শেষের পাতা

আশুগঞ্জে আলোচনায় ৬%, টার্গেট ৩৮ কোটি টাকা

জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে

২৪ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ১০:০২ পূর্বাহ্ন

ছয় পার্সেন্ট। কোটিতে ছয় লাখ। মোট টাকার হিসাবে যার পরিমাণ প্রায় ৩৮ কোটি টাকা। ঘুষের টাকার এই অঙ্ক আশুগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে। অধিগ্রহণকৃত জমি-স্থাপনার টাকা পেতে আগাম দিতে হচ্ছে এই টাকা । দালালচক্র এই টাকা সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছে জায়গামতো। এদিকে ভূমির নানা জটিলতা সামনে এনে নির্ধারিত পার্সেন্টেজের বাইরে আরো বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। আশুগঞ্জ নৌ-বন্দর অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণে চর-চারতলা মৌজার মহরমপাড়া এলাকার ২৫ একর ৬০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। জমি, অবকাঠামো, গাছপালা ও ব্যবসায়িক ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি সবকিছুর মোট মূল্য নির্ধারণ হয়েছে ৬২৬ কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা
। জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা সূত্রে জানা যায়- মোট বরাদ্দে অধিগ্রহণকৃত ২৫ একর ২৬ শতাংশ জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৮ কোটি ৭৫ লাখ ৭৩ হাজার ৬১৭ টাকা। বাজার মূল্যের তিনগুণ (২০০ শতাংশ) বেশি ক্ষতিপূরণে এই জমির দাম দাঁড়িয়েছে ৩৭৭ কোটি ৫১ লাখ ৪৭ হাজার ২৩৪ টাকা। তেমনি অবকাঠামো ও গাছপালার মূল্য ২৮ কোটি ৬৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮৪ টাকার ২০০ শতাংশ বৃদ্ধিতে হয়েছে ৩০ কোটি ৩৫ লাখ ২৯ হাজার ৬২৮ টাকা। এ ছাড়া ২ শতাংশ আনুষঙ্গিক খরচ খাতে ধরা হয়েছে ১২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। অধিগ্রহণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মোট ৫৬৯ জন পাবেন এই টাকা। বরাদ্দকৃত ক্ষতিপূরণের চেক জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে দেয়া হচ্ছে। এর আগে ২৪শে জুন জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান অধিগ্রহণকৃত জমি এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ১২ জনের মধ্যে ৩৫ কোটি টাকার চেক বিতরণ করেন। তবে টাকা পেতে টাকা দিতে হচ্ছে- এমন আওয়াজ রয়েছে আশুগঞ্জে। ক্ষতিগ্রস্তকে তার নামে যত টাকার চেক হয়েছে এর ছয় পার্সেন্ট আগাম দিয়ে দিতে হচ্ছে। কারা এই টাকা নিচ্ছেন, কারা অধিগ্রহণকৃত জায়গা-জমির জটিলতা নিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ অফিসে গিয়ে দেনদরবার করছেন তাদের নামও রয়েছে সেখানকার মানুষের মুখে মুখে। এদেরকে (দালাল) ধরেই টাকার চেক আনতে হয় বলে জানান অনেকে। ভূমি অধিগ্রহণ শাখার একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে রয়েছে তাদের গভীর যোগাযোগ। আশুগঞ্জ পশ্চিম বাজারের মধ্যগলির একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিকল্প ভূমি অধিগ্রহণ অফিস হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকরা সেখানে এসে আলাপ-আলোচনা ও রফাদফা করেন।

