দেশ বিদেশ

কাশ্মীরকে আরো গভীর সংকটে ঠেলে দিচ্ছেন মোদি!

বিবিসি বাংলা

১৭ আগস্ট ২০১৯, শনিবার, ৮:৪১ পূর্বাহ্ন

বিগত প্রায় সত্তর বছর ধরে যা চলে আসছিল, এক ঝটকায় ভারত-শাসিত কাশ্মীরের  সেই বিশেষ মর্যাদা ছিনিয়ে নিয়ে দিল্লির নরেন্দ্র মোদি সরকার যে বিরাট এক ফাটকা খেলেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই পদক্ষেপের পরিণাম যে কী হতে চলেছে, তা এখনো অনেকটাই অনুমান সাপেক্ষ।
কাশ্মীরের বেশির ভাগ মানুষ এই সিদ্ধান্তে যে প্রবল ক্ষুব্ধ তা আর  গোপন নেই, এবং এর ফলে উপত্যকায় সশস্ত্র বিক্ষোভ নতুন করে প্রসার পাবে কি-না সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। আবদুল্লাহ বা মুফতি পরিবারের মতো কাশ্মীরের ‘ভারতপন্থি’ রাজনীতিকদের কিংবা হুরিয়ত কনফারেন্সের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের প্রাসঙ্গিকতা কতটা বজায় থাকবে  সেটাও বেশ অস্পষ্ট। তবে সবচেয়ে বড় কথা- লাখ লাখ  ফৌজ মোতায়েন করে কাশ্মীরকে বাকি ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিশিয়ে দেয়ার যে উদ্যোগ দিল্লি নিয়েছে তা আদৌ সফল হবে কি-না, মূলত সেটাই এখন দেখার বিষয়। মোদি সরকারের নাটকীয় সিদ্ধান্ত কাশ্মীরে ঠিক কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে গত কয়েকদিনে শ্রীনগর, দিল্লি বা মুম্বইতে অনেকের সঙ্গেই কথা বলেন বিবিসি বাংলার সাংবাদিক শুভজ্যোতি ঘোষ।
 প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রির মাধ্যমে ভারত সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার ঠিক দু’দিনের মাথায় যখন সেই অবরুদ্ধ ভূখণ্ডে পা রাখলাম, কাশ্মীরি তরুণরা  যেভাবে প্রায় ছেঁকে ধরে তাদের  ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন সে দৃশ্য  ভোলার নয়। তারা নিশ্চিত ছিলেন, কারফিউ একবার উঠলেই কাশ্মীর গর্জে উঠবে- এবং দিল্লির এই পদক্ষেপ আসলে মুসলিমদের শাস্তি  দেয়ারই ছল। বাডগামের বাসিন্দা আশরাফ-মুদাসসররা বলছিলেন,  মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর  থেকেই কাশ্মীরের প্রতিটা জেলায় মুসলিমদের হেনস্থা করা হচ্ছে। গর্ভবতী মহিলারা পর্যন্ত হাসপাতালে যেতে পারছেন না। তল্লাশি-চৌকি আর ফৌজি ব্যারিকেডে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে। স্থানীয় যুবক বিলাল আহমেদ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে দ্বিধা করলেন না। তার ভাষায়, অমিত শাহ’র কথামতো কাশ্মীরের আশি শতাংশ মানুষের যদি এই সিদ্ধান্তে সমর্থন থাকে, তাহলে মাত্র আট মিনিটের জন্য তিনি কারফিউ তুলেই দেখুন না- কী হয়!
