বাংলারজমিন

ফুলে-ফলে পল্লবিত নাগলিঙ্গম

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে

১৮ আগস্ট ২০১৯, রবিবার, ৮:১৭ পূর্বাহ্ন

 নাগলিঙ্গম। দুর্লভ একটি বৃক্ষ। কিশোরগঞ্জ শহরের পূর্ব প্রান্তে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে চারটি বিরল প্রজাতির নাগলিঙ্গম গাছ। এসব গাছ এখন ফুলে-ফলে পল্লবিত। ফলের চেহারা রং মোটেই বাহারি কিছু নয়। কিন্তু ফুলগুলো বেশ আকর্ষণীয়, দৃষ্টিনন্দন। অদ্ভুত সুন্দর এ ফুলের পরাগচক্র দেখতে অনেকটা সাপের ফণার মতো। হয়তো এই কারণেই এ ফুলের নাম নাগলিঙ্গম। অন্যদিকে শিশুদের ফুটবলের মতো আকারের ফলগুলো খয়েরি রঙের। এসব ফল খাদ্যবস্তু না হওয়ায় গাছ থেকে পড়ে পড়ে মাটিতেই পচে যায়। তবে এ গাছের বিশেষত্ব হচ্ছে, গাছে একই সময়ে ফল এবং ফুল শোভা পায়। এ ছাড়া সারা বছরই গাছে ফুল এবং ফল দেখতে পাওয়া যায়। এই নাগলিঙ্গমের ফুলগুলো এতই সুন্দর, সবার দৃষ্টি কাড়ে। কথিত আছে, নাগলিঙ্গম গাছের ফুল ও ফল একান্তই নাগ-নাগিনীর সম্পদ। যদিও বাস্তবে এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
নাগলিঙ্গম গাছে সাঁটানো তথ্য থেকে জানা যায়, সত্তরের দশকে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের বৃক্ষপ্রেমী প্রধান শিক্ষক প্রয়াত মতিউর রহমানকে তার এক ছাত্র বিদেশ থেকে নাগলিঙ্গমের চারা এনে দিয়েছিলেন। প্রধান শিক্ষক মাঠের পূর্ব প্রান্তে চারা রোপণ করলে সেই গাছের ফল থেকে এখন চারটি গাছ হয়েছে। দীর্ঘ বৃক্ষ। বিশাল বা সুউচ্চ নাগলিঙ্গম গাছের কাণ্ড বেশ মোটা। উচ্চতায় গাছটি প্রায় ৮০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ছাতিম গাছের মতো পাতা। এর গুচ্ছ পাতাগুলো লম্বায় সাধারণত ৫-৭ ইঞ্চি লম্বা এবং ৪-৫ ইঞ্চি চওড়া। পাতার রং গাঢ় সবুজ। বছরের প্রায় সব ঋতুতেই এই গাছের পাতা ঝরে যায় এবং পরে নতুন করে গজায়।
বৃক্ষটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শাখার বদলে নাগলিঙ্গম ফুল ফোটে গাছের গুঁড়িতে। গুঁড়ি ফুঁড়ে বের হয় ছড়া। তারপর ফুল। ফুল উজ্জ্বল গোলাপি, পাপড়ি ছয়টি, পাপড়ি গোলাকার কুল্লি পাকানো। পাপড়ি, রেণু, ফুলের গঠন নাগলিঙ্গমকে করেছে আরো মোহনীয়। প্রস্ফুটিত ফুলের পরাগ কেশর অবিকল সাপের ফণার মতো। অনিন্দ্যসুন্দর নাগলিঙ্গম। বিরল প্রজাতির এই ফুল বেশির ভাগ মানুষের কাছে অপরিচিত।
দৃষ্টিনন্দন নাগলিঙ্গম ফুলটি ফোটে মার্চ থেকে ডিসেম্বরে। নাগলিঙ্গমের ফুল গাঢ় গোলাপি আর হালকা হলুদ রঙের মিশ্রণে এককথায় অসাধারণ। কি দিন, কি রাত যখনই গাছতলায় যান না কেন, এর গন্ধে মন মেতে উঠবে। নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে গোলাপ আর পদ্মের সংমিশ্রণ। কী এক মাদকতায় নাগলিঙ্গমের সৌরভ বহুদূর থেকে টানে। গ্রীষ্মে ফুল ধরা শুরু হয়। বসন্তের শেষ থেকে অনেকদিন ধরে ফুটে থাকে শরৎকাল অবধি। ফুলগুলো তিন মিটার দীর্ঘ মঞ্জুরিতে ফুটে থাকে। ফুলের এই বিচিত্র গড়ন আমাদের দেশে বিরল। এর পরাগায়ণও ব্যতিক্রমধর্মী। মূলত মৌমাছি পরাগায়ণে বাহক হিসেবে কাজ করে।
নাগলিঙ্গম গাছে অনেকটা বেলের মতো দেখতে ফল হয়। এই ফল গাছের কাণ্ডের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। গাঢ় রঙের বড় বড় পাতার সমাবেশ যেন গাছের উপরিভাগে। গাছের বাকল বাদামি, ধূসর ও মসৃণ।
নানা তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা গেছে, নাগলিঙ্গমের বৈজ্ঞানিক নাম ‘ক্যুরুপিটা গুইয়ানেন্সিস’ (ঈড়ঁৎড়ঁঢ়রঃধ এঁরধহবহংরং)। এ গাছের এন্টিসেপটিক, এন্টিবায়োটিক ও এন্টিফাঙ্গাল ওষুধি গুণ রয়েছে। গাছের ছাল ও পাতার নির্যাস চর্মরোগ এবং ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শিবপূজায় নাগলিঙ্গমের ফুল অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছেও নাগলিঙ্গম অতি পূজনীয়। এ কারণে থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারের বৌদ্ধ মন্দির প্রাঙ্গণে নাগলিঙ্গম গাছ বেশি দেখা যায়। রূপে-গুণে ভরপুর এই গাছের সংখ্যা এখন পৃথিবীতে খুবই কম। সমস্ত পৃথিবীতে এই উদ্ভিদটি বিলুপ্তির পথে। আমাদের বাংলাদেশে হাতেগোনা যে কয়েকটি নাগলিঙ্গম গাছ টিকে আছে এর মধ্যে সংখ্যায় সম্ভবত কিশোরগঞ্জের আজিমউদ্দিন স্কুল মাঠেই সর্বোচ্চ ৪টি নাগলিঙ্গম গাছ রয়েছে। আজিমউদ্দিন স্কুলের পাশের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান রেণু জানান, নাগলিঙ্গমের ফলগুলো খাবার যোগ্য কিনা পরীক্ষা করার জন্য একজন একবার সেই ফলে কামড় দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে মুখমণ্ডল ফুলে বিকৃত হয়ে যায়। তিনি আরো জানান, পত্রিকায় নাগলিঙ্গমের গুণাগুণের খবর পড়ে একবার এক ব্যক্তি গাছের পাতা দিয়ে দাঁত মাজেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। অর্থাৎ, গাছের রস বিষাক্ত বলে তাদের মনে হয়েছে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, নাগলিঙ্গমের আদিনিবাস দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ অঞ্চলে। নাগলিঙ্গম আমাদের দেশে বেশ দুর্লভ। পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে গাছটি কবে, কেমন করে এ অঞ্চলে এসেছিল, ভারতবর্ষের কোথায় তার প্রথম জন্ম হলো, সেসব রহস্য তাদের কাছেও দুর্ভেদ্য রয়ে গেছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status