প্রথম পাতা

সরজমিন

উনি এখন আশুলিয়ার রাজা

কাজী সোহাগ, আশুলিয়া থেকে ফিরে

২৩ অক্টোবর ২০১৯, বুধবার, ৯:২০ পূর্বাহ্ন

চলেন রাজকীয় স্টাইলে। গাড়ির সামনে পেছনে মোটরসাইকেলের বহর। বেতনভুক্ত ক্যাডার বাহিনী। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে নিজেকে আশুলিয়া এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজা হিসেবে। তিনি যা চান তাই হয় এ এলাকায়। দখল, চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন বিপুল বিত্ত-বৈভব। তিনি সাভারের ধামসোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম। সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তার আশীর্বাদ ছাড়া আশুলিয়ায় শিল্প-ব্যবসা চালানো দুরূহ।

তার কোপানলে পড়ে এখন অনেক ব্যবসায়ী এলাকা ছাড়া। আশুলিয়ায় বাড়ি থাকলেও তাদের কেউ কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকেন ঢাকায়। নিরাপত্তার স্বার্থে সবকিছু গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। ব্যবসা হারিয়ে আবার অনেকে হয়েছেন ঋণগ্রস্ত। এর বাইরেও রয়েছে মহাসড়কে চলাচলরত গণপরিবহনে চাঁদা আদায় থেকে শুরু করে জমি দখল, ডিশ ব্যবসা দখল, সরকারি খালের জমি দখল করে বিক্রি করে দেয়ার এন্তার অভিযোগ। চেয়ারম্যান হলেও একা কখনও চলাফেরা করেন না তিনি। বাড়ির বাইরে বের হলেই সঙ্গে থাকে ক্যাডার বাহিনী। সামনে পেছনে মোটরসাইকেল বহর। সরজমিন আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়ন ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। নামে ইউনিয়ন পরিষদ হলেও আশুলিয়ায় রয়েছে শহুরে পরিবেশ। ৩ লাখ ৮ হাজার জনসংখ্যার এ ইউনিয়নে রয়েছে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড), পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ক্যাডেট কোর প্রশিক্ষণ একাডেমি, বাংলাদেশ বিমান পোল্ট্রি ফার্ম, ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। এ ছাড়া রয়েছে ২৬টি গ্রাম।