সরজমিন অনুসন্ধানে বুঝা গেছে, পথের কিনারের দোকানি থেকে শুরু করে সব মানুষেরই জানা আছে অধিগ্রহণের টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে গোপন লেনদেনের বিষয়টি। কিন্তু মুখ খুলেন না কেউ। আশুগঞ্জ গোলচক্করের কাছে এক চটপটি ব্যবসায়ীর দোকানে খানিক দাঁড়াতেই কানে আসে এ নিয়ে দু-জনের আলাপচারিতা। কোটিতে ৬ লাখ টাকা প্রদান করার কথা জানাচ্ছিলেন একজন আরেকজনকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আশুগঞ্জ বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান- তার এক আত্মীয় জানিয়েছেন ক্ষতিপূরণের যে টাকা তিনি পাবেন তার জন্য তাকে দিতে হবে ২ কোটি টাকা। তবে এনিয়ে ক্ষোভ আছে ক্ষতিগ্রস্তদের। এদিকে ভূমি নিয়ে জটিলতা বা আদালতে মামলা মোকদ্দমা রেখেই ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেয়ার চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ শাখার একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশে দালালরা এই কাজে লিপ্ত। জানা গেছে- অধিগ্রহণকৃত জমির মধ্যে চর-চারতলা মৌজার বিএস ৯ দাগের ভূমি নিয়ে আদালতে এলএসটি মামলা নং ৩০৬/২০১৩ চলমান রয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের কাছে জমির মালিক এক আবেদনে বলেন- আদালতে মামলা থাকা অবস্থাতেই দালাল চক্রের মাধ্যমে ওই দাগের ভূমির ক্ষতিপূরণ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে জমির মালিক নয় এমন লোকজন। একই মৌজার বিএস ২৪, ২৫, ৩৫, ২৬, ২৭, ৩০ ও ৭২ দাগের ভূমি নিয়েও দেওয়ানি মামলা চলমান। এক্ষেত্রেও ২.০৯ একর জমির ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য একইচক্র তৎপর।

এসএ ৭২১-নং ক্ষতিয়ানভুক্ত ভূমির মালিক আয়জের নেছার ওয়ারিশ নোয়াব মিয়া, রেহানা হক, বাদল মিয়া ও গুলজাহান জানান, তাদের জায়গা শামসু ও ফজলু দখল করে রেখেছে। তারা দাবি করে জায়গা কিনে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের কোনো ওয়ারিশ জায়গা বিক্রি করেনি। তারা আরো জানান- জায়গার মালিকানা যে তাদের এই দাবি করে ২০১৮ সালের ২০শে নভেম্বর জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেছিলেন। তাদের ওই আবেদন ফাইল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর আরো কয়েকবার সেখান থেকে তাদের কাগজপত্র উধাও হয়েছে। অফিসে গেলে বলা হয় কাগজ হারিয়ে গেছে। আমাদেরকে উদ্দেশ্যমূলক ওই জায়গার ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করার জন্য এটা করা হয়। কানুনগো মিজানুর রহমান এবং জাকির ও হেলাল এই চেষ্টায় লিপ্ত বলে অভিযোগ তাদের। সরজমিনে মহরমপাড়া গেলে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভূমির মালিক জানান- কাজী মহিউদ্দিন মোল্লার মাধ্যমেই সবকিছু করছেন তিনি। ডিসি অফিসের নাজমুল সার্ভেয়ারের সঙ্গেও তার মাধ্যমে দেখা করে এসেছেন। এখন চেক হওয়ার খবর পেলেই যাবেন।

জমি অধিগ্রহণের শুরু থেকেই জাকির হোসেন, মহিউদ্দিন মোল্লা, জামাল ও ইকবাল সিকদারের নাম আলোচিত হয়ে ওঠে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে। আর ওদিকে অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মিজানুর রহমান, সার্ভেয়ার নাজমুলের নাম। এ-দুজনই তদবির করে এসেছেন জেলা প্রশাসনের এই শাখায়। কানুনগো মিজানুর রহমান টাকা পয়সা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও আশুগঞ্জের ওই সব লোকজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকার কথা স্বীকার করেন। মহিউদ্দিন মোল্লা বলেন- কানুনগো পুরো মাঠ গুছিয়েছেন। একবার-দু’বার নয়, তিনি ৫০ বার এসেছেন। আমার জন্য কাজ করবে তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে না। জামাল বলেন- তার নিজের ছাড়াও খালু ও শ্বশুরের জায়গা অধিগ্রহণ হয়েছে। সেকারণে ডিসি অফিসে যাওয়া আসার কারণে তার নামটা বেশি শোনা যায়। আশুগঞ্জ বাজারে জাকির হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একাধিকবার গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে ফোন করলে সাক্ষাতে কথা বলবেন বলে জানান।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তাজিনা সারোয়ার বলেন- ছয় শতাংশ টাকা নেয়া হচ্ছে এমনটা আমার জানা নেই। কেন এমন কথা উঠলো এটি খতিয়ে দেখবো। তবে আমি এটুকু বলতে পারি এর সঙ্গে অফিসার লেবেলের কেউ সম্পৃক্ত নন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status