বিশ্বজমিন

রোহিঙ্গাদের অবশ্যই নাগরিকত্ব দিতে হবে- জাতিসংঘের তদন্তকারী

মানবজমিন ডেস্ক

২৭ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৩:০১ পূর্বাহ্ন

রোহিঙ্গাদের অবশ্যই নাগরিকত্বের পথ করে দিতে হবে মিয়ানমারকে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি একদা যেমন বলেছিলেন, তাকে তেমন গণতান্ত্রিক হতে হবে। এ আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের অন্যতম তদন্তকারী রাধিকা কুমারাস্বামী। রাখাইনে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে যে নৃশংসতা চালানো হয় তার তদন্ত করে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন ওই তদন্ত শেষে বলে, সেখানে গণহত্যা চালানো হয়েছে। ওই মিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন রাধিকা। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, বুধবার রাধিকা বলেছেন, রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের শিকড় রয়েছে মিয়ানমারে। তাদেরকে অবশ্যই নাগরিকত্ব দিতে হবে মিয়ানমারকে। তিনি দ্য হেগে রাষ্ট্রহীন বিষয়ক এক বৈশ্বিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখছিলেন।
 
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করলেও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। ২০১৭ সালের আগস্টে তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নৃশংস দমনপীড়ন চালানোর পর কমপক্ষে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তদন্তকারীরা তদন্ত শেষে বলেছেন, গণহত্যার উদ্দেশে এসব নির্যাতন করা হয়েছে।

রাধিকা কুমারাস্বামী বলেছেন, ক্যারিয়ারে বিভিন্ন স্থানে বহু নৃশংসতা দেখেছি আমি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ধর্ষণ ও তাদেরকে জোর করে উৎখাতের ঘটনা আমার অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রহীনতাই হলো ভয়াবহ রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণ। এমন ভয়াবহতা তিনি দেখেছেন রোয়ান্ডা গণহত্যায়। মিয়ানমারে কিভাবে পলায়ণরত মানুষকে সেনাবাহিনী গুলি করেছে, কিভাবে নারীদের গণধর্ষণ করেছে, কিভাবে ঘরের ভিতর শিশুদের পর্যন্ত রেখে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তিনি সে সম্পর্কেও বলেছেন। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন এসব গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিচার করার আহ্বান জানিয়েছে। তবে জাতিসংঘের এ রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ উত্থাপন করছে।

বিশ্বে প্রায় এক থেকে দেড় কোটি রাষ্ট্রহীন মানুষ আছে। তাদেরকে কোনো দেশই নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। তার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গারাও। কখনো কখনো তাদেরকে ইংরেজিতে ‘লিগ্যাল ঘোস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এসব মানুষ শিক্ষা থেকে শুরু করে সব রকম মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। তারা বিপথগামী হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সহিংসতার মুখে রয়েছে। এমন কি খেয়ালখুশি মতো আটক করে তাদেরকে বন্দি রাখা হয়। এর মধ্যে সংখ্যার দিক দিয়ে রোহিঙ্গারা হলো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রহীন মানুষ। তাদের মধ্যে প্রায় দশ লাখ আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। এখনও মিয়ানমারে রয়েছে তাদের কয়েক হাজার। এ ছাড়া এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে তাদের বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
 
সম্মেলেন রাধিকা কুমারাস্বামী বলেন, একজন বয়স্ক শরণার্থীকে দেখে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। ওই শরণার্থী তাকে দেখিয়েছিলেন প্লাস্টিকের ময়লা একটি ব্যাগে কিছু কাগজপত্র। এর মধ্যে ছিল তার পূর্বপুরুষদের নাগরিকত্ব বিষয়ক ডকুমেন্ট। এগুলো তারা অর্জন করেছিলেন স্বাধীনতার সময়। ওই বৃদ্ধাকে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে তার নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। সেই ব্যাগে আছে এ সংক্রান্ত একটি কাগজ। আছে একটি কার্ড। তাকে এটা দেয়া হয়েছে। তাতে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে শুধু ‘বাঙালি মুসলিম’। রাধিকা বলেন, ওই নারী এই ব্যাগটিকে এমনভাবে তার কাছে রেখেছেন যেন এটাই তার জীবন। তিনি যখন পালিয়ে আসেন তখন তার স্বর্ণালঙ্কার সহ সবকিছু ফেলে এসেছেন। কিন্তু সঙ্গে এনেছেন এই ব্যাগ। ওই নারী তাকে বলেছেন, তিনি ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে এই ব্যাগটি রেখে ঘুমান।
 
রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যেতে চাপ প্রয়োগ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাধিকা। তিনি বলেছেন, একই সঙ্গে সহিংসতার জন্য যারা দায়ী তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তার ভাষায়, এসব মানুষকে মিয়ানমারে জোর করে ফেরত পাঠানো আগে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, সেখানকার পরিবেশ উপযুক্ত কিনা এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের পথ পরিষ্কার কিনা। তাদের গ্রামগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এমন কি একটি গাছ পর্যন্ত দ-ায়মান অবস্থায় নেই। তিনি বলেন, মিয়ানমারের ভিতরে এখন যারা আছে তাদেরকে রাখা হয়েছে বিভিন্ন শিবিরে। সেখানে তাদের চলাচলে রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। রয়েছে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সীমিত অধিকার। আর রয়েছে আকাশচুম্বী অপুষ্টির হার।

রাধিকা কুমারাস্বামী বলেন, তাদের মিশন প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণ সেপ্টেম্বরে নতুন একটি বিচারিক কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে, যাতে তারা মিয়ানমারের ওইসব জেনারেলের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। ২০১৭ সালের সহিংসতার পর পরই তদন্তকারীরা যখন শরণার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান তখন তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল ভীষণ হতাশা। কিন্তু গত মাসে যখন তদন্তকারী টিম আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল তখন রোহিঙ্গাদেরকে অধিক সংগঠিত দেখা গেছে। তারা কি চায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের হতাশার বিষয়টি অনেক বেশি পরিষ্কার। তারা চায় ন্যায়বিচার ও নাগরিকত্ব।

মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নেত্রী অং সান সুচি অব্যাহতভাবে দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করছেন। একে গুরুত্বর উদ্বেগের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন রাধিকা কুমারাস্বামী। তিনি বলেন, আমরা আশা করি তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে। তিনি এক সময় যেমনটা বলেছিলেন তেমন গণতান্ত্রিক হবেন। রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে পূর্ণাঙ্গ অধিকারের নিশ্চয়তা নিয়ে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status