কাশ্মীরের জনপ্রিয় লোকগীতি ‘মাই চানি রাওয়াম রাত দো’ যেমনটা বলে, প্রিয় জন্মভূমির জন্য এই মুল্লুকের যুবকরা জীবনের বহু দিন, বহু রাত উৎসর্গ করেছেন। এখন ৩৭০ ধারা বিলোপের সর্বশেষ আঘাত কি তাদের আরো একবার অস্ত্র হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত করবে? কাশ্মীরের প্রবীণ শিক্ষাবিদ হামিদা নাঈম বানু তার হায়দারপোরার বাড়িতে বসে বিবিসিকে বলছিলেন, গত দু’তিন বছরে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মীরে হাজারের ওপর কিশোর-যুবককে খতম করেছে। আর এখন তারা কী নতুন বার্তা দিলো? এটা  তো বুঝতে হবে যে, এই দুর্বিষহ জীবনে হতাশ হয়েই কাশ্মীরিরা বন্দুক হাতে তুলে নিচ্ছে। তিন বছর আগে বিদ্রোহী নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর ক্ষোভে  ফেটে পড়েছিল কাশ্মীর। ‘নইলে  কেন শিক্ষিত, প্রতিভাবান তরুণরা এমনি এমনি নিজেদের জীবন শেষ করে দিতে যাবে?’ -প্রশ্ন অধ্যাপক বানুর। বছরতিনেক আগে বিদ্রোহী  নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যু যেভাবে কাশ্মীরি তরুণদের দলে দলে সশস্ত্র পথে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, এখন রাতারাতি ৩৭০ ধারা মুছে দেয়ার সিদ্ধান্তও একই ধরনের ট্রিগারের কাজ করবে বলে অনেকেই মনে করছেন। শ্রীনগরের রাজপুরায় গওহর বাট বলছিলেন, তরুণদের যদি সরকার পাশে চায় তাহলে তাদের স্বপ্নটা কী, তা তো বুঝতে হবে! তা না-করে আপনি দুম করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিলেন, এর লাভ-ক্ষতি কী হবে  সেটা তরুণদের বোঝানোর কোনো  চেষ্টাই করলেন না। তা ওরা তো ব্রিগেডে যাবেই।
কাশ্মীরি তরুণদের সশস্ত্র পথের দিকে ঝোঁকার আর একটা বড় কারণ হলো বহু বছর ধরে সেখানে যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠছে। বাদামিবাগ এলাকার ব্যবসায়ী ইরফান জাভিদ বলেন, এই ফারুক আবদুল্লার পরিবারকেই দেখুন না! যাদের ভরসায় গত সত্তর বছর ধরে দিল্লি এখানে রাজত্ব করলো, তাদেরকেও আজ প্রমাণ দিতে হচ্ছে তারা ভারতীয় কি-না। আবদুল্লাহ পরিবারের এই হাল হলে সাধারণ কাশ্মীরিদের কী অবস্থা বুঝতেই পারছেন।
মুম্বই আইআইটি’র সাবেক অধ্যাপক ও লেখক-গবেষক রাম পুনিয়ানি আবার মেহবুবা মুফতির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলছিলেন, একবার উগ্রপন্থিদের দিকে ঝুঁকে, একবার বিজেপির সঙ্গে গিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি নিজেই বিভ্রান্ত। কাশ্মীর প্রশ্নে তিনি সংলাপ  চেয়েছিলেন, কিন্তু নিশ্চিত করতে পারেননি সেটাও। অন্যদিকে মিরওয়াইজ ওমর ফারুক বা সৈয়দ আলি শাহ গিলানির মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত নেতাদের টানা গৃহবন্দি রেখে সরকার তাদের অনেকটাই নিষ্ক্রিয় করে দিতে  পেরেছে। দিল্লির নিরাপত্তা থিঙ্কট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্ত মনে করছেন এই পটভূমিতে এখন ভারত সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে কাশ্মীরে নতুন রাজনৈতিক  নেতৃত্বকে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। যেটা মনে হচ্ছে মেহবুবার দল পিডিপি’র সমর্থনে ভাটা পড়েছে। তবে ন্যাশনাল কনফারেন্স বহু পুরনো দল, তাদের এখনো জনভিত্তি রয়েছে। আর হুরিয়ত  নেতারাও বেশির ভাগই নিশ্চিহ্ন। এখন আমার ধারণা কেন্দ্র যেটা করতে চাইবে, নবীন প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের তুলে এনে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে কাশ্মীরে  কেন্দ্র-রাজ্য সমঝোতার মডেলে একটা আঞ্চলিক শক্তিকে গড়ে তুলতে চাইবে। নতুন পলিটিক্যাল ডিসপেনসেশান কাশ্মীরে আমরা বহুদিন দেখিনি, তার একটা স্পেস  বোধহয় ওখানে আছে। কিন্তু কাশ্মীরে দিল্লির সমর্থনপুষ্ট  কোনো নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হলেই কি বাকি ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের আত্মিক যোগাযোগ সম্ভব? কাশ্মীরের নবীন রাজনীতিবিদ ও জেএনইউ’র সাবেক ছাত্রনেত্রী শেহলা রশিদ কিন্তু মনে করেন, ‘এই তথাকথিত ইন্টিগ্রেশনের তত্ত্বটা একেবারে অবাস্তব। তার প্রশ্ন, যেখানে অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের ভ্যালি  থেকে এয়ারলিফট করে কিংবা ভারতীয় পর্যটকদের বিদেশিদের ডিপোর্ট করার মতো করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করতে হয়,  সেখানে কীভাবে ইন্টিগ্রেশন সম্ভব? আমি তো বলবো মোদিজী স্রেফ  লোকের চোখে ধুলো দিচ্ছেন!
