বিশ্বজমিন

শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ কী?

মানবজমিন ডেস্ক

২০ আগস্ট ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:০৮ অপরাহ্ন

বিশ্বজুড়ে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসী হামলা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। এ বছর নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ ও যুক্তরাষ্ট্রের এল পাসো হত্যাযজ্ঞ এর মধ্যে অন্যতম। হামলাকারীরা এ ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা ‘প্রতিস্থাপিত’ হওয়া নিয়ে আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে থাকে। এছাড়া এ ধরণের পূর্ববর্তী হামলা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথাও তারা স্বীকার করে। বিশেষ করে, নরওয়ের অসলো ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপে ২০১১ সালে আন্দ্রে ব্রেইভিক যেভাবে ৭৭ জন মানুষকে হত্যা করেছে, তা এই শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের রীতিমতো অনুপ্রেরণা যোগায়! কিন্তু এই শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ বা হোয়াইট ন্যাশনালিজম কী? এই ধারণার উৎপত্তি হয়েছে কীভাবে? লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন এই প্রশ্নদ্বয়েরই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

ম্যাগাজিনটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। কেননা, তবে মোটা দাগে বলা যায়, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা শ্বেতাঙ্গদের জন্য একটি জাত-রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। অনেক শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী অবশ্য খোলাখুলিভাবে বলেন না যে, তাদের শ্বেতাঙ্গ জাত অন্য জাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। পরোক্ষভাবে তারা বলেন, (শ্বেতাঙ্গদের মতো) অন্যান্য জাতেরও নিজস্ব রাষ্ট্র থাকা উচিত। এমন অল্প ক’জন ‘উদারমনা’ বাদে, বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীকেই হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট বা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী বলা যায়। যারা কিনা মনে করেন, জগতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জাত হলো শ্বেতাঙ্গরা, অর্থাৎ বাকি সকলে তাদের চেয়ে নিকৃষ্টতর। এই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের দাবি বিভিন্ন রকমের। তাদের কেউ চান, কঠোরভাবে দেশে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করা হোক। আবার চরমপন্থীরা খোলাখুলিভাবেই অন্য জাতকে জাতিগতভাবে নির্মূল, এমনকি গণহত্যা সমর্থন করেন।

তাদের এমন বিদ্বেষের নেপথ্যে প্রায়ই থাকে শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা বা শ্বেতাঙ্গদের প্রতিস্থাপিত করার আশঙ্কা! শ্বেতাঙ্গ প্রতিস্থাপন বলতে বোঝানো হয় যে, ‘শ্বেতাঙ্গ জাতে’র মানুষদের মধ্যে নিম্ন জন্মহার, অন্য জাতের মানুষকে বিয়ে করা ও অ-শ্বেতাঙ্গ মানুষদের উচ্চ জন্মহারের কারণে শ্বেতাঙ্গদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।

আধুনিক শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ, যা এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, তার উৎপত্তি হয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর। গৃহযুদ্ধ শেষে সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা হয়। এরপর থেকেই সমাজে আমেরিকান শ্বেতাঙ্গরা (যারা মূলত পশ্চিম ইউরোপ থেকে যাওয়া আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান) নিজেদের উঁচু অবস্থান ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কিত বোধ করে। এরপর থেকেই বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এই শ্বেতাঙ্গদের বিশেষ সুবিধা ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন করা হয়। এসব আইনের মধ্যে ছিল কুখ্যাত ‘জিম ক্রো’ আইন, যার মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গদের জন্য আলাদা আলাদা স্কুল, কলেজ ও প্রার্থনাস্থল সৃষ্টির বৈধতা দেওয়া হয়। অন্যরা আবার রীতিমতো আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে সহিংসতা ও গণপিটুনিতে মত্ত হয়ে উঠে। পরবর্তীতে, অভিবাসনের হার বাড়লে, বিশেষ করে চীনা, আইরিশ ক্যাথলিক, দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউরোপিয়ান ও ইহুদীদের আগমনে এই শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে আরও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এরপর নতুন নতুন অভিবাসন আইন প্রণীত হয়, যার উদ্দেশ্য হলো অভিবাসীর হার কমানো। ১৯১৬ সালে ম্যাডিসন গ্রান্ট প্রকাশ করেন ‘দ্য পাসিং অব দ্য গ্রেট রেইস’। এই বইয়ে শ্বেতাঙ্গ ভাবনা ও উৎকৃষ্টতর মানবসন্তান জন্মানোর বিদ্যা ইউজেনিকস নিয়ে আলোচনা করা হয়। এভাবেই জন্ম হয় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও ‘রেইস সুইসাইড’ তত্ত্ব। এই তত্ত্ব তখন জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার পর্যন্ত পৌঁছায়, যিনি নিজে আবার জার্মানদের আর্য রক্তের অধিকারী হিসেবে আখ্যা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতেন। বলা হয়, ওই বই পড়ে হিটলার নিজে গ্রান্টকে চিঠি লিখে জানান, ‘দ্য পাসিং অব দ্য গ্রেট রেইস’ বইটি তার কাছে বাইবেল সমতুল্য।
পরবর্তীতে হিটলারের নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর লড়াই এবং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কারণে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ ব্যাপক নিন্দা কুড়ায়। কিন্তু বিংশ শতাব্দির শেষের দিকে এসে ফের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে শুরু করে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা। এই সময়ে এসে আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে তারা বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী সহিংস হামলা চালায়।

