এক্সক্লুসিভ

ধরাছোঁয়ার বাইরে আবজাল দম্পতি

মারুফ কিবরিয়া

১১ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৮:০৬ পূর্বাহ্ন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমকে খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির মাধ্যমে শতকোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একাধিক মামলা হওয়ার পরও এই দম্পতি ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছেন। তবে সম্প্রতি দুদকে হওয়া মামলার প্রেক্ষিতে তাদের খোঁজা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, আবজাল ও তার স্ত্রী কোথায় আছেন সেটা জানার চেষ্টা চলছে। মামলা হওয়ার আগেই পলাতক তারা। এখন দুদক তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার পদ থেকে গত ১৪ই জানুয়ারি সাময়িক বরখাস্ত করা হয় আবজালকে। তার স্ত্রী রুবিনা খানম ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার স্টেনোগ্রাফার। ২০০০ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, আবজাল বেতন-ভাতা পেতেন সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো। অথচ তাদের দুই জনের নামে শত শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। ঢাকার উত্তরায় এই দম্পতির পাঁচটি বাড়ি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি বাড়ি, দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট আছে। এর বাইরে দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। এই দম্পতির এত সম্পদ থাকার অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। গত ১০ই জানুয়ারি আবজালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। রুবিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৭ই জানুয়ারি হাজির হতে বলা হলে তিনি সময় চেয়ে আবেদন করেন। তারপর আর আবজালের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে, গত ৬ই জানুয়ারি ইমিগ্রেশনে চিঠি দিয়েও আবজাল দম্পতির বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এরপর ১৩ই মার্চ পুলিশের বিশেষ শাখায়ও চিঠি পাঠানো হয়। তবে গুঞ্জন রয়েছে, কোটি টাকা লেনদেনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই দুই দুর্নীতিবাজ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এ বিষয়ে অবশ্য দুদক কর্মকর্তারা আগেই বলেছেন, আবজাল ও তার স্ত্রী এমনকি তার পরিবারের কোনো সদস্য বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। তাদের তিনটি পাসপোর্ট এর তথ্য ইমিগ্রেশনে জমা দেয়া রয়েছে। এ অবস্থায় তাদের পালিয়ে দেশ ত্যাগ করার 
সুযোগ নেই। দুদক এও জানিয়েছে, আবজাল দেশেই আছেন তবে আত্মগোপনে। গত ২২শে জানুয়ারি দুদকের আবেদনে আবজাল-রুবিনার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক, অর্থাৎ, হস্তান্তর বা লেনদেন বন্ধ এবং ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন আদালত। আদালতের আদেশের পর তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ওই তথ্য প্রকাশিত হয়। তবে, গত ৭ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রুবিনা খানমের মালিকানাধীন রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল সচল ছিল। দুই সপ্তাহে ওই প্রতিষ্ঠানটিরসহ দম্পতির বিভিন্ন হিসাবে ৪৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়। সূত্র জানায়, আত্মগোপনে যাওয়ার আগে আবজাল দম্পতি থাকতেন উত্তরার তামান্না ভিলায়। আবজাল দম্পতি তামান্না ভিলা ছেড়ে যাওয়ার প্রায় দেড় মাস পর গত ১৮ই মার্চ বাড়ির মূল ফটকের পাশে একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এতে সম্পত্তির বিবরণ উল্লেখ করে বলা হয়, ‘ক্রোকাবদ্ধ উক্ত সম্পত্তি কোনোভাবে বা কোনো প্রকারে অন্যত্র হস্তান্তর, উক্ত সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনো প্রকার লেনদেন বা উক্ত সম্পত্তিকে কোনোভাবে দায়মুক্ত করা আইনত নিষিদ্ধ।’ ওইদিনও দুদক কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, আবজাল দম্পতি কোথায় আছেন, সেটা তাদের জানা নেই।
আবজাল দম্পতির বিরুদ্ধে যত মামলা
গত ২৬শে জুন দুর্নীতির মাধ্যমে ৩১০ কোটি ৮০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে এই দম্পতির বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা করে দুদক। সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে দুদকের ঢাকা জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১-এ মামলা দুটি দায়ের করেন। প্রথম মামলা আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমের বিরুদ্ধে। এতে ২৬৩ কোটি ৭৬ লাখ ৮১ হাজার টাকার মানি লন্ডারিংসহ ২৮৫ কোটি ২৭ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। ৫ কোটি ৯০ লাখ ২৮ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনসহ ৩১ কোটি ৫১ লাখ ২৩ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়।

আবজালের বিরুদ্ধে ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা মানি লন্ডারিং এবং ২ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনসহ ৪ কোটি ৭৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ আনা হয় মামলায়। মামলার এজাহারে বলা হয়, আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানম নিজ নামে ট্রেড লাইসেন্স খুলে তার স্বামীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কাজ টেন্ডারের নামে একচেটিয়া হাতিয়ে নেন। প্রারম্ভিক মূলধন ছাড়াই কথিত ব্যবসার আড়ালে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও সংশ্লিষ্ট মালামাল সরবরাহের নামে অনৈতিক প্রক্রিয়ায় আর্থিকভাবে লাভবান হতে তিনি নানা কৌশলের আশ্রয় নেন।

তিনি স্বামী আবজালের অবৈধ আয়কে বৈধ করার পূর্বপরিকল্পনায় নিজ নামে ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও রুপা ফ্যাশনের নামে তফসিলি ব্যাংকের ২৭টি হিসাবের মাধ্যমে ২৬৩ কোটি ৭৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা স্থানান্তর, হস্তান্তর ও মানি লন্ডারিং করেন, যা ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২(য) ধারায় বর্ণিত সন্দেহজনক অস্বাভাবিক লেনদেন হিসেবে অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে। এতে বলা হয়, তিনি বিভিন্ন তারিখে এই অপরাধলব্ধ টাকা ব্যাংকে জমা করেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ওই টাকা উত্তোলন করে তার অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ, গোপন বা ছদ্মাবরণে স্থানান্তর/হস্তান্তর বা রূপান্তরের মাধ্যমে পাচার করেন। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ তিনি ওই অর্থ পাচারের যড়যন্ত্রও করেন। এছাড়া রুবিনা খানম নিজ নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের যে হিসাব দুদকে দাখিল করেন, তাতে তিনি ৫ কোটি ৯০ লাখ ২৮ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেন। আর দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়, তিনি ৩১ কোটি ৫১ লাখ ২৩ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। এ কাজে তাকে সহায়তার জন্য স্বামী আবজাল হোসেনকেও সহযোগী আসামি করা হয়। অন্যদিকে, আবজালের বিরুদ্ধে ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা মানি লন্ডারিং এবং ২ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনসহ ৪ কোটি ৭৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ আনা হয় মামলায়।

এই দুই মামলার আগে গত ২৬শে এপ্রিল কক্সবাজার মেডিকেলে যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আবজাল দম্পতিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
এই মামলার অন্য ৮ আসামি হলেন- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর আবদুর রশীদ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ সুবাস চন্দ্র সাহা, সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল করিম, কলেজের হিসাবরক্ষক হুররমা আক্তার খুকী, কক্সবাজার জেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা সুকোমল বড়ুয়া, একই দপ্তরের সাবেক এসএএস সুপার সুরজিত রায় দাশ, পংকজ কুমার বৈদ্য এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক উচ্চমান সহকারী খায়রুল আলম।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status