প্রথম পাতা

ভূমধ্যসাগর ট্র্যাজেডির লোমহর্ষক বর্ণনা

‘প্রস্রাব খেয়ে গলা ভিজিয়েছি’

রোকনুজ্জামান পিয়াস

২৪ জুন ২০১৯, সোমবার, ৯:৫২ পূর্বাহ্ন

মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ভয় দেখিয়ে তোলা হয় ট্রলারে। ৩৫ জনের ট্রলারে ৭০ জনকে। এরপর ভাসিয়ে দেয়া হয় সাগরে। ট্রলারে কোনো দক্ষ মাঝি ছিল না। ছিল না খাবার পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। প্রতিকূল আবহাওয়ায় তাই একমাত্র ভরসা ছিল সৃষ্টিকর্তার করুণা। সামনে অনিশ্চিত সময় আর উত্তাল সাগরের মাঝে   ছোট্ট ট্রলারে গাদাগাদি করে থাকা মানুষের সামনে ইউরোপে স্বপ্নের যাত্রার সঙ্গে ছিল মৃত্যুর হাতছানি। এভাবেই পার হয়েছে দু’দিন। খাবার-দাবার, পানিও নিঃশেষ হয়ে যায় একেবারে। আরও একদিন কেটে যায় না খেয়ে। সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাপিয়ে কয়েক ফোঁটা পানির জন্য হাহাকার দেখা দেয় ট্রলারযাত্রীদের মধ্যে। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে কারও কারও। এই অবস্থায় নিজের প্রশ্রাবে গলা ভেজানোর আশায় শেষমেষ সেটাই পান করে কেউ কেউ। ২২ দিন সাগরে ভেসে ফিরে আসা মাদারীপুর সদর উপজেলার আপাসী গ্রামের মোখলেস মাতব্বরের ছেলে রাসেল মাতব্বর এভাবেই বর্ণনা করেন সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা। তার সঙ্গে আরও ৬৪ বাংলাদেশি একবুক স্বপ্ন নিয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নির্মম এই বাস্তবতার শিকার হন। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তার গলা ধরে আসে। বলেন, এ অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের চেয়ে ভয়াবহ। মনে হলে গা শিহরে ওঠে। এরই মধ্যে বেঁচে থাকার ক্ষীণ আলো দেখতে পায় হতভাগ্য এই ট্রলারযাত্রীরা। অদূরে দেখা মেলে মিশরীয় একটি জাহাজের। কিন্তু কাছে না ভিড়ে, উদ্ধার না করে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখে জাহাজটি। অবশেষে ড্রামের সঙ্গে নিজের শরীর বেঁধে কেউ কেউ ঝাঁপ দেয় সাগরে। উদ্দেশ্য, মিশরীয় জাহাজটির দৃষ্টি আকর্ষণ। অবশেষে সফল হয় তারা। এরপর আরও ১৮ দিন অনাহারে-অর্ধাহারে কাটে সেই জাহাজে। এই প্রতিবেদকের কাছে রাসেল মাতব্বর বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া এবং লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে সাগরে আটকে পড়ার সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন দীর্ঘসময়।

রাসেল জানান, ২০১৮ সালের ২২শে ডিসেম্বর তিনি লিবিয়া যান। যুদ্ধবিধস্ত দেশটিতে বাংলাদেশ তার কর্মী পাঠানো নিষিদ্ধ করায় দালালরা তাকে বিকল্প পথে পাঠায়। এজন্য ৫ লাখ টাকা নেয় দালালরা। সেই অভিজ্ঞতাও খুব সুখকর ছিলো না। মূলত: প্রতারণা করে দেশটিতে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে ৬ মাস অবস্থান করার পর লিবীয় এবং বাংলাদেশি দালালরা তাকে আড়াই লাখ টাকায় ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেয়। তার সঙ্গে ছিলো আরও অনেক বাংলাদেশি। একটি বড় জাহাজে করে ইতালি উপকূলে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো দালালরা।

রাসেল শুরু করেন এভাবে- দালালদের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ২২শে রমজান তারা ইতালির উদ্দেশ্যে জাহাজে ওঠার জন্য লিবিয়ার জোয়ারা থেকে রওনা দেন। তাদের মরুভূমির ভেতর দিয়ে ৫ কিলোমিটার হাঁটিয়ে একটি দ্বীপ এলাকায় নিয়ে যায় লিবীয় দালালরা। তাদের সঙ্গে ছিলো আরও ৫০ জন বাংলাদেশি।

এর মধ্যে রাসেলসহ ২১ জনকে একটি কক্ষে রাখে। ইফতারের সময় আবারও ডাক পড়ে তাদের। রাসেল বলেন, আমরা ইফতার ঠিকমতো করতেও পারিনি। এরইমধ্যে দালালরা এসে বলে এখনই রওনা দিতে হবে। ওই অবস্থায় আবারও ৫ কিলোমিটার হাঁটিয়ে আরেকটি দ্বীপে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে সাগরপাড়ে নিয়ে ট্রলারে উঠতে বলে। কিন্তু আমরা ট্রলারে যাবো না বলে জানিয়ে দিই। বলি, ট্রলারে নয়, জাহাজে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা আড়াই লাখ করে টাকা দিয়েছি।

