প্রথম পাতা

কাশ্মীরের যে এলাকা এখনো মুক্ত

মানবজমিন ডেস্ক

২২ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:৩০ পূর্বাহ্ন

কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ও প্রধান শহর শ্রীনগরের শহরতলী সৌরা। প্রায় ১৫ হাজার জনগণের ওই এলাকাটির প্রত্যেক প্রবেশদ্বারে ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিচ্ছে সেখানকার তরুণরা। শহরতলিটির কয়েক ডজন প্রবেশদ্বারে তৈরি করা হয়েছে ইট-কাঠের অস্থায়ী ব্যারিকেড। পাহারাদারদের হাতে ভারী অস্ত্রের বদলে শোভা পাচ্ছে পাথরের টুকরা। তাদের লক্ষ্য- ভারতীয় সেনাদের প্রবেশ ঠেকানো। কাশ্মীর স্বায়ত্তশাসনের অধিকার হারানোর পর পার হয়ে গেছে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময়। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করে অঙ্গরাজ্যটির বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকার। মোতায়েন করা হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ সেনা। অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কাশ্মীরিদের। কিন্তু এখনো সৌরায় ঢুকতে পারেনি ভারতীয় সেনাবাহিনী।

কাশ্মীরে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক
সৌরার তরুণ বাসিন্দা ২৫ বছর বয়সী এজাজ। রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমাদের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটছে। এছাড়া আমাদের হাতে অন্যকোনো উপায় নেই। বিশ্ব যদি আমাদের কথা না শোনে, তাহলে আমাদের কী করা উচিত? বন্দুক হাতে তুলে নেবো? সাক্ষাৎকারে এজাজ নিজের নামের শেষাংশ বলেননি।
সৌরার এই প্রতিবাদ কাশ্মীরের অভ্যন্তরে ভারত সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠেছে। কার্যকরভাবে ভারতীয় সেনাদের প্রবেশ সেখানে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কাশ্মীরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা এখন সৌরা।

সরকারের দাবি, কাশ্মীরকে পুরোপুরি ভারতের অংশ করে তুলতেই তাদের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়া হয়েছে। রাজ্যটি থেকে দুর্নীতি দূর করতে, উন্নয়ন ঘটাতে ও সন্ত্রাসবাদ দূর করতে এটা প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু সৌরা সরকারের পদক্ষেপের মুখে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানের কোনো বাসিন্দাই মোদি সরকারের এই পদক্ষেপকে সমর্থক করে না। গত সপ্তাহে এলাকাটির কয়েক ডজন বাসিন্দার সাক্ষাৎকার শেষে এমনটা জানিয়েছে রয়টার্স। তারা মোদিকে ‘জালিম’ বা অত্যাচারী হিসেবে বর্ণনা করেছে।

কাশ্মীর ঘিরে সাংবিধানিক পরিবর্তন আসায় এখন সেখান থেকে যে কেউ জমি কিনতে পারবেন। সেখানের স্থানীয় সরকারের হয়ে কাজ করার আবেদন জানাতে পারবেন। আগে ৩৭০ ধারার আওতায়, তা অসম্ভব ছিল। কেবল কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই এই সুযোগ ভোগ করতেন। কাশ্মীরিরা আশঙ্কা করছেন, ধারাটি রদ হওয়ায় এখন সেখানে হিন্দুদের ঢল নামবে। পুরো রাজ্যজুড়ে প্রতিস্থাপিত হবে মুসলিমরা। তাদের সংস্কৃতি ও ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এই ভীতি থেকেই সৌরার জনগণ এলাকাটি কঠোরভাবে পাহারা দিয়ে রাখছে।

