ষোলো আনা

কোথায় হারালো গরুর গাড়ি?

সাওরাত হোসেন সোহেল

৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ৮:৩৫ পূর্বাহ্ন

‘ধীরে বলাও গাড়িরে গাড়িয়াল, আস্তে  বোলাও গাড়ি। আর একনজর দেখিয়ে নেও মুই দয়াল বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল, ধীরে  বোলাও গাড়ি।’ রাস্তায় আর দেখা মেলে না গরুর গাড়ি। ঘুরছে মোটরের চাকা। নববধূরাও আর ওঠেন না গরুর গাড়িতে।

উত্তরের ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াইয়া গান। যেই গানের সুরে পরিচিতি লাভ করে চিলমারীর ঐতিহ্য গরুর গাড়ি। নববধূরা স্বামীর বাড়ি  থেকে বাবার বাড়ি যেতেন গরুর গাড়িতে করে। ফেরার ক্ষেত্রেও ছিল একই বাহন। গানে গাড়িয়ালকে অনুনয়-বিনয় করে বলছিলেন, গাড়িয়াল ভাই- গাড়িটা আস্তে চালান। যাতে বাবার বাড়ির এলাকা যেন দীর্ঘক্ষণ দেখা যায়। সেই গাড়ি আজ হারিয়ে  গেছে। নববধূরাও আর ওঠেন না গরুর গাড়িতে।

কুড়িগ্রাম জেলার প্রত্যন্ত এলাকার উপজেলা চিলমারী। এই উপজেলার ঐতিহ্য গরুর গাড়ি। এক সময় আধুনিক গাড়ি ছিল না। তখন মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের জন্য ছিল গরু চালিত গাড়ি। গরুর মতো মহিষকে দিয়েও গাড়ি টানা হয়। কিন্তু সেটা হলো মইষালের গাড়ি। এক সময় চিলমারী ছিল গরুর গাড়ির জন্য বিখ্যাত। এই গরুর গাড়িকে কেন্দ্র করে ভাওয়াইয়া ও পল্লীগীতির সম্রাট মরমি শিল্পী মরহুম আব্বাস উদ্দিন চিলমারীর ঐহিত্যকে সামনে রেখে সুর মিলালেন, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে’। সে সময় সনামধন্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ গরুর গাড়িতে করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতেন। তখনকার সময় বিয়ে মানেই কে কত বেশি গরুর গাড়ির দীর্ঘ লাইনের বহর নিয়ে আনতে যাবেন বাড়ির বউ।

গাড়িয়াল আম্মার আলী জানান, গরুর গাড়ির দীর্ঘ লাইন আর সঙ্গে ছিল হিজ মাস্টার কলের গান চালিত মাইক। ঐ মাইকের সুর ভাসত- ‘যে দিন গাড়িয়াল উজান যায়, নারীরমন মোর ঝুরিয়া রয় রে। ওকি গাড়িয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’।

উপজেলার সবুজপাড়া এলাকার সাবেক মেম্বার বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ রহিম জানান- তার বিয়েতে ১১টি গরুর গাড়ি ছিলো। কিন্তু তার ছেলের বিয়েতে নেয়া হয় মাইক্রোবাস। তিনি দুঃখ করে বলেন, কয়েকটি গরুর গাড়ি যখন এক সঙ্গে রাস্তায় চলতো কি যে ভালো লাগতো। তা আর এখন চোখেই পড়ে না। সাবেক ইউপি সদস্য লুৎফর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা লুৎফুন্নেছার বিয়েতেও গরুর গাড়ি ছিল ২৩টি। সঙ্গে ছিল একই ধরনের একটি মাইক সেট। ঐ মাইকের সুর ভাসতে ছিল- ‘ইট দিয়ে বান্দিছে ঘাটা গরুর গাড়িত মোটরের চাকা’। দেখা হয় উপজেলার গাড়িয়াল ফুল মিয়া সঙ্গে। তিনি জানান, তারা অনেকজন গাড়িয়াল একসঙ্গে রওনা হতেন উলিপুর। মালামাল নিয়ে বিকালের দিকে আবার চিলমারী বন্দরের দিকে ছুটে চলতেন। পাটের গাঁইটসহ বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করতেন তারা। সেই ব্যবসার আর চাহিদা নাই। আবার বয়স বৃদ্ধির কারণে তার ছেলেরা আর সেই গাড়ি চালান না। এখন বেছে নিয়েছেন ট্রলি। দেখা মেলে ঘোড়ার গাড়িও।

গাড়িয়ালের পরনে থাকতো লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। আর মাথায় চিলমারীয়া গামছা। আধুনিক যানবাহনের বিস্তার লাভ করায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের কদর কমেছে। পল্লীর পথে-প্রান্তরে এখনও কিছু গরুর গাড়ির দেখা মেলে। তবে তার কদর নেই বললেই চলে। বর্তমানে বিয়েতে আর গরুর গাড়ি দেখা যায় না। গাড়িয়াল আমিনুল জানান, গরুর গাড়ি রাখা কঠিন কাজ। গরুর দাম বেশি। কাঠ, বাঁশ ও গো-খাদ্যের দাম বেশি। অপরদিকে অভাব-অনটন লেগেই আছে। এসব কারণে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য গরুর গাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে। আর নববধূরা উঠেছেন মোটরগাড়িতে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status