রাসেল বলেন, এ কথা বলার পরই তারা পিস্তল বের করে আমাদের মাথায় ঠেকায়। বলে, ‘যদি ট্রলারে না উঠিস তো গুলি করে মেরে সাগরে ভাসিয়ে দেবো।’ পরে ভয় দেখিয়ে জোর-জবরদস্তি করে ৩৫ জন করে দুটি ট্রলারে মোট ৭০ জনকে তোলে। এদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিলো ৬৪ জন। পরে ওই অবস্থায় দুই ট্রলারে দু’জন করে মাঝিসহ আলাদাভাবে রওনা দেয়। সাগরে ভাসার ৬ ঘন্টা পর দুই ট্রলার আবারও একসঙ্গে হয়। তিনি বলেন, অন্য ট্রলার থেকে বাকি ৩৫ জনকেও আমাদের ট্রলারে তুলে দেয়া হয়। তাদেরকে ট্রলারের নিচের ডেকে রাখে। পরে চারজন মাঝি খালি ট্রলার নিয়ে ফিরে যায়। আমাদের ট্রলারে কোন মাঝি না থাকায় একজন মিশরীয় ব্যক্তি হাল ধরেন। এই ট্রলারের ওপরে ৩৫ জন আর নিচের ডেকে ৩৫ জন। সারাদিন আবহাওয়া অনুকূলে ছিলো। সাগরও শান্ত ছিলো। কিন্তু রাতে আবহাওয়া ভয়াবহ আকার ধারন করে। সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। ১০ থেকে ১২ ফুট উঁচু হয়ে ঢেউ ট্রলারের সঙ্গে আছড়ে পড়ে। এ সময় নিচের যাত্রীরা ওপরে ওঠে আসে। চিৎকার-চেচামেচি আর কান্নার রোল পড়ে যায়। রাসেল বলেন, তখন কারো কথা মনে হয়নি। শুধু আল্লাহর নাম নিয়েছি। বলেছি, এবার যদি বেঁচে যাই আর কখনো এমন ভুল করবো না। এভাবে রাত পার হয়েছে। পরদিন সকালেও একইরকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। এভাবে মৃত্যু আশঙ্কায় উত্তাল সাগরে দ্বিতীয় দিনও পার হয়। ট্রলারের তেলও শেষ হয়ে যায়। তৃতীয়দিন সকালে সাগর কিছুটা শান্ত হয়। ওইসময় একটি মিশরীয় জাহাজ আসে। তাদের কাছে কাকুতি-মিনতি জানাই উদ্ধারের জন্য। কিন্তু তারা উদ্ধার না করেই এবং তেল না দিয়ে চলে যায়।

তবে তারা আধাকিলোমিটার দূরে অবস্থান করে আমাদের ওপর দৃষ্টি রাখে। এর আগেই খাবার-দাবার ও খাবার পানি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করতে থাকি। কোন উপায় না পেয়ে নিজের প্রস্রাব নিজেই খেয়ে কোন রকম জান বাঁচাই। এরপর রাত আসে। কান্নাকাটি আর আহাজারি বাড়তেই থাকে। দূরে মিশরীয় জাহাজের বাতি দেখা যায়। এভাবে সেই রাতও পার হয়। পরদিন সকালে ১০-১২ জন নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। মনে হয়েছিলো- তারা মারা গেছে। পরে ধাক্কা দিয়ে দেখা যায়, বেঁচে আছে। এই অবস্থায় বাঁচার কোন আশাই আর ছিলো না। তখনও মিশরীয় জাহাজ সেখানে অবস্থান করছিলো। আমাদের ধারনা হয়েছিলো- ট্রলার ডুবে গেলে তারা আমাদের উদ্ধার করতে আসবে।

রাসেল বলেন, ৪র্থ দিন রশি দিয়ে ড্রামের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে সাগরে ঝাঁপ দিই। আমার সঙ্গে আরও ১০ থেকে ১২ জন এভাবে ঝাঁপ দেয়। উদ্দেশ্য মিশরীয় জাহাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এরই মধ্যে ড্রাম নিয়ে সাঁতরে তিনজন জাহাজে পৌঁছায়। তারা ওই তিনজনকে উদ্ধার করে। পরে তাদের কাছে দুর্ভোগের কথা শুনে ট্রলারযাত্রীদের উদ্ধার করে জাহাজে তোলে। ওই জাহাজে তাদের কাটে আরও ১৮দিন।  সেখানেও অনাহারে-অর্ধাহারে কেটেছে তাদের। তিনি জানান, মিশরীয় জাহাজের নাবিকরা তাদের ইতালিতে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু পরে তারা জানায়, ইতালি তাদের গ্রহণ করবে না। এই অবস্থায় তারা তিউনিশিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারাও ট্রলারযাত্রীদের নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে বাংলাদেশ সরকারের লোকজন যায়। রাসেল জানান, বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমাদের বুঝিয়ে দেশে ফেরার পাঠানোর ব্যবস্থা করে। পরে কিছুদিন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এর ক্যাম্পে রাখে। সেখান থেকেই শুক্রবার ১৭ জনকে দেশে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, কমকর্তারা জানিয়েছেন, পর্যায়ক্রমে বাকিদেরকেও দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।

রাসেল সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। আর কেউ যেনো দালালের প্রলোভনে পড়ে এমন পরিস্থিতির শিকার না হয়।  

সূত্র জানিয়েছে, রাসেলের সঙ্গে দেশে ফেরা আরও ১৬ জন হলেন, মাদারীপুরের মোহাম্মদ লাদেম মাতব্বর, রাজিব মাতবর, জুয়েল সিজাল, আজাদ রহমান, পিয়ার আলী (২৯), আকমন মাতব্বর (২০), মীর আজিজুল ইসলাম (৩৭), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবু বকর সিদ্দিক, শাহেজুল খাদু (২৫), ইদ্রিস জমাদ্দার (২৪), নিয়ামত শিকদার (১৮), নোয়াখালীর রফিকুল ইসলাম, চাঁদপুরের শফিকুল ইসলাম, শরিয়তপুরের রাকিব হোসেন, মৌলভীবাজারের জিল্লুর রহমান, সুনামগঞ্জের শিপন আহমেদ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status