার্জেন্টের মামলা কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। শিক্ষার্থীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়নি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নতুন সড়ক আইন পাস হয় সে বছরেই।  তারপরই শুরু হয় ভিন্ন আন্দোলন। তৎকালীন সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সংগঠনের নেতাদের ইশারায় দেশব্যাপী অবরোধ শুরু করে।

উদ্দেশ্য নতুন সড়ক আইন স্থগিত করা। কিন্তু তাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। এসবের মধ্যেই সর্বশেষ চলতি ১৯শে মার্চ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশ ফটকের সামনে সুপ্রভাত বাসের ধাক্কায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় ফের শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেন। এসময়ও নানা আশ্বাস দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। কিন্তু শৃঙ্খলা ফেরেনি। শহরজুড়ে যানবাহন আগের নিয়মে চলছিল সেটাই চলছিল। এই অবস্থায় ২২শে অক্টোবর সংসদের পাস হওয়া নতুন সড়ক আইন কার্যকরের তারিখ ঘোষণা করে গেজেট জারি করে সরকার। নতুন আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এদিকে আইনটি কার্যকর হলেও এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আর প্রথম সাতদিন সার্জেন্টদের পক্ষ থেকে কোনো মামলা দেয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এই সাতদিন শুধু প্রচারণা চালানো হবে বলেও জানান তিনি। গতকাল নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে বিআরটিএ’র কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে সেতুমন্ত্রী বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে দুর্ঘটনা কমে যাওয়াসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। এই আইন কার্যকরের জন্য এখন সারা বাংলাদেশে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এই সময়ে কোনো পরিবহনের বিরুদ্ধে নতুন আইনে মামলা দায়ের না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status