এক্সক্লুসিভ

ট্যানারিতে জিম্মি চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসা

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে

১৮ আগস্ট ২০১৯, রবিবার, ৮:১৬ পূর্বাহ্ন

চট্টগ্রামে বর্তমানে  কোনো ট্যানারি নেই। গত এক দশকে বন্ধ হয়ে গেছে সবক’টি ট্যানারি। এই সুযোগে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে ফেলেছেন ঢাকার ট্যানারি মালিকরা। যারা গত বছর চামড়া বিক্রির টাকা পর্যন্ত এখনো পরিশোধ করেনি।  
ফলে চামড়া বিক্রিতেও ভয় পাচ্ছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা। তাদের আশঙ্কা ট্যানারি মালিকদের কৌশলের কারণে এবারও বকেয়ায় চামড়া বিক্রি করতে হবে তাদের। তা যদি হয় তাহলে চট্টগ্রামের চামড়ার আড়তদাররা পুঁজি হারিয়ে ফতুর হয়ে যাবে। শাহ আলম নামে এক আড়তদার জানান, গত বছরের চামড়া বিক্রির টাকা বকেয়া থাকায় পুঁজির অভাবে এবার চট্টগ্রামের অর্ধশতাধিক আড়তদার চামড়া সংগ্রহ করতে পারেনি। অর্ধশত আড়তদার চামড়া সংগ্রহ করলেও তা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কারণ ঢাকার ট্যানারির মালিকরা চামড়া কেনার জন্য এখনো পর্যন্ত চট্টগ্রামের কোনো আড়তদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
জানা যায়, চট্টগ্রামে চামড়া শিল্পের শুরু ১৯৪৮ সালে। লাভজনক থাকায় কালুরঘাট শিল্প এলাকাকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে এখানে গড়ে ওঠে ১৬টি ট্যানারি। স্বাধীনতার পর গড়ে ওঠে আরো পাঁচটি। কিন্তু অনভিজ্ঞতা, পরিবেশ আইন না মানা, অব্যবস্থাপনা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট আর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ক্রমাগত বন্ধ হতে থাকে এসব ট্যানারি। ইটিপি না থাকায় কয়েক বছর ধরে বন্ধ আছে মদিনা ট্যানারি। চালু আছে সবেধন নীলমণি রিফ রেদার লিমিটেড। মদিনা ও রিফ লেদার ট্যানারি ছাড়া স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য ট্যানারিগুলো হলো- তিতাস, রওশন, কর্ণফুলী, মন্টি, জামান রহমান, এইচআরসি, ওরিয়েন্ট, মেঘনা, ডোরা, সিকো লেদার, জুবিলী ট্যানারি, খাজা, এশিয়া, মেট্রোপলিটন ও চিটাগাং ট্যানারি। চামড়ার তৈরি জুতা, জ্যাকেট, লংবুট আভিজাত্যের প্রতীক। এখন এসবের ব্যবহার কমে গেছে। ৯০-৯৫ শতাংশ মানুষ এখন সিনথেটিক জুতা ব্যবহার করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঠাণ্ডা কমে যাওয়ায় জ্যাকেট ও লংবুটের ব্যবহারও কমে গেছে। এর ফলে চামড়ার ব্যবহার কমে গেছে। চামড়া ব্যবসায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। চামড়ার ব্যবহার কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার ব্যবসায় মন্দাভাব। এদিকে ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এক জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীতে মাংস খাওয়া বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে চামড়ার সরবরাহ বেড়ে গেছে, কিন্তু ব্যবহার বাড়েনি। চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে চট্টগ্রামে ২০-৩০ হাজার লোক জড়িত। বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়। এ ছাড়া কোরবানির সময় বিক্রি হয় ৬ লাখ চামড়া। প্রতি বছর কোরবানি ঈদে তিন থেকে সাড়ে চার লাখ পিস গরুর চামড়া, এক থেকে এক লাখ ২০ হাজার পিস ছাগলের চামড়া, ১০-১৫ হাজার পিস মহিষের চামড়া ও ১০ হাজার পিস ভেড়ার চামড়া। সংগ্রহের পর এসব চামড়ার বাজারমূল্য ২০০-২৫০ কোটি টাকা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলে চামড়া শিল্পের প্রচুর কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ট্যানারি