এজাজ বলেন, আমাদের মনে হচ্ছে আমরা এখানে লাইন অব কনট্রোল রক্ষা করছি। উল্লেখ্য, লাইন অব কনট্রোল হচ্ছে, পাকিস্তান ও ভারতের এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন কয়েক ডজন মানুষ। আটক হয়েছেন অনেকে। তবে কতজন আটক হয়েছে সে বিষয়ে সপষ্ট কোনো ধারণা নেই তাদের। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল রয়টার্স। তবে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায় জম্মু ও কাশ্মীর সরকার। সাড়া মেলেনি ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও।

যেভাবে সেনাদের প্রবেশ ঠেকাচ্ছে বিদ্রোহীরা
কাশ্মীর অবরুদ্ধ হওয়ার পর প্রথম বড় বিক্ষোভ হয় শ্রীনগরে। সেখানে চার জনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাস্তার প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। আটক করা হয়েছে পাঁচশর বেশি স্থানীয় নেতাদের। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন পরিষেবা। এতে সরকার-বিরোধীদের জন্য বিক্ষোভ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সমপ্রতি পুরো কাশ্মীরজুড়ে ইন্টারনেট ও ল্যান্ডলাইন ফোনসেবা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। কেবল সৌরায় কোনো ধরণের পরিষেবা ফেরত আসেনি। অঞ্চলটির মুসলিমদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এছাড়া, একটি প্রসিদ্ধ প্রশিক্ষণ হাসপাতালের জন্যও এলাকাটি সুপরিচিত।

তবে সরকারি বাধা উপেক্ষা করেও জড়ো হচ্ছে সৌরার জনগণ। যোগাযোগ হচ্ছে ভিন্ন উপায়ে। সেখানকার কোনো বাসিন্দা সামরিক সেনাদের প্রবেশ করতে দেখলে, তাৎক্ষণিকভাবে মসজিদে গিয়ে বাকিদের সতর্ক করে। তারা এমনটা করে মসজিদের মাইকগুলো ব্যবহার করে। আযানের আদলে অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানায় তারা।

আগস্টের ৯ তারিখ শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে সৌরায় বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়। এতেই ভারত সরকারের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠে সৌরার জনগণ। আশেপাশের অঞ্চলের মানুষজনও তাদের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দেয় সেদিন। সবমিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছিল বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা।
সৌরার বাসিন্দারা জানান, ৯ তারিখ বিক্ষোভের পর সেখানে প্রবেশ করতে চেয়েছিল ১৫০ থেকে ২০০ সেনা। তাদের পরনে ছিল দাঙ্গা দমনকারী পুলিশের পোশাক। সেদিন রাত পর্যন্ত সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় সৌরার বাসিন্দাদের। আহত হন অনেকে। প্রাথমিকভাবে ওই বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের কথা অস্বীকার করেছিল ভারত সরকার। দাবি করেছিল, সৌরায় ২০ জনের বেশি মানুষের কোনো বিক্ষোভ হয়নি। তবে পরে বিবিসি ও আল জাজিরায় বিক্ষোভের ফুটেজ প্রচার হলে জানায়, ওই বিক্ষোভে ১ হাজার থেকে ১৫০০ মানুষ অংশ নিয়েছিল।

সৌরার আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারা জানান, ওই ঘটনার পর থেকে সেনা সদস্যদের সঙ্গে ছোট ছোট সংঘর্ষ লেগেই রয়েছে সৌরার বিক্ষোভকারীদের। প্রায় প্রতিদিনই ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছে। ওয়াইস নামের স্থানীয় এক তরুণ জানান, সেনারা প্রতিদিনই প্রবেশের চেষ্টা চালায়। তিনি বলেন, তারা প্রতিদিনই এখানে হামলা চালানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু আমরাও পাল্টা লড়াই করে চলেছি। মনে হচ্ছে আমরা চারদিক থেকে আটকা পড়ে গেছি।  ভারতীয় সেনারা সৌরার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া। নাম না প্রকাশের শর্তে স্থানীয় এক আধা-সামরিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আমরা সেখানে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু এলাকাটি থেকে প্রচুর বিদ্রোহের সম্মুখীন হচ্ছি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status