প্রথম পাতা

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ বাড়ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৪ অক্টোবর ২০১৯, সোমবার, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ন

সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে সরকারের নেয়া কঠোর পদক্ষেপের ফলে অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বিক্রি। এক মাসের ব্যবধানে বিক্রি কমেছে ৬৬১ কোটি টাকা । অর্থাৎ ব্যাংকবহির্ভূত উৎস সঞ্চয়পত্রে ঋণের চাপ কমলেও ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ বাড়ছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১লা জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আড়াই মাসে ব্যাংক খাত থেকে নিট ২৩ হাজার ২১৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া নিট ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। কড়াকড়ি এবং কর বাড়ানোর ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

উল্লেখ্য, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’  হিসেবে গণ্য করা হয়।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। পরের মাস আগস্টে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি আরো কমেছে। এ মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। অথচ অনলাইন পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের শুরু অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সে হিসেবে ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী ধারায় হাঁটছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসের চিত্র বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংকবহির্ভূত উৎসের মধ্যে কেবল সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। তবে আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ এসেছিল ৪৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা।

জানা গেছে, বিভিন্ন পক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার না কমিয়ে এ খাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় সরকার। ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়। এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়। সঞ্চয়পত্রের সব লেনদেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করতে হচ্ছে ক্রেতাদের। দুর্নীতি কিংবা অপ্রদর্শিত আয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধ করতে ক্রেতার তথ্য একটি ডাটাবেসে সংরক্ষণের লক্ষ্যে অভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রে বড় বিনিয়োগে কঠোর হয়েছে সরকার। চাইলেই ভবিষ্যৎ তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ নেই। এছাড়া এখন প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে কর কমিশনারের প্রত্যয়নপত্র লাগে। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক ফার্মের নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে লাগছে উপকর কমিশনারের প্রত্যয়ণ। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের আগস্ট মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ২১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭১৫ কোটি ৩০ হাজার টাকা। এর মধ্যে সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয় ২ হাজার ২০৫ কোটি ৪০ হাজার টাকা। সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয় ১ হাজার ৪৯৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এর আগে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয় ২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয় ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা।

হালানাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, দুই মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১১ হাজার ৩০৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৬৪৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আর সুদ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৭৮০ কোটি ১০ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৬৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফা বা সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ পড়ছে। ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে সরকারকে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি।

বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১.৫২ শতাংশ। এ ছাড়া ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদ ১১.২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদ ১১.০৪ শতাংশ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদ ১১.৭৬ শতাংশ।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণের স্থিতি ছিল ৩৭ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ৪৮ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। বিদায়ী অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ ছিল ২৬ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুলাইয়ে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে (জাতীয় সঞ্চয় স্কিমসহ অন্যান্য) সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৮ কোটি টাকা।

এদিকে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট স্ট্যাটিক্স ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ, যোগাযোগসহ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প নেয়া হয়েছে গত এক দশকে। আর এসব উন্নয়ন প্রকল্পের বেশিরভাগই বৈদেশিক ঋণনির্ভর। এতে গত এক দশকে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। এসব ঋণের বড় অংশই দীর্ঘমেয়াদি। তবে বৈদেশিক ঋণের বড় অংশই দ্বিপক্ষীয়। ফলে উচ্চ সুদ ও কঠিন শর্তের এসব ঋণের বিপরীতে সুদ ব্যয়ও গত ১০ বছরে তিনগুণ বেড়েছে। প্রদিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৪০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ১০ বছর পর ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫ হাজার ২১২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অর্থাৎ, এক দশকে বৈদেশিক ঋণ প্রায় সোয়া দুইগুণ হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status