ক্যাডার পদে সিনিয়র-জুনিয়র: সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায় ৩০ জন সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের। স্থানীয় কোনো যুবক এ দলে নেই। ক্যাডাররা সবাই বিভিন্ন জেলা থেকে আসা। প্রত্যেকেই বেতনভুক্ত। রয়েছে সিনিয়র-জুনিয়র পোস্ট। ৩৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন তাদের। পাশাপাশি কাজ হাসিলের পর থাকে বকশিশ। বেশি বিশ্বাসভাজন হলে বেতনের পাশাপাশি দেয়া হয় ছোটখাটো ব্যবসার সুযোগ। সেটাও আবার গার্মেন্ট কেন্দ্রিক। পোশাক শ্রমিকদের টিফিন সাপ্লাইয়ের ব্যবসা দেয়া হয় তাদের। আস্থা হারালে আবার কেড়েও নেয়া হয়। ক্যাডারদের কয়েকজন চেয়ারম্যানের সঙ্গ ছাড়তে চাইলেও ছাড়তে পারছেন না। নানা জালে আটকে রাখা হয়েছে তাদের। স্থানীয় না হওয়ায় প্রতিবাদের সুযোগও নেই। তাই বাধ্য হয়ে সাইফুল চেয়ারম্যানের হুকুম তামিল করতে হচ্ছে। সাইফুল চেয়ারম্যানের ক্যাডারের তালিকায় আছেন-মাহবুব, রিয়াজ, রিয়াদ মোল্লা, গাউছ, দাউদ, সুলতান, পান্নু, তমাল, ফরহাদ, সবুজ, ওয়াসিম গাজী, রতন, কামরুল, ফাহিম, মিলন, রোমেল, আজাদ, কালাম, ছোট মাহবুব, সেকেন্দার, নজরুল, সোহেল, সুমন, জাকির, আব্দুল আল কাদির, রানা, কুদ্দুস, নজরুল ও সাফি। এ ছাড়া বেতন ছাড়া চেয়ারম্যানের বিভিন্ন অবৈধ কাজ করে দেয়ার বিনিময়ে সুবিধা পাওয়ার মধ্যে রয়েছেন ওয়েলকাম মিন্টু, চান মিয়া, সজীব, সুমন, তুষার, আল-আমিন সরকার। এদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ক্যাডার হিসেবে পরিচিত মাহবুব। তার বেতন ৩৫ হাজার টাকা। সাইফুল চেয়ারম্যানের হয়ে কাজ করার কথা স্বীকার করলেও বেতন নেয়ার কথা অস্বীকার করেন তিনি। মানবজমিনকে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান ভাই হচ্ছেন এই এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। রাজনীতি করার কারণে তিনি মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও ভালোবাসা পান তিনি। কথা হয় আরেক ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ফরহাদের সঙ্গে। তিনি ধামসোনা ইউনিয়ন যুবলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাড়ি খুলনায়। সাইফুল চেয়ারম্যানই তাকে এ পদটি দিয়েছেন। মানবজমিনকে ফরহাদ জানান, খুলনা থেকে আশুলিয়ায় আসি গার্মেন্টে কাজ করতে। পরে ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। কাজ ছেড়ে দিয়ে এখন তার সঙ্গেই আছি। বাইরে থেকে এসেছি তাই তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে। এসব আপনি ভালো করেই জানেন। ক্যাডার হিসেবে কাজ কি প্রশ্নে তিনি জানান, চেয়ারম্যানের নানারকম কাজ করে দেয়া। তবে আমি চাঁদাবাজি, মারামারি এসব করি না। চেয়ারম্যানের অনুষ্ঠানে লোক দেয়ার দায়িত্ব থাকে আমার ওপর। যুবলীগের পদ পেতে ভাই আমাকে ব্যাপক সহায়তা করেছেন। এখন একটি ফাক্টরিতে টিফিন সাপ্লাই দেয়ার চেষ্টা করছি। স্থানীয় সূত্রের দাবি, প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে সন্ধ্যার দিকে পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার লাবণী রেস্টুরেন্টে বসে চেয়ারম্যান ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের মাসিক বেতন দেন। এদের মধ্যে রিয়াজ, সবুজ, গাউছ, সুলতান, পান্নু, ফরহাদের বেতন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও তার বাহিনীর মধ্যে সবুজ ও ফাহিম পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। এর আগে ইয়াবাসহ ঢাকা জেলা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। আমিন মডেল টাউন এলাকায় বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা (সার্জেন্ট) আরিফ বিল্লাহ। চাঁদা না দেয়ার কারণে ওই সেনা সদস্যকে মোবাইল ফোনে বাড়ি থেকে ডেকে এনে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে সাইফুল চেয়ারম্যানের ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। আশুলিয়ার শ্রীপুর এলাকায় গেদুরাজের ছেলে শাহিনের ডিশ ব্যবসা দখল করতে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরিবহন শ্রমিক লীগের আশুলিয়া থানা শাখার সেক্রেটারি রাজা মোল্লার বাইপাইল এলাকায় তার কাউন্টার থেকে চাঁদা না দেয়ায় অস্ত্র নিয়ে তার ওপর হামলা চালিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়। সরজমিন জানা যায়, নবীনগর-চন্দ্রা ও আব্দুল্লাপুর-বাইপাইল মহাসড়ক দিয়ে চলাচলরত যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করে চেয়ারম্যানের লোকজন। এর মধ্যে ওয়েলকাম ও মৌমিতা পরিবহনের প্রায় ১৫০টি বাস থেকে ৩০ টাকা, আশুলিয়া ক্লাসিকের প্রায় ১১০টি বাস থেকে ২৪০ টাকা ও প্রায় ৫০টি মিনিবাস থেকে ১২০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হয়। ওয়েলকাম ও মৌমিতা পরিবহন থেকে চাঁদা আদায়ের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েলকাম মিন্টু  ও তার সহযোগী চান মিয়া। এমনকি তাদের হাত থেকে বাদ যায়নি স্থানীয় সড়ক দিয়ে চলাচলরত অটোরিকশা। পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার আমিন মডেল টাউন স্কুলের সড়ক দিয়ে প্রায় ২৫টি অটোরিকশা চলাচল করে। প্রতিদিন এসব অটোরিকশা থেকে ৭০ টাকা করে আদায় করা হয়।

