প্রথম পাতা

ইসরার কান্না থামাবে কে?

মরিয়ম চম্পা

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:০০ পূর্বাহ্ন

পুরো নাম তাহরিন হাসান ইসরা। বয়স মাত্র এক বছর তিন মাস। এখনো মুখে কথা ফোটেনি। সারাক্ষণ শুধু ‘মা’ ‘মা’ বলে কান্না করে। দিনের বেলায় তাকে কোনোভাবে শান্ত করা গেলেও রাতের বেলায় একদমই থামতে চায় না। মিরপুরের মণিপুরের বাসায় রুমের চারপাশে তাকায় আর মাকে খুঁজে বেড়ায় ছোট্ট ইসরা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাকে খুঁজে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। স্বজন হারানোর শোকের  সঙ্গে ইসরার এমন কষ্টে একেবারেই ভেঙে পড়েছে পুরো পরিবার। গত বৃহস্পতিবার মহাখালীতে বাস চাপায় মারা যান ইসরার মা ফারহানাজ। স্ত্রীর শোকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ার পাশাপাশি মেয়ের কষ্ট দেখে ভেঙ্গে পরেছেন বাবা নাজমুল হাসান। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমাদের সংসার জীবনের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে গত রোববার। ৮ই সেপ্টেম্বর ছিল আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। অথচ সে আমাদের মাঝে নেই। মাত্র জীবন শুরু করেছি আমরা। এমন সময় ফারহানাজ আমাদের ছেড়ে চলে গেল। এই কষ্ট আমি কিভাবে সইবো। অনেক আগেই মা‘কে বলেছিলাম, বিদেশ চলে যাবো। তখন বিদেশে গেলে আজকে হয়তো আমার স্ত্রীকে হারাতে হতো না। আমার সন্তানকে মা হারা হতে হতো না। ‘যে দেশে মানুষ ফুটপাতেও নিরাপদ না। যে দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও মানুষের জীবনের দাম বাড়েনি সে দেশে স্ত্রী হত্যার বিচার পাবো কি? আমাদের দুজনের মধ্যে জানাশোনা থাকলেও ২০১৭ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় আমাদের। আমাদের দিনগুলো খুব সুখেই কাটছিল। হঠাৎ করে এভাবে সব এলোমেলো হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। ও খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিল। আমরা তিন ভাই। আমাদের কোনো বোন নেই। তাই মা ফারহানাজকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। ও আসলে এতোটাই ভালো ছিল যে, সারাদিন অফিসে খাটাখাটনি করে বাসায় এসে সংসারের সকল কাজ নিজেই করতো। আমার কখন কি লাগবে সে বিষয়ে ও খুব সচেতন ছিল। ওকে হারানোর কষ্টটা সারাজীবনই থেকে যাবে।  
মেয়েকে নিয়ে সে অনেক স্বপ্ন দেখতো। কোন স্কুলে ভর্তি করবে। তার ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবে। তিন থেকে সারে তিন বছর বয়সে বাসায় হুজুর রেখে মেয়েকে কোরআন শিখাবে। কিন্তু সবই যে অপূর্ণ রয়ে গেল। ঘটনার দিন আমি প্রতিদিনের মতো ওকে নিজের মোটরসাইকেলে  করে মহাখালি নামিয়ে দেই। প্রতিদিন আমি ওকে বলি, দেখে শুনে রাস্তা পাড় হইয়ো আল্লাহর নাম নিয়ে’। ওই দিন আমি বলার আগেই ও আমাকে একই কথা বলেছে। ও তো রাস্তা দেখেই পাড় হয়েছিল। ফুটপাতের ওপরেও যে মানুষ নিরাপদ না এটা ও বুঝবে কিভাবে। আমি অফিসে যাওয়ার পর ৯ টা ১০ মিনিটে ওর অফিস থেকে আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হয় ইসরার আম্মু এক্সিডেন্ট করেছে। মেয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাতের বেলায় শুধু মা’কে খোঁজে। রাতে সে অনেক বিরক্ত করে। এটাই এখন বড় সমস্যা। সারাদিন ওর দাদির সঙ্গে থাকে। রাতের বেলা ঘুমানোর আগে খুব কান্না করে। এ এখনো তেমন কথা বলতে পারে না। আগে ও খুব বেশি ডাকতো না। তবে গত দুই থেকে তিন দিন ধরে কান্না করার সময় ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় আল্লাহ নিবেই যখন তিনজনকে একসঙ্গে নিয়ে যেত। তাহলেই হয়তো ভালো হত। কিংবা ওকে না নিয়ে আল্লাহ আমাকে নিতেন। তাহলে মেয়েটা অন্তত মায়ের কাছে থাকতে পারতো। রাতে এখন আমি, মা আর ইসরা একসঙ্গে ঘুমাই। এতোই কান্নাকাটি করে যে, একবার ঘুম থেকে উঠলে আর ঘুমাতে চায় না। একেতো আমার মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা ভালো না। তার ওপর ওর কান্না দেখে ঘরে থাকতে পারি না। খুব কষ্ট হয়। আমার আর কিছুই বাকি রইলো না। সব শেষ হয়ে গেছে। এরকম দুর্ঘটনায় মৃত্যু মেনে নেয়া খুব কষ্টকর। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কতো আন্দোলন হলো। কতো কিছু হলো। আসলে যারা এসব করছে তাদের তো আর কেউ হারায় না। আমরা যারা সাধারণ মানুষ আমাদের আপনজন হারায়। যার হারায় একমাত্র সেই বুঝতে পারে কি হারিয়েছে। ইসরার বড় চাচা মোহাম্মদ সাইফুল রহমান বলেন, ছোট ভাই নাজমুল হাসান তার স্ত্রীকে হারিয়ে  শোকে অনেকটা পাথর হয়ে গেছে। শারীরিকভাবে সে অনেক অসুস্থ। কিছুই খাচ্ছে না, ঘুমাতে পারছে না। রোববার থেকে ইসরার ঠান্ডা জ্বর। মেয়েটা এতোদিন কোনো কথা বলতো না। কয়েক দিন থেকে ‘মা’-‘মা’ বলে কান্না করছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status