কিন্তু কাশ্মীরে মোদি সরকারের তেমন কোনো পরিকল্পনা কি আদৌ আছে?
এখানে শ্রীরাধা দত্ত ভরসা রাখতে চান বিপুল লগ্নি আর উন্নয়নের ন্যারেটিভে। তিনি বলছিলেন, আমরা সব সময় কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ বলি, এত সুন্দর জায়গা- অথচ  সেখানে প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন কিন্তু তেমন হয়নি কখনওই। শিক্ষা-শিল্পসহ নানা খাতে বাকি ভারতে যে ধরনের বিনিয়োগ হয়েছে, কাশ্মীরে সেটা কোথায়? দিল্লি-চেন্নাই-ব্যাঙ্গালোরে তরুণরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, সেই একই ধরনের অ্যাকসেস যদি আমরা কাশ্মীরকেও দিতে পারি তাহলে সেখানেও আমরা ইতিবাচক সাড়া পেতে পারি বলেই আমার বিশ্বাস।
দিল্লির জেএনইউতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সঞ্জয় ভরদ্বাজও বলছিলেন, প্রায় দু’দশক আগে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী কাশ্মীরের মন জেতার জন্য বলেছিলেন জমহুরিয়ত, কাশ্মীরিয়ত আর ইনসানিয়তের কথা- যার অর্থ হলো যথাক্রমে গুড গভর্ন্যান্স বা সুশাসন, কাশ্মীরি জাতিসত্তা আর মানবিকতা। প্রফেসর ভরদ্বাজের বক্তব্য, অন্য সব মডেল তো সত্তর বছর সময় পেল, এখন এটাকেও একটু সময় দিয়ে দেখাই যাক না- কাশ্মীরের মানুষ তা গ্রহণ করেন কি না!
কাশ্মীরের একটা খুব পুরনো গান ‘হুক্কুস বুক্কুস’ এখন পুরো ভারত শুনছে। বলিউড ফিল্মে যেমন ব্যবহার হচ্ছে, তেমনি গাইছেন কাশ্মীরি পণ্ডিত সমাজের সঙ্গীতশিল্পী আভা হানজুরা, যিনি থাকেন ব্যাঙ্গালোরে। মিলিট্যান্সি আর মিলিটারির হাতে বুলেটবিধ্বস্ত কাশ্মীরের যে অন্য একটা চেহারাও আছে, তার সঙ্গে বাকি ভারতের পরিচয় করিয়ে দেয়ার নানা ধরনের  চেষ্টা চলছে। ইতিহাসবিদ মহুয়া সরকারের কথায়, কাশ্মীরের মধ্যে চিরকালই কিন্তু একটা প্লুরালিজম ছিল, এবং সেটা এখনো আছে।
সমস্যা হলো, ৩৭০ ধারা বিলোপের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের ওপর আচমকাই চাপিয়ে  দেয়া হয়েছে, ভারতে সেখানে কাশ্মীরের মতামত নেয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। কাশ্মীরের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ প্রাণপণে তা রুখতে চাইছেন, ফলে সেই সংঘাতের পরিণতি উপত্যকায় শান্তি ও সমৃদ্ধি ডেকে আনবে তা এখন বিশ্বাস করা রীতিমতো অসম্ভবই মনে হচ্ছে!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status