মত-মতান্তর
রবীন্দ্র সাহিত্যে দুর্গোৎসব
রঞ্জন মল্লিক
৭ অক্টোবর ২০১৯, সোমবার, ১২:১০ অপরাহ্ন
দুর্গোৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। আবহমান কাল থেকে পূজোৎসবকে ঘিরে গ্রাম বাংলার মানুষের মনে আনন্দের বন্যা বইতে থাকে। বর্ষা শেষ হবার পর পরই শরতের আগমন। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর রাতে শিউলী ফোটার মৌ মৌ গন্ধের সাথে ঢাকের বাজনা অনমনা মনটিতে কি যেন এক মিষ্টি মধুর ভাব এনে দেয়। এমন মিষ্টি মধুর পরিবেশে পূর্জার আয়োজন সেখানে কবিগুরু বসে থাকতে পারেন না। কবির অনমনা মন ঢাকের তালে নেচে উঠে, তবে সেই নাচা কখনো আনন্দের আবার কখনো বেদনার। দুর্গোৎসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়ার মতো প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১২৯১ (১৮৮৪ইং) কার্তিক মাসে বষ্কিমচন্দ্রের প্রচার পত্রিকায়। সেই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন দীর্ঘ কবিতা-আনন্দমীর আগমনে/আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে/হেরো ওই ধনীর দুয়ারে/দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে। কবিতার শিরোনাম কাঙালিনী। উনআশি ছত্রের কবিতা এক দু:খিনী কান্ডালিনীর কাহিনী। কবিতা পড়া হয়ে গেলেও গল্পের করুণ রস মনের মধ্যে থেকে যায় বহুকাল। উৎসবের অর্থ তাৎপর্য এবং সার্থকতা খুঁজতে চেষ্টা করেন রবীন্দ্রনাথ এই কবিতার মধ্যে দিয়ে। বুঝতে পারা যায় কবি তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে গল্প লিখতে চাইছেন - সুখ দুঃখের গল্প, আনন্দ বেদনার গল্প, এক শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ের গল্প।
বাংলা ১২৯৮ (১৮৯১ইং) এ কবিগুরু সাপ্তাহিক হিতবাদী পত্রিকার সাহিত্য শাখার সম্পাদক। তিনি লিখলেন ছোটগল্প দেনা-পাওনা। কাঙ্কালিনীর মতো এও দুর্গাপূজারই গল্প। কাঙ্গালিনীর মতো নিরাপমাও বড় অভাগা। তার বাবা মা-শ্বশ্বর-শাশুড়ি স্বামী সব থাকা সত্ত্বেও সে বড়ই দুঃখী। কারণ পিতা তার বিবাহের পনের সব টাকা শ্বশুরের হাতে তুলে দিতে পারেনি। আর সেই কারণেই শাস্তি স্বরূপ নিরুপমার পিত্রালয়ে ফেরার পথ বন্ধ। যে দুর্গাপূজার সময় উমা বাপের বাড়ি ফেরে, সেই পূর্জাতেও নিরুপমার বাবা রামসুন্দর কন্যাকে তার শ্বশুরঘর থেকে পিতৃগৃহে দু’দিনের জন্যেও নিয়ে আসার অনুমতি পায়নি। পূজোতে ধনীর বৈভব কবি দেখেছেন, কিন্তু সেই পুজোতে দরিদ্র মানুষের মনোকষ্ট কবিকে কলম ধরতে বাধ্য করেছে। খাতা গল্পের নায়িকা উমা। শারদীয় উমা তিন দিনের জন্যে হলেও পিত্রালয়ে আসার সুযোগ পায়, কিন্তু গল্পের উমাদের ভাগ্যে সে সৌভাগ্য ঘটে না। গল্পের উমা শ্বশুরবাড়ির জানালায় মুখ রেখে শরতের প্রভাতে আনমনে উমার আগমনী গান শোনে।
