বিশ্বজমিন

হিউম্যানস অব আসাম- পর্ব ১

মানবজমিন ডেস্ক

২১ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ন

জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রক্রিয়ার কথা শুনে বেশ খুশিই হয়েছিলেন আব্দুল জুব্বা। ভেবেছিলেন এই নিবন্ধনের মাধ্যমে নিজের নামের সাথে থাকা ‘অভিবাসী’ তকমা মুছে ফেলতে পারবেন। তার মতো বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে অবৈধ অভিবাসী হিসেবেই দেখে আসছে আসামের সবাই। সারাজীবন তাকে এ অভিযোগ সহ্য করে যেতে হয়েছে। কিন্তু তিনি জানতেন না, এই এনআরসি তার পরিচয় নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলবে, তাকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করবে।

১৯৫১ সালের পর এই প্রথম ভারতে এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য, ভারতকে অবৈধ অভিবাসী মুক্ত করা। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে শরণার্থী হিসেবে হিসেবে ভারতে অভিবাসন করেছিলেন তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেখা হচ্ছে। ওইসব অভিবাসীদের বিতাড়িত করাটা এই এনআরসি প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্যগুলোর একটি।

আসামের বাংলাভাষীদের প্রায় আজীবনই সন্দেহের চোখে দেখা হয়। যদিও তাদের অনেকেই গত কয়েক দশক ধরে সেখানে বাস করছেন। জুব্বা বলেন, সারাজীবন এখানকার সবাই আমাদের বাংলাদেশী নামে ডেকে এসেছে। মনে হয় এটা গলায় বিধে থাকা কোনো কাটা, সবসময় যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে।

৩৩ বছর বয়সী জুবা আসামের দারাং জেলার বিলপারের বাসিন্দা। গৃহস্থ পরিবারের এই সদস্য এনআরসি শুরু হওয়ার খবরে বেজায় খুশি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এবার এতদিন ধরে না পাওয়া সম্মান অর্জন করতে যাচ্ছেন তিনি। কেননা, তার পূর্বপুরুষরা যে ১৯৭১ সালের আগেই আসামি গিয়েছিল। তার কাছে সে বিষয়ক সকল নথিপত্র রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ভেবেছিলাম এনআরসি’র মাধ্যমে আমাদের পরিচয় থেকে বাংলাদেশী তকমা অবশেষে মুছতে যাছে।
তবে জুব্বার আশানুযায়ী ঘটেনি কোনকিছুই।  ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাস হওয়া এনআরসি’র খসড়া তালিকায় নাম ওঠলেও গত মাসে তাকে বলা হয়, তার নথিপত্রে ভুল রয়েছে। ২৬ জুন তালিকা থেকে নতুন করে বাদ দেয়া ১ লাখ ২ হাজার মানুষের নামের সাথে জুড়ে যায় তার নামও।

জুব্বাকে বলা হয়, তার পূর্বপুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়। তার দাদাই ছিলেন আসামে অভিবাসন করা প্রথম ব্যক্তি। ১৯৭১ সালের আগেই সেখানে যান তিনি। ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় তার নাম রয়েছে। তবে এনআসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দাদার সঙ্গে জুব্বার সম্পর্ক বিশ্বাসযোগ্য নয়। নিজের দাদার সঙ্গে সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে তিনি তার স্কুলের পরীক্ষার প্রবেশপত্র ও তার দাদার নির্বাচনি পরিচয়পত্রও জমা দেন। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি।

২০১৮ সালের খসড়া তালিকায় জুব্বার নাম ওঠার মানে হচ্ছে, তখনই তার জমা দেয়া সকল নথিপত্রের সত্যতা যাচাই করেছিল এনআরসি কর্তৃপক্ষ। কেবল যাচাই নয়, সেগুলো যথাযথ হিসেবে বিবেচনাও করেছিল তারা। তাহলে আচমকা পূর্বপুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের প্রমাণ অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেল কিভাবে?

২০১৮ সালের খসড়া তালিকায় জুব্বার নাম ওঠলেও তার পরিবারের অন্যান্য অনেকের নামই ওঠেনি। তারা নিজেদের নাগরিকত্বের দাবি জানিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলে তার ভিত্তিতে শুনানি শুরু হয়। তাদের পক্ষে এনাআরসি কর্তৃপক্ষের শুনানিতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন জুব্বা। এরকম এক শুনানিতে এনআরসির কোনো এক কর্তৃপক্ষ হয়তো কোনো অসামঞ্জস্যতা দেখেছিলেন জুব্বার নথিপত্রে। ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি নিজেকে যে ব্যক্তি হিসেবে দাবি করেন, আদতে সে ব্যক্তি নন।
কিন্তু জুব্বা দৃঢ়ভাবে দাবি করেন, কোনো কর্মকর্তাই তাকে কোনরকমের অসামঞ্জস্যতার ব্যাপারে কিছু বলেনি। নিজের পরিচয় প্রমাণের জন্য তাকে কোনো অতিরিক্ত নথিপত্র জমা দিতেও বলেনি। তিনি জানান, তাকে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার আগে তার কাছ থেকে কিছু জানতে চাওয়া হয়নি। এটা একটি নিয়মবহির্ভ’ত সিদ্ধান্ত ছিল।

এই ঘটনার পর এনআরসির প্রতি তার মনোভাব বেশ তিক্ত হয়ে গেছে।  জুব্বা বলেন, ধীরে ধীরে আমার মনে হচ্ছে, এটা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করার একটি ষড়যন্ত্র। এখন সবকিছুতেই উত্তেজনা জড়িয়ে রয়েছে।
নিজের নাগরিকত্বের দাবি নিয়ে ফের নতুন অভিযোগ দায়ের করেছেন জুব্বা। এনাআরসির চ’ড়ান্ত তালিকায় যোগ হওয়ার ইচ্ছা রয়েছে তার। এইবার কোনো ফাঁক-ফোকর রাখবেন না তিনি। তিনি বলেন, এবার আমি আমার প্যান কার্ড, পাসপোর্ট ও ভোটার পরিচয়পত্রও জমা দেবো।

চূড়ান্ত তালিকায় তার নাম ওঠেছে কিনা তা জুব্বা ৩১ জুলাইয়ের দিনই জানতে পারবেন। এর আগ পর্যন্ত তাকে বাঁচতে হবে একজন বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয় নিয়ে। যদিও তিনি ভেবেছিলেন, এই মিথ্যা পরিচয়ের খোলস তিনি ঝেড়ে ফেলতে যাচ্ছেন।
(‘হিউম্যানস অব আসাম’ হচ্ছে আসামে নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে থাকা মানুষের গল্প নিয়ে লেখা ‘স্ক্রল ডট ইন’ এর কয়েকটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন। এটি এনআরসি প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের ‘দ্য ফাইনাল কাউন্ট’ নামের একটি প্রকল্পের অংশ।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status