১৯৮৮ সালে ডেভিড লেইন একটি বই লিখেন, যার শিরোনাম ‘দ্য হোয়াইট জেনোসাইড ম্যানিফেস্টো’। এই বইয়ে গ্রান্টের ‘রেইস সুইসাইডে’র তত্ত্বকে নতুন নাম দেওয়া হয়। এই বইয়েই শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের মূল বক্তব্য নথিবদ্ধ করা হয়। এতে লেখা হয়, ‘আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের জনগণের অস্তিত্ব ও শ্বেতাঙ্গ শিশুদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।’ মূল ইংরেজি বাক্যটি ছিল ১৪টি শব্দের। শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের কাছে এই বাক্য এতটাই জনপ্রিয় হয়ে পড়ে যে, তারা একে ‘দ্য ফোর্টিন ওয়ার্ডস’ বলে সম্বোধন করে থাকে।

কিন্তু কেন শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা নিজ জাতকে শ্রেষ্ঠ মনে করে? এক্ষেত্রে নানা ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। এদের অনেকে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে ভীষণ সন্দেহপ্রবণ। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিলিশিয়া গ্রুপ এ ধরণের ধারণা পোষণ করে। কেউ কেউ আবার গৃহযুদ্ধকালীন ইতিহাসের পরিবর্তিত সংস্করণে বিশ্বাস করে, যেখানে কিনা দাসপ্রথার পক্ষপাতী কনফেডারেসি সরকারকে মহান হিসেবে তুলে ধরা হয়। কোনো কোনো শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী আবার ইহুদী-বিদ্বেষী ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করে ও মনে করে, গোটা দুনিয়া ইহুদীদের নিয়ন্ত্রণে! এরা এমন তত্ত্বেও বিশ্বাস করে যে, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন উস্কে দেওয়ার জন্য দায়ী আন্তর্জাতিক ইহুদী অভিজাত চক্র।
১৯৭৮ সালে ‘দ্য টার্নার ডাইরিজ’ নামে একটি শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ফ্যান্টাসি উপন্যাস রচনা করেন উইলিয়াম লুথার পিয়ের্স। এই উপন্যাসের কাহিনী এগিয়ে যায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ জাতের রক্ষকদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিদ্রোহের একটি কল্পিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই বইটি ‘দ্য হোয়াইট জেনোসাইড ম্যানিফেস্টো’ বইয়ের লেখক ডেভিড লেইনকে উজ্জীবিত করেছিল। এই বই দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছিল টিমোথি ম্যকভেহ নামে এক সাবেক সেনা সদস্য ও বন্দুক-অধিকারের পক্ষে সোচ্চার এক ব্যক্তিকেও, যিনি ১৯৯৫ সালে কুখ্যাত ওকলাহোমা সিটি বোমা হামলা চালান। ওই হামলায় ১৬৮ জন মানুষ নিহত হন।

ইন্টারনেটের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদও বিবর্তিত হয়। ইন্টারনেটের অন্ধকার গলিতে বিস্তৃত হতে থাকে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ। এসব বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়। কিন্তু এমন অদ্ভুত সব আলোচনা এমন অস্পষ্টভাবে সেখানে আলোচনা হয় যে, বোঝা মুশকিল আদৌ সত্যি সত্যি নিজের মনোভাব প্রকাশ করছে কেউ, নাকি মশকরা করছে! এতে করে, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা কৌশলে নিজেদের মতবাদ অন্যত্র ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। অর্থাৎ, অনেকে স্রেফ মজা পেতে এসব ফোরামে গেলেও কথাগুলো ঠিকই ছড়িয়ে যাচ্ছে।

ওদিকে ইউরোপে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা কল্পিত ইসলামি আক্রমণ নিয়ে চিন্তিত। বিশেষ করে, নাইন ইলেভেন ও বৈশ্বিক জিহাদবাদের উত্থানের পর এই মনোভাব সেখানে বেড়েছে। ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ শীর্ষক বইয়ে রেনড ক্যামুস দাবি করেন, ফ্রান্সে প্রকৃত ফরাসিদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে এখন আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীরা, যাদেরকে উৎসাহিত করেছে ‘প্রতিস্থাপনবাদী’ অভিজাতরা। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরাও ‘হানাদার জাতে’র তালিকায় মুসলমানদের অন্তর্ভূক্ত করেছে, তবে তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু লাতিনো, কৃষ্ণাঙ্গ ও ইহুদীরা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচকরা অভিযোগ করেন, তিনি নিজেই একজন শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী। এ নিয়ে সরাসরি প্রমাণ নেই। তবে তার কিছু কিছু বাক্য শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শের সঙ্গে মিলে যায়। যেমন, ২০১৭ সালে তিনি ভার্জিনিয়ার শার্লোৎসভিলে ‘ইউনাইট দ্য রাইট’ নামে একটি সভায় অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে বলেন, ‘এই মানুষগুলো খুব নীরবে রবার্ট ই লি’র (কনফেডারেট সরকারের জেনারেল) ভাস্কর্র্য অপসারণের প্রতিবাদ করছিল।’ প্রকৃতপক্ষে, এই সভায় শামিল হওয়া লোকজন নিজেদেরকেই নব্য নাৎসি হিসেবে দাবি করে। তারা ‘জিউইশ উইল নট রিপ্লেস আস’ (ইহুদীরা আমাদের হটাতে পারবে না) সহ বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী শ্লোগান দিচ্ছিল।

গত বছর এই দক্ষিণপন্থী চরমপন্থীরা আমেরিকায় যত মানুষকে হত্যা করেছে, তা ১৯৯৫ সালের পর সর্বোচ্চ (ওই বছরই অকলাহোমা সিটি বোমা হামলা হয়েছিল)। এই হত্যাকারীদের সিংহভাগই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী। সুতরাং, এটি স্পষ্ট যে, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের হুমকি পশ্চিমা দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ বেশ হালকাভাবেই নিয়েছে।

(সূত্র দ্য ইকোনমিস্ট)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status