১২৯৮ (১৮৯১ইং) অগ্রহায়নে সাধনা পত্রিকাটি কবির অর্থায়নে বের হয়। প্রথম সংখ্যায় বেরোয় ছোট গল্প সম্পত্তি সমর্পণ। তারপর ১২৯৯ (১৮৯২ইং) সালে স্বর্ণমৃগ নামে দীর্ঘ গল্প ছাপালেন এবং তা পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত হলো। গল্পের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
আশ্বিন মাসে দুর্গোৎসব নিকটবর্তী হইল। চতুর্থীর দিন হইতে ঘাটে নৌকা আসিয়া লাগিতে লাগিল। প্রবাসীরা দেশে ফিরিয়া আসিতেছে। ঝুড়িতে মানকচু কুমড়া, শুষ্ক নারিকেল, টিনের বাঙের মধ্যে ছেলেদের জন্য জুতা ছাতা কাপড় এবং প্রেয়সীর জন্য সুগন্ধী সাবান নূতন গল্পের বই এবং সুবাদিত নারিকেল তৈল।
মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্যকিরণ উৎসবের হাস্যের মতো ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, পক্কপ্রায় ধান্যক্ষেত্র থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, বর্ষাধৌত সতেজ তরুপল্ল্লব নব শীতার্থ বায়ুতে সির সির করিয়া উঠিতেছে এবং তসরের চায়না কোট পরিয়া কাঁধে একটি পাকানো চাদর ঝুলাইয়া ছাতি মাথায় প্রত্যাগত পথিকেরা মাঠের পথ দিয়া ঘরের মুখে চলিয়াছে।
বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া তাই দেখেন এবং তাঁহার হূদয় হইতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে। নিজের নিরানন্দ গৃহের সহিত বাংলাদেশের সহস্র গৃহের মিলনোৎসবের তুলনা করেন এবং মনে মনে বলেন বিধাতা কেন আমাকে এমন অকর্মণ্য করিয়া সৃজন করিয়াছেন।
ছেলেরা ভোরে উঠিয়াই প্রতিমা নির্মান দেখিবার জন্য আদ্যানাথের বাড়িতে প্রাঙ্গণে গিয়া হাজির হইয়াছিল। খাবার বেলা হইলে দাসী তাহাদিগকে বলপূর্বক গ্রেফতার করিয়া লইয়া আসিল। তখন বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া এই বিশ্বব্যাপী উৎসবের মধ্যে নিজের জীবনের নিষ্কলতা স্মরণ করিতেছিলেন। দাসীর হাত হইতে ছেলে দুটিকে উদ্ধার করিয়া কোলের কাছে ঘনিষ্ঠভাবে টানিয়া বড়োটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হারে অবু, এবার পুজোর সময় কী চাস বল দেখি।
অবিনাশ তৎক্ষণাৎ উত্তর করিল, একটা নৌকা দিয়ো, বাবা। ছোটটি ও মনে করিল, বড়ো ভাইয়ের চেয়ে কোনো বিষয়ে ন্যূন হওয়া কিছু নয়, কহিল, আমাকে ও একটা নৌকা দিয়ো, বাবা।
বাপের উপযুক্ত ছেলে। একটা অকর্মণ্য কারুকার্য পাইলে আর কিছু চাহে না। বাপ বলিলেন, আচ্ছা, দিন দুই তিন গেল। বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া কতকগুলো কাষ্ঠখন্ড কাটিয়া কুঁদিয়া জোড়া দিয়া দুই খানি খেলনার নৌকা তৈরি করিলেন।