ইপিজেড ও গার্মেন্টে একচ্ছত্র আধিপত্য: ধামসোনা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় অবস্থিত ইপিজেড ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে সাইফুল চেয়ারম্যানের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। ইপিজেডের ১০ থেকে ১৫টি ফ্যাক্টরির ঝুট ব্যবসা নিজের দখলে নিয়েছেন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরপরই। আগে যারা এসব ব্যবসা করতেন তাদের মারধর ও হুমকি-ধামকি দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। এসব ফ্যাক্টরির অন্যতম হচ্ছে হপলন, ওয়ের ফার্ম, এসবি উইকাস, ওয়াইকেকে, রিংসাইন। এসব থেকে সাইফুল চেয়ারম্যানের মাসে আয় ১ কোটি টাকার বেশি। ইপিজেডের বাইরে আরো ৩০ থেকে ৩৫টি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির ঝুট ব্যবসা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন সাইফুল চেয়ারম্যান। আগে ঝুট ব্যবসা করতেন এমন দুইজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, ব্যবসা দখল করে নিয়েছে সাইফুল চেয়ারম্যান। তাই আয়-রোজগার নেই বললেই চলে। ব্যবসা গেছে, তবে বেঁচে আছি- এটাই বড় কথা। তারা জানান, সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে আমাদের ব্যবসা দখল করে নিয়েছেন চেয়ারম্যান। ঝুটের জন্য কোনো গাড়ি ও শ্রমিকদের ইপিজেডে ঢুকতে দিতো না তারা। শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে বলতো তারা যদি ইপিজেডের ভেতরে জীবিত প্রবেশ করে তাহলে লাশ হয়ে বাইরে বের হবে। আবার অনেক ব্যবসায়ীকে ক্যাডার দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে বলেও জানান তারা। পরে মান-সম্মানের ভয়ে তারা ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। সাইফুল চেয়ারম্যানের পক্ষে তার ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন তার বড় ভাই রহিম। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সাইফুলের আগে থেকে আমি এ এলাকায় ব্যবসা করি। তার ব্যবসা দেখাশোনার প্রশ্নই আসে না। এসব বিষয়ে আপনি সাইফুলের কাছে জিজ্ঞেস করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইফুল চেয়ারম্যানের রয়েছে দামি একটি ল্যান্ড ক্রুজার, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ চারটি গাড়ি। এরমধ্যে অবৈধভাবে সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে কেনা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িটি তিনি সচরাচর বের করেন না। সেটি বাড়ির ভেতরে গ্যারেজে রেখে দেন। ওই গাড়ির একটি ছবি রয়েছে মানবজমিনের হাতে। এ ছাড়া চেয়ারম্যান আশুলিয়ার বাইপাইলে ২৫ শতাংশ জমি দখল করে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছেন ১৬ তলা বহুতল ভবন। ইতিমধ্যে ৪ তলার কাজ শেষ করেছেন। নয়ারহাটের কাছে বেলতলা এলাকায় ৮ বিঘা জমিসহ পেট্রোল পাম্প নামমাত্র মূল্যে কিনেছেন। আশুলিয়ার বাঁশবাড়ি মৌজায় ১৫ বিঘা জমির উপর নির্মাণ করেছেন বাগানবাড়ি। মানবজমিন-এর পক্ষ থেকে এলাকায় অনুসন্ধান চালানোর সময়ই বিভিন্ন শ্রেণির লোকদের দিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান সাইফুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ধামসোনা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জানান, তিনি বাইরে রয়েছেন। পরে টেলিফোন করা হলে সাইফুল ইসলাম প্রথমে অভিযোগের বিষয় শোনেন। পরে তিনি বলেন, আমি গুরুতর অসুস্থ। কথা বলতে কষ্ট হয়। সামনা-সামনি আসেন কথা বলবো। টেলিফোনে এসব বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাই না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status