শিল্প না থাকায় ঢাকার ট্যানারি মালিকদের ওপর নির্ভর করতে হয় চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীদের। আড়তদাররা জানান, চট্টগ্রামে গত বছর কোরবানির ঈদে সংগ্রহ করা ৬ লাখ চামড়ার মধ্যে ৪ লাখ চামড়া চলে যায় ঢাকার ট্যানারিগুলোতে। এ ছাড়া ঢাকার ট্যানারি মালিকদের শর্ত মেনে অধিকাংশ চামড়াই বাকিতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা। ঢাকার ট্যানারিগুলো থেকে গত বছরের চামড়া বিক্রির টাকা এখনো না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীদের। কোরবানির দিন সাধারণত স্থানীয় উদ্যোক্তারা মাঠ থেকে চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। ব্যাপারী ও আড়তদারের হাতবদল হয়ে এসব চামড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে আসে। চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির অধীনে ১৭০ জন এবং এর বাইরে আরো ৫০-৬০ জন চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছেন। জানা যায়, প্রতিবছর কোরবানির ঈদে রিফ লেদার লিমিটেড ১৫-২০ শতাংশ প্রায় ৪০-৫০ হাজার পিস চামড়া ক্রয় করে থাকে। মদিনা ট্যানারি চালু থাকাকালীন তারা ২০ শতাংশ চামড়া ক্রয় করতো। বাকি চামড়াগুলো কোরবানির ১০-১৫ দিন পর ঢাকার ট্যানারি মালিকেরা কিনে নিয়ে যান।
চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছর ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বাকিতে বিক্রি করা অর্থের প্রায় ২০-২৫ কোটি টাকা এখনো অনাদায়ী রয়ে গেছে। চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, রিফ লেদার ও মদিনা ট্যানারির কাছে চামড়া বিক্রি করলে নগদ টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করলে টাকা বাকি থেকে যায়। টাকা পেতে পেতে আরেক কোরবানি এসে যায়। কয়েক বছর ধরে কোরবানি ঈদে লোকসান দিতে দিতে পুঁজি হারিয়েছি আমরা। কোরবানি ঈদে আমরা ধার করে টাকা নিয়ে ও বাকিতে চামড়া ক্রয় করে থাকি। ঢাকার ট্যানারি মালিকেরা নগদ টাকা দিয়ে দিলে আমরা উপকৃত হতে পারতাম। ধার করা টাকা শোধ করতে পারতাম। তিনি বলেন, অনভিজ্ঞতা ও লোকসান দিতে দিতে ২০টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের ট্যানারিগুলো থাকলে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা ঢাকামুখী হতো না। চামড়া শিল্পকে রক্ষা করতে হলে ট্যানারি মালিকদের মতো চামড়ার আতড়দারদেরকেও স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে।
চট্টগ্রামে একমাত্র রিফ লেদার লিমিটেডের ইটিপি আছে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ৬০-৭০ হাজার পিস চামড়া কিনেছিল। এ ছাড়া সারা বছরই প্রতিষ্ঠানটি চামড়া কিনে থাকে। এর ফলে এ বছর কোরবানির কী পরিমাণ চামড়া কিনবে তা নির্ধারণ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর রিফ লেদার কোরবানির চামড়া না কেনার সম্ভাবনাই বেশি। তাই চামড়ার আড়তদারেরা শঙ্কায় আছেন। রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড সেলস) মোকলেছুর রহমান বলেন, চামড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে জুতা, ব্যাগের ফ্যাক্টরি গড়ে তুলতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ছেড়ে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এমনকি মিয়ানমারের দিকে চলে যাচ্ছে। সরকার চাইলে পরিবর্তন সম্ভব। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে। পুরো চামড়া সেক্টরকে বাঁচাতে হলে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। চামড়ার মতো জাতীয় সমপদকে রক্ষা করতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status