ছেলেদের আনন্দকলরবে আকৃষ্ট হইয়া মোক্ষদা আসিয়া দরিদ্র পিতার পূজার উপহার দেখিলেন।
দেখিয়া, রাগিয়া কাঁদিয়া কপালে করাঘাত করিয়া খেলেনা দুটো কাড়িয়া জানলার বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। সোনার হার গেল, মাটিনের জমা গেল, জরির টুপি গেল, শেষে কিনা হতভাগ্য মানুষ্য দুই খান খেলনা দিয়া নিজের ছেলেকে প্রতারণা করিতে আসিয়াছে। তাও আবার দুই পয়সা ব্যয় নাই, নিজে হাতে নির্মাণ। পূজায় ছেলেদের নতুন জামা-কাপড় দিতে না পারার বেদনা কবি তুলে ধরেছেন। এ যেন চিরায়িত দরিদ্র বাংলার ছবি।
সাত বছর পর মুকুল পত্রিকায় “পূজার সাজ” শিরোনামে মধু বিধু দুই ভাইয়ের যে কবিতা ছাপা হয় তা যে এই গল্পের প্রেরণাতেই কবি রচনা করেছিলেন তা অনুমান করা যায়।
যেতে নাহি দিব কবিতায় দেখা গেল অন্য ছবি। পূর্জা শেষ। শরৎ অবসানে ঘর থেকে কর্মস্থলে যাবার উদ্যোগ। মধ্য কার্তিকে বসে কবি লিখছেন, গিয়েছে আশ্বিন-পূজার ছুটি শেষ ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে/সেই কর্মস্থানে। ঘর জুড়ে ফিরে যাবার আয়োজন। ভৃত্যেরা ব্যস্ত, অশ্রুসজল চোখে স্ত্রী ব্যস্ত জিনিসপত্র গোছানোতে। সময় বেশি নেই, দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। বাইরের দরজার প্রান্তে অন্যমনে বসে প্রবাসযাত্রীর চার বছরের মেয়ে। বাবা যখন বিদায়কালে তাকে বলেন মাগো, আমি যাই; বিষন্ন নয়নে ম্লানমুখে শুধু প্রত্যুত্তরে বলে, যেতে আমি দিব না তোমায়। পুজোকে ঘিরে পুজোর ছুটিকে ঘিরে, ঘরে ফেরা ও প্রত্যবার্তনকে ঘিরে, শরতের আকাশে মেঘ ও রৌদ্রকে ঘিরে মানুষের মনের আকাশেও আলো আধাঁরির কী বিচিত্র খেলা কবি তা লক্ষ্য করেছেন।
পুজো, পুজোর ছুটি, পুজোর সাজ ইত্যাদি নিয়ে একটির পর একটি কবিতা বা গল্প লিখে চলেছেন। বিষয় বৈচিত্র্যের প্রত্যেকটিই অভিনব, তবুও তারই মধ্যে কোথায় যেন একটা ঐক্য খুঁজে পাওয়া যায়। আনন্দের সমারোহের মাঝে রয়েছে কোথায় যেন একটা করুন স্বরের ধারা। দুর্গোৎসবের আর এক নাম শারদোৎসব, ‘রাসমনির ছেলে’ গল্পটিও একপ্রকার পূজোর সময়ের গল্প, পূজোর সাজের গল্প। ভারতীতে ১৩১৮ আশ্বিনে (১৯১১) মুদ্রিত। এই গল্প পুত্র কালিপদ ও তার বাবা মা ভবানীচরণ ও রাসমনির। ভবানীচরণ বনেদি চৌধুরী পরিবারের মানুষ। কিন্তু ঘটনা চক্রে আজ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। পূজার সময় তাঁই মনে পড়ে, কর্তাদের আমলে নুতন সাজসজ্জা পরিয়া তাঁহারা কিরূপ উৎসাহ বোধ করিয়াছেন। পূজার দিনে রাসমণি কালীপদর জন্য যে সস্তা কাপড় জামার ব্যবস্থা করিয়াছেন সাবেক কালে তাঁহাদের বাড়ির ভৃত্তরাও তাহাতে আপত্তি করিত। রাসমনি স্বামীকে অনেক করিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন যে, কালীপদকে যাহা দেওয়া যায় তাহাতেই সে খুশি হয়, সে তো সাবেক কালের কথা কিছুই জানে না। তুমি কেন মিছা মিছি মন ভার করিয়া থাক। কিন্তু ভবানীচরণ কিছুতেই ভুলিতে পারে না যে, বেচারা কালিপদ আপন বংশের গৌরব জানেনা বলিয়া তাহাকে ঠকানো হইতেছে।
এখানে ঠকানো আর প্রায়চিত্র গল্পে প্রতারণা শব্দ ব্যবহূত হয়েছে। এখানে বাবা নিজেই বেদনা বোধ করছে ছেলেকে পূজোয় যাথাপযুক্ত উপহার না দিতে পারার জন্যে। যদিও ছেলে এই সামান্য উপহারেই গর্বে ও আনন্দে নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। এখানে ইংরেজ শাসিত ভারতের জমিদারি প্রথার ক্ষয়িক্ষ্মু দিকগুলো কবি তুলির আচড়ে যেন তুলে ধরেছেন।
প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ বাবুই সম্ভবত: দুর্গাপূজা সংখ্যায় প্রথম লেখার জন্য কবিকে অগ্রিম টাকা দিয়েছিলেন। সেই অগ্রিমের চাপেই লেখা শুরু হয়েছিল গোরা’ উপন্যাসের। কবির জীবনের শেষ পর্বে আনন্দবাজার পত্রিকা অগ্রিম টাকা দিয়ে নুতন লেখা আদায়ের চেষ্টা করে। আনন্দবাজার ১৯৩৯, ১৯৪০ সালে পর পর দু’বছর কবির দুখানি বড় গল্প প্রকাশ করে। ১৯৩৯ এর শারদীয়ায় রবিবার আর ১৯৪০ এর শারদীয়ায় ল্যাবরেটারী। ফলে কবির শেষ জীবনে পূজো সংখ্যায় দুটো বড় গল্প পাঠক পান। এদিকে ৮০ ছুঁই ছুঁই রীন্দ্রনাথ-কত আর লিখেবেন? কৌতুক করে বলেছেন, সম্পাদক তাগিদ নিত্য চলছে বাহিরে, অন্তরেতে লেখার তাগিদ একটু নাহি রে, মৌণ মনের মধ্যে/গদ্যে কিংবা পদ্যে। তবুও লিখতে হয়, সম্পাদকদের দাবি এড়াতে কঠিন হয়ে ওঠে। বিশেষ করে পুজো সংখ্যার জন্য গদ্য হোক কিংবা পদ্য কিছু তো চাই। রবীন্দ্রনাথের লেখা ছাড়া কি পূজোসংখ্যা জমে?
কবি শুধু কবিতা, গল্প বা উপন্যাসে দুর্গাপূজাকে তুলে ধরেন নি। ১৮৯৪ এর ৫ অক্টোবর কলকাতা থেকে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে লিখেন, কাল দুর্গাপূজা আরম্ভ হবে, আজ তার সুন্দর সূচনা হয়েছে। ঘরের ঘরে সমসত দেশের লোকের মনে যখন একটা আনন্দের হিল্লোল প্রবাহিত হচ্ছে তখন তাদের সঙ্গে সাময়িক বিচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও সে আনন্দ মনকে স্পর্শ করে। পরশু দিন সকালে সুরেশ সমাজপতির বাড়ি যাবার সময় দেখেছিলুম রাস্তার দু’ধারে প্রায় বড়ো বড়ো বাড়ির দালান মাত্রেই দুর্গার দশ হাত তোলা প্রতিমা তৈরি হচ্ছে এবং আশে পাশে সমস্ত বাড়ির ছেলের দল ভারী চঞ্চল হয়ে উঠছে। দেখে আমার মনে হলো দেশের সমস্ত ছেলে বুড়ো সকলেই হঠাৎ দিন কতকের মতো ছেলে মানুষ হয়ে উঠে সবাই মিলে একটা বড়ো গোছের পুতুল খেলায় প্রবৃত্ত হয়েছে। ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে সমস্ত আনন্দ মাত্রই পুতুল খেলা, অর্থাৎ তাতে কোন উদ্দেশ্য নেই, লাভ নেই - বাইরের থেকে দেখে মনে হয় বৃথা সময় নষ্ট। কিন্তু সমস্ত দেশের লোকের মনে যাতে করে একটা ভাবের আন্দোলন, একটা বৃহৎ উচ্ছ্বাস এনে দেয়, সে জিনিসটা কখনোই নিষ্ফল এবং সামান্য নয়।...প্রতি বৎসরের এই ভাবের প্লাবনে নিশ্চয়ই মানুষকে অনেকটা পরিমানে মানবিক করে দেয়, কিছু কালের জন্যে মনে এমন একটি অনুকূল আর্দ্র অবস্থা এনে দেয় যাতে প্রীতি দয়া মায়া সহজে অঙ্কুরিত হতে পারে। দুর্গাপূজার সামগ্রিক আয়োজনের মধ্যে একটা মানবিক আবেদন একটা আনন্দমুখর মিলনের আবেগ রয়েছে-তা কবি বরাবরই লক্ষ করেছেন।
রবীন্দ্র সাহিত্যে দুর্গোৎসব সমাজ তথা সাধারণ মানুষের কথাকে অসাধারণ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন। যা পাঠক মাত্রই সাহিত্যিক রসে উদ্ভাসিত হবে, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও অনুষ্টান নির্মাতা
বাংলা ১২৯৮ (১৮৯১ইং) এ কবিগুরু সাপ্তাহিক হিতবাদী পত্রিকার সাহিত্য শাখার সম্পাদক। তিনি লিখলেন ছোটগল্প দেনা-পাওনা। কাঙ্কালিনীর মতো এও দুর্গাপূজারই গল্প। কাঙ্গালিনীর মতো নিরাপমাও বড় অভাগা। তার বাবা মা-শ্বশ্বর-শাশুড়ি স্বামী সব থাকা সত্ত্বেও সে বড়ই দুঃখী। কারণ পিতা তার বিবাহের পনের সব টাকা শ্বশুরের হাতে তুলে দিতে পারেনি। আর সেই কারণেই শাস্তি স্বরূপ নিরুপমার পিত্রালয়ে ফেরার পথ বন্ধ। যে দুর্গাপূজার সময় উমা বাপের বাড়ি ফেরে, সেই পূর্জাতেও নিরুপমার বাবা রামসুন্দর কন্যাকে তার শ্বশুরঘর থেকে পিতৃগৃহে দু’দিনের জন্যেও নিয়ে আসার অনুমতি পায়নি। পূজোতে ধনীর বৈভব কবি দেখেছেন, কিন্তু সেই পুজোতে দরিদ্র মানুষের মনোকষ্ট কবিকে কলম ধরতে বাধ্য করেছে। খাতা গল্পের নায়িকা উমা। শারদীয় উমা তিন দিনের জন্যে হলেও পিত্রালয়ে আসার সুযোগ পায়, কিন্তু গল্পের উমাদের ভাগ্যে সে সৌভাগ্য ঘটে না। গল্পের উমা শ্বশুরবাড়ির জানালায় মুখ রেখে শরতের প্রভাতে আনমনে উমার আগমনী গান শোনে।
১২৯৮ (১৮৯১ইং) অগ্রহায়নে সাধনা পত্রিকাটি কবির অর্থায়নে বের হয়। প্রথম সংখ্যায় বেরোয় ছোট গল্প সম্পত্তি সমর্পণ। তারপর ১২৯৯ (১৮৯২ইং) সালে স্বর্ণমৃগ নামে দীর্ঘ গল্প ছাপালেন এবং তা পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত হলো। গল্পের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
আশ্বিন মাসে দুর্গোৎসব নিকটবর্তী হইল। চতুর্থীর দিন হইতে ঘাটে নৌকা আসিয়া লাগিতে লাগিল। প্রবাসীরা দেশে ফিরিয়া আসিতেছে। ঝুড়িতে মানকচু কুমড়া, শুষ্ক নারিকেল, টিনের বাঙের মধ্যে ছেলেদের জন্য জুতা ছাতা কাপড় এবং প্রেয়সীর জন্য সুগন্ধী সাবান নূতন গল্পের বই এবং সুবাদিত নারিকেল তৈল।
মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্যকিরণ উৎসবের হাস্যের মতো ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, পক্কপ্রায় ধান্যক্ষেত্র থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, বর্ষাধৌত সতেজ তরুপল্ল্লব নব শীতার্থ বায়ুতে সির সির করিয়া উঠিতেছে এবং তসরের চায়না কোট পরিয়া কাঁধে একটি পাকানো চাদর ঝুলাইয়া ছাতি মাথায় প্রত্যাগত পথিকেরা মাঠের পথ দিয়া ঘরের মুখে চলিয়াছে।
বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া তাই দেখেন এবং তাঁহার হূদয় হইতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে। নিজের নিরানন্দ গৃহের সহিত বাংলাদেশের সহস্র গৃহের মিলনোৎসবের তুলনা করেন এবং মনে মনে বলেন বিধাতা কেন আমাকে এমন অকর্মণ্য করিয়া সৃজন করিয়াছেন।
ছেলেরা ভোরে উঠিয়াই প্রতিমা নির্মান দেখিবার জন্য আদ্যানাথের বাড়িতে প্রাঙ্গণে গিয়া হাজির হইয়াছিল। খাবার বেলা হইলে দাসী তাহাদিগকে বলপূর্বক গ্রেফতার করিয়া লইয়া আসিল। তখন বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া এই বিশ্বব্যাপী উৎসবের মধ্যে নিজের জীবনের নিষ্কলতা স্মরণ করিতেছিলেন। দাসীর হাত হইতে ছেলে দুটিকে উদ্ধার করিয়া কোলের কাছে ঘনিষ্ঠভাবে টানিয়া বড়োটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হারে অবু, এবার পুজোর সময় কী চাস বল দেখি।
অবিনাশ তৎক্ষণাৎ উত্তর করিল, একটা নৌকা দিয়ো, বাবা। ছোটটি ও মনে করিল, বড়ো ভাইয়ের চেয়ে কোনো বিষয়ে ন্যূন হওয়া কিছু নয়, কহিল, আমাকে ও একটা নৌকা দিয়ো, বাবা।
বাপের উপযুক্ত ছেলে। একটা অকর্মণ্য কারুকার্য পাইলে আর কিছু চাহে না। বাপ বলিলেন, আচ্ছা, দিন দুই তিন গেল। বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া কতকগুলো কাষ্ঠখন্ড কাটিয়া কুঁদিয়া জোড়া দিয়া দুই খানি খেলনার নৌকা তৈরি করিলেন।
ছেলেদের আনন্দকলরবে আকৃষ্ট হইয়া মোক্ষদা আসিয়া দরিদ্র পিতার পূজার উপহার দেখিলেন।
দেখিয়া, রাগিয়া কাঁদিয়া কপালে করাঘাত করিয়া খেলেনা দুটো কাড়িয়া জানলার বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। সোনার হার গেল, মাটিনের জমা গেল, জরির টুপি গেল, শেষে কিনা হতভাগ্য মানুষ্য দুই খান খেলনা দিয়া নিজের ছেলেকে প্রতারণা করিতে আসিয়াছে। তাও আবার দুই পয়সা ব্যয় নাই, নিজে হাতে নির্মাণ। পূজায় ছেলেদের নতুন জামা-কাপড় দিতে না পারার বেদনা কবি তুলে ধরেছেন। এ যেন চিরায়িত দরিদ্র বাংলার ছবি।
সাত বছর পর মুকুল পত্রিকায় “পূজার সাজ” শিরোনামে মধু বিধু দুই ভাইয়ের যে কবিতা ছাপা হয় তা যে এই গল্পের প্রেরণাতেই কবি রচনা করেছিলেন তা অনুমান করা যায়।
