দেশ বিদেশ

তিউনিশিয়া ফেরত ৮ যুবকের মুখে নির্মম বর্ণনা

তিনদিন না খেয়ে রক্তবমি করেছি

বিএম হায়দার আলী, শিবচর (মাদারীপুর) থেকে

২৪ জুন ২০১৯, সোমবার, ৯:৩৬ পূর্বাহ্ন

ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরে এলো মাদারীপুরের ৮ যুবক। জীবন নিয়ে ফিরে এলেও ঋণের বোঝা গ্রাস করে নিয়েছে তাদের। তিন সপ্তাহ ত্রিদেশীয় নদীতে ভেসে বেরানো বাংলাদেশের ১৭ জনের মধ্যে ৮ জনের বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। এরা হলেন- মাদারীপুর সদর উপজেলার মোস্তফাপুর এলাকার ঘটকচর গ্রামের লুৎফর মাতুব্বরের ছেলে লাদেন মাতুব্বর, মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আপসি গ্রামের মোকলেস মাতুব্বরের ছেলে রাসেল মাতুব্বর, মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আপসি গ্রামের মকবুল মাতুব্বরের ছেলে রাজিব মাতুব্বর, চরমুগুরিয়া এলাকার রাস্তি ইউনিয়নের হাজরাপুর গ্রামের হারুন বেপারির ছেলে আজাদ রহমান, মস্তফাপুর এলাকার লিয়াকত মাতুব্বরের ছেলে আকমান মাতুব্বর। এদের মধ্যে রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের দুর্গাবর্দি গ্রামের জিয়াউল হক সেজালের ছেলে জুয়েল সেজাল। রাজৈর উপজেলার একই গ্রামের গফুর মোল্লার ছেলে পিয়ার আলী। এই দু’জনের বাড়ি পাশাপাশি। অপর যুবক কালকিনী উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের পশ্চিম কুয়ালি গ্রামের মীর মতিউর রহমানের ছেলে মীর আজিজুল ইসলাম।
শনিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, তিউনিশিয়া ফেরত মাদারীপুরের ৮ যুবকের মধ্যে মাত্র ৫ জন গ্রামে এলেও বাকিরা অসুস্থতার কারণে ঢাকায় আত্মীয়র বাড়িতে অবস্থান করছে। আগত যুবকদের প্রায় প্রত্যেকেই ২০ থেকে ৫২ বছর বয়সী এবং এরা এলাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক। অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপাজর্নক্ষম ব্যক্তি। এদের বাবা-মা বৃদ্ধ তাই উপার্জনের তাগিদেই ঝুঁকি নিয়ে তারা লিবিয়া হয়ে ইতালি পারি জমাতে চেয়েছিলেন।
তাদের বাঁচার একমাত্র আশা সরকার যদি তাদের কোনো সাহায্য সহযোগিতা না করে দেশে এসেও পাওনাদারের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে হবে তাদের। তাই এলাকাবাসীসহ তাদের একটাই দাবি তাদের জন্য সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া এবং দালালদের যেন উপযুক্ত বিচার হয়।
তিউনