বিশ্বজমিন

চিঠি আর ল্যান্ডলাইনে ফিরেছে কাশ্মীর

সৌতিক বিশ্বাস

১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:০০ পূর্বাহ্ন

টানা টানা স্পষ্ট হাতের লেখা দিল্লির এই নারীর। গত মাসে তিনি ভারতশাসিত কাশ্মীরে অবস্থানরত বন্ধুবান্ধবদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন। জুলাইয়ে ছুটিতে কাশ্মীরে বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু উত্তাল এই সময়ে তারা কেমন আছেন, কোথায় আছেন, তা জানতে অস্থির হয়ে ওঠেন তিনি। সেজন্যই চিঠির দ্বারস্থ হলেন। কালো অক্ষরে লিখলেন, ‘আহ! কী নিষ্ঠুর সময়!’ কিন্তু এ-ও লিখতে ভুললেন না যে, ‘সূর্যোদয়ের আগেই রাত সবচেয়ে অন্ধকার থাকে। সূর্যোদয়ের সময় হয়তো এখনও আসেনি।’ চিঠির শেষ টানলেন এই বলে যে, ‘আমার হৃদয় আজ ভেঙ্গে চৌচির।’ এই আহাজারির কারণটা সহজেই অনুমেয়।

প্রায় ১ কোটি মানুষের বসবাস উত্তাল কাশ্মীরে। ৫ই আগস্ট থেকে এই পুরো অঞ্চল নিরাপত্তা চাদরে বন্দি। ওইদিনই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের ইতি ঘটান ও রাজ্যের মর্যাদা হরণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আরোপ করা হয় যোগাযোগ অবরোধ। ল্যান্ডফোন, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফলে দেশ-বিদেশের সঙ্গে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতা যেন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। স্থানীয় এক সম্পাদকের ভাষায়, কাশ্মীর যেন ‘তথ্য কৃষ্ণগহ্বরের’ কবলে পড়েছে। এক মাসের বেশি হয়ে গেল, এখনও বহাল রয়েছে অবরোধ। তবে সরকার বলছে, ৮০ শতাংশ ল্যান্ডলাইন ফোনই পুনরায় চালু করা হয়েছে।

দিল্লির সেই নারী চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন যখন তিনি কাশ্মীরি এক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকের ফেসবুক পোস্ট পড়লেন। ভিকার সায়েদ নামে ওই সাংবাদিক এখন দিল্লিতে। তিনি সেখানে গেছেন ইন্টারনেট সুবিধা পেতে আর সেখানকার সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে বিভিন্ন আইডিয়া উপস্থাপনা করতে। হঠাৎ কী মনে করে যেন তিনি ফেসবুকে পোস্ট করলেন, কাশ্মীরে যে জেলায় তিনি বসবাস করেন, সেখানে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনের জন্য কেউ চাইলে তার কাছে বার্তা দিতে পারেন। তিনি সেগুলো ঠিকানা মোতাবেক পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। তিনি লিখলেন, ‘ফিরে গিয়ে প্রত্যেক ঠিকানায় চিঠিগুলো পৌঁছানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।’

দুই দিন পর সায়েদ কাশ্মীরের শ্রীনগরে ফিরে গেলেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৭টি চিঠি নিয়ে গেলেন সঙ্গে। দক্ষিণ কাশ্মীরের ৩টি জেলায় বসবাসরত আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের উদ্দেশ্যে ওই চিঠিগুলো লেখা হয়েছে। আর দক্ষিণ কাশ্মীরই সবচেয়ে বেশি উত্তাল। কেউ ডিজিটাল বার্তা দিয়েছেন। কেউবা আবার কাগজে চিঠি লিখেছেন। তারপর ছবি তুলে ফেসবুক মেসেঞ্জারে আপলোড করেছেন।
দিল্লির ওই নারীও তেমনি একজন। তিনি নিজে অবশ্য কাশ্মীরি নন। যোগাযোগ অবরোধের ফলে যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে কাশ্মীরের বাইরের লোকজনদের মধ্যে তা-ই যেন প্রগাঢ় হয়ে ফুটে উঠেছে ওই নারীর লেখা চিঠিতে। তিনি লিখেছেন, কাশ্মীরে বিভিন্নজনের নম্বর ডায়াল করতে করতে তার আঙ্গুল ব্যথা হয়ে গেছে। তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমি মাঝেমাঝে রাতে জেগে উঠে ফোন চেক করি। কেউ মেসেজ পাঠিয়েছে কিনা দেখি। আবার কিছু নম্বর ডায়াল করি। কাশ্মীরে কাটানো ছুটির দিনগুলোর ছবি বার বার করে দেখি।’

ওদিকে কাশ্মীরে গিয়ে সায়েদ রীতিমতো বার্তাবাহক হয়ে গেলেন। শ্রীনগর থেকে বিভিন্ন বার্তা ও চিঠি অন্য শহর ও গ্রামে পৌঁছে দিলেন তিনি। তার প্রাণহীন মোবাইল ফোন হঠাৎ যেন মূল্যবান সব অনুভূতির বাহক হয়ে গেল। তার ভাষায়, ‘আমি ঠিকানা দেখে দেখে মানুষের বাড়ি খুঁজে বের করেছি। তাদের দরজায় কড়া নেড়েছি। আর তাদের জন্য আনা বার্তা দেখিয়েছি। তবে বেশিরভাগের পরিস্থিতি ভালো ছিলো।’ অনেক সময় অবশ্য আবেগী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, একটি বাড়িতে দেখা গেলো, চন্দিগড়ে একটি কলেজে পড়ছে এমন এক ছেলের পিতামাতা জানতে পারলেন তাদের ছেলে পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছে। সায়েদ জানালেন, ‘ওই মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর কাঁদতে শুরু করলেন।’

যোগাযোগবিহীন থাকলে বোধ হয় পুরোনো অভ্যাস জেগে ওঠে। যেমন, কাশ্মীরে এই যোগাযোগহীনতার মধ্যে মানুষের মধ্যে চিঠি লেখালেখি শুরু হয়ে গেছে। ২৬ বছর বয়সী ইরফান আহমেদ আরেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্রীর প্রেমে পড়েছেন। ওই যুবতী ওই এলাকাতেই থাকেন। তারা একে অপরের জন্য অনুভূতিসূচক চিঠি লিখে দলা পাকিয়ে সেগুলো একে অপরের ঘরে ছুড়ে মারেন। এতে করেই তাদের যোগাযোগটা এখনও আছে। দেখা সাক্ষাতের সময়সূচিও এভাবেই নির্ধারিত হয়। এই চিঠিতে ভালোবাসা যেমন আছে, একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়ার বেদনা আর উদ্বেগও আছে সমানভাবে।

ইরফান একটি অফিসে রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করেন। তার ভাষ্য, ‘অবরোধের পর আমরা ফোনে কথা বলতে বা দেখা করতে পারতাম না। তাই আমরা চিঠি লেখা শুরু করেছি। আমরা একে অপরকে লিখি আমরা একজন অপরজনকে কতটা মিস করি। এই যোগাযোগহীনতা কত নিষ্ঠুর সেটা বলি। আমি পরে যখন জবাব লিখি, সেটা আবার দলা পেচিয়ে তার শোয়ার কক্ষে ফেলে আসি। এভাবেই বেশ কয়েকবার চিঠি চালাচালি হয়েছে আমাদের।’

যোগাযোগ-অবরোধের কারণে ল্যান্ডলাইনের চলও ফের তৈরি হয়েছে কাশ্মীরে, যা কিনা সেখানকার মানুষ ব্যবহার করা মোটামুটি বন্ধই করে দিয়েছিল। ভারতে ১০০ কোটিরও বেশি মোবাইল ফোন গ্রাহক রয়েছে। এদের মধ্যে ৫৬ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ডিজিটাল বাজার ভারত। তুলনামূলকভাবে, দেশটিতে মাত্র ২ কোটি ৩০ লাখ ল্যান্ডলাইন রয়েছে।
কিন্তু কাশ্মীরে মানুষজন নতুন নতুন ল্যান্ডলাইন সংযোগের জন্য আবেদন করছে বা অব্যবহৃত সংযোগ পুনরায় চালু করার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে দ্বিতীয় মাসে গড়ালো অবরোধ। ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন ফোন জীবন ফিরে পাচ্ছে। রাস্তায় অবশ্য নিরাপত্তা বাহিনী অস্থায়ী ফোন বুথ খুলেছে। কিছু পুলিশ স্টেশন থেকে বিনামূল্যে ফোন করা যায়।

এ ধরণের একটি বুথেই কথা বলার চেষ্টা করছিলেন মনজুর আহমেদ। ৫৫ বছর বয়সী এই শাল বিক্রেতা কাশ্মীরের বাইরের কিছু ক্রেতার কাছ থেকে অর্থ পান। তাদের সঙ্গেই ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘তারা আমাকে চেক পাঠিয়েছে। আমি ব্যাংকে গেলাম। কিন্তু তারা বললো, তাদের এখানে কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে তারা অর্থ উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে পারছে না। আমি এখন শহরজুড়ে ঘুরছি। একটি ফোনের জন্য। ফোন পেলেই আমি আমার ক্রেতাদের বলবো ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে।’

ইয়াসমিন মাসরাতের একটি ট্রাভেল এজেন্সি আছে। তিনি মধ্য আগস্টে বেশ সাহস নিয়ে নিজের অফিস খুললেন। নিজের একটিমাত্র ল্যান্ডলাইন থেকে বিনামূল্যে কথা বলার সুযোগ দিলেন। তার অফিসে নোটিশ টাঙানো হয়েছে এখন। সেখানে লেখা, ‘কথা সংক্ষিপ্ত করুন। কেননা, আমাদের টাকা কাটা যায়।’ মুখে মুখে শুনে তার অফিসের কথা সারা শহর জেনে গেছে। প্রতিদিন তার অফিস থেকে প্রায় ১ হাজার বিনামূল্যে ফোন কল করা হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ ক্যান্সার রোগী। তারা ভারতের বিভিন্ন শহরে ডাক্তারকে ফোন করছেন, কিংবা ওষুধের জন্য দোকানে ফোন করছেন। একদিন নানীর সঙ্গে দোকানে এলো ৮ বছর বয়সী এক কন্যাশিশু। সে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়। ক্যান্সার আক্রান্ত তার মা মুম্বইয়ের কোনো এক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে ২০ দিন ধরে যোগাযোগ হয়নি। মেয়েটি বার বার তার মাকে বললো, ‘তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো আর ফিরে আসো।’
মাসরাত বললেন, খুবই আবেগঘন পরিস্থিতি। যারাই আসে, তারাই কাঁদে। আরেক লোক এলেন কিছুক্ষণ পর। তিনি তার ছেলেকে জানাতে চান যে, তার দাদী কয়েকদিন আগে মারা গেছেন।

কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। ফলে এই তথ্য অবরোধ সহসাই প্রত্যাহার বা কমানো হবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু আশার রশ্মি দেখা যায়। গত সপ্তাহে এক সকালে স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থার ভাড়া করা লাইন দৈবভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলো। প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ রউফ বললেন, ‘হয়তো এখন থেকে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে। আমরা আশায় বেঁচে আছি।’
(সৌতিক বিশ্বাস বিবিসির ভারত প্রতিবেদক। তার নিবন্ধটি বিবিসির মূল ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status