যেতে নাহি দিব কবিতায় দেখা গেল অন্য ছবি। পূর্জা শেষ। শরৎ অবসানে ঘর থেকে কর্মস্থলে যাবার উদ্যোগ। মধ্য কার্তিকে বসে কবি লিখছেন, গিয়েছে আশ্বিন-পূজার ছুটি শেষ ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে/সেই কর্মস্থানে। ঘর জুড়ে ফিরে যাবার আয়োজন। ভৃত্যেরা ব্যস্ত, অশ্রুসজল চোখে স্ত্রী ব্যস্ত জিনিসপত্র গোছানোতে। সময় বেশি নেই, দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। বাইরের দরজার প্রান্তে অন্যমনে বসে প্রবাসযাত্রীর চার বছরের মেয়ে। বাবা যখন বিদায়কালে তাকে বলেন মাগো, আমি যাই; বিষন্ন নয়নে ম্লানমুখে শুধু প্রত্যুত্তরে বলে, যেতে আমি দিব না তোমায়। পুজোকে ঘিরে পুজোর ছুটিকে ঘিরে, ঘরে ফেরা ও প্রত্যবার্তনকে ঘিরে, শরতের আকাশে মেঘ ও রৌদ্রকে ঘিরে মানুষের মনের আকাশেও আলো আধাঁরির কী বিচিত্র খেলা কবি তা লক্ষ্য করেছেন।
পুজো, পুজোর ছুটি, পুজোর সাজ ইত্যাদি নিয়ে একটির পর একটি কবিতা বা গল্প লিখে চলেছেন। বিষয় বৈচিত্র্যের প্রত্যেকটিই অভিনব, তবুও তারই মধ্যে কোথায় যেন একটা ঐক্য খুঁজে পাওয়া যায়। আনন্দের সমারোহের মাঝে রয়েছে কোথায় যেন একটা করুন স্বরের ধারা। দুর্গোৎসবের আর এক নাম শারদোৎসব, ‘রাসমনির ছেলে’ গল্পটিও একপ্রকার পূজোর সময়ের গল্প, পূজোর সাজের গল্প। ভারতীতে ১৩১৮ আশ্বিনে (১৯১১) মুদ্রিত। এই গল্প পুত্র কালিপদ ও তার বাবা মা ভবানীচরণ ও রাসমনির। ভবানীচরণ বনেদি চৌধুরী পরিবারের মানুষ। কিন্তু ঘটনা চক্রে আজ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। পূজার সময় তাঁই মনে পড়ে, কর্তাদের আমলে নুতন সাজসজ্জা পরিয়া তাঁহারা কিরূপ উৎসাহ বোধ করিয়াছেন। পূজার দিনে রাসমণি কালীপদর জন্য যে সস্তা কাপড় জামার ব্যবস্থা করিয়াছেন সাবেক কালে তাঁহাদের বাড়ির ভৃত্তরাও তাহাতে আপত্তি করিত। রাসমনি স্বামীকে অনেক করিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন যে, কালীপদকে যাহা দেওয়া যায় তাহাতেই সে খুশি হয়, সে তো সাবেক কালের কথা কিছুই জানে না। তুমি কেন মিছা মিছি মন ভার করিয়া থাক। কিন্তু ভবানীচরণ কিছুতেই ভুলিতে পারে না যে, বেচারা কালিপদ আপন বংশের গৌরব জানেনা বলিয়া তাহাকে ঠকানো হইতেছে।
এখানে ঠকানো আর প্রায়চিত্র গল্পে প্রতারণা শব্দ ব্যবহূত হয়েছে। এখানে বাবা নিজেই বেদনা বোধ করছে ছেলেকে পূজোয় যাথাপযুক্ত উপহার না দিতে পারার জন্যে। যদিও ছেলে এই সামান্য উপহারেই গর্বে ও আনন্দে নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। এখানে ইংরেজ শাসিত ভারতের জমিদারি প্রথার ক্ষয়িক্ষ্মু দিকগুলো কবি তুলির আচড়ে যেন তুলে ধরেছেন।
প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ বাবুই সম্ভবত: দুর্গাপূজা সংখ্যায় প্রথম লেখার জন্য কবিকে অগ্রিম টাকা দিয়েছিলেন। সেই অগ্রিমের চাপেই লেখা শুরু হয়েছিল গোরা’ উপন্যাসের। কবির জীবনের শেষ পর্বে আনন্দবাজার পত্রিকা অগ্রিম টাকা দিয়ে নুতন লেখা আদায়ের চেষ্টা করে। আনন্দবাজার ১৯৩৯, ১৯৪০ সালে পর পর দু’বছর কবির দুখানি বড় গল্প প্রকাশ করে। ১৯৩৯ এর শারদীয়ায় রবিবার আর ১৯৪০ এর শারদীয়ায় ল্যাবরেটারী। ফলে কবির শেষ জীবনে পূজো সংখ্যায় দুটো বড় গল্প পাঠক পান। এদিকে ৮০ ছুঁই ছুঁই রীন্দ্রনাথ-কত আর লিখেবেন? কৌতুক করে বলেছেন, সম্পাদক তাগিদ নিত্য চলছে বাহিরে, অন্তরেতে লেখার তাগিদ একটু নাহি রে, মৌণ মনের মধ্যে/গদ্যে কিংবা পদ্যে। তবুও লিখতে হয়, সম্পাদকদের দাবি এড়াতে কঠিন হয়ে ওঠে। বিশেষ করে পুজো সংখ্যার জন্য গদ্য হোক কিংবা পদ্য কিছু তো চাই। রবীন্দ্রনাথের লেখা ছাড়া কি পূজোসংখ্যা জমে?
কবি শুধু কবিতা, গল্প বা উপন্যাসে দুর্গাপূজাকে তুলে ধরেন নি। ১৮৯৪ এর ৫ অক্টোবর কলকাতা থেকে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে লিখেন, কাল দুর্গাপূজা আরম্ভ হবে, আজ তার সুন্দর সূচনা হয়েছে। ঘরের ঘরে সমসত দেশের লোকের মনে যখন একটা আনন্দের হিল্লোল প্রবাহিত হচ্ছে তখন তাদের সঙ্গে সাময়িক বিচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও সে আনন্দ মনকে স্পর্শ করে। পরশু দিন সকালে সুরেশ সমাজপতির বাড়ি যাবার সময় দেখেছিলুম রাস্তার দু’ধারে প্রায় বড়ো বড়ো বাড়ির দালান মাত্রেই দুর্গার দশ হাত তোলা প্রতিমা তৈরি হচ্ছে এবং আশে পাশে সমস্ত বাড়ির ছেলের দল ভারী চঞ্চল হয়ে উঠছে। দেখে আমার মনে হলো দেশের সমস্ত ছেলে বুড়ো সকলেই হঠাৎ দিন কতকের মতো ছেলে মানুষ হয়ে উঠে সবাই মিলে একটা বড়ো গোছের পুতুল খেলায় প্রবৃত্ত হয়েছে। ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে সমস্ত আনন্দ মাত্রই পুতুল খেলা, অর্থাৎ তাতে কোন উদ্দেশ্য নেই, লাভ নেই - বাইরের থেকে দেখে মনে হয় বৃথা সময় নষ্ট। কিন্তু সমস্ত দেশের লোকের মনে যাতে করে একটা ভাবের আন্দোলন, একটা বৃহৎ উচ্ছ্বাস এনে দেয়, সে জিনিসটা কখনোই নিষ্ফল এবং সামান্য নয়।...প্রতি বৎসরের এই ভাবের প্লাবনে নিশ্চয়ই মানুষকে অনেকটা পরিমানে মানবিক করে দেয়, কিছু কালের জন্যে মনে এমন একটি অনুকূল আর্দ্র অবস্থা এনে দেয় যাতে প্রীতি দয়া মায়া সহজে অঙ্কুরিত হতে পারে। দুর্গাপূজার সামগ্রিক আয়োজনের মধ্যে একটা মানবিক আবেদন একটা আনন্দমুখর মিলনের আবেগ রয়েছে-তা কবি বরাবরই লক্ষ করেছেন।
রবীন্দ্র সাহিত্যে দুর্গোৎসব সমাজ তথা সাধারণ মানুষের কথাকে অসাধারণ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন। যা পাঠক মাত্রই সাহিত্যিক রসে উদ্ভাসিত হবে, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও অনুষ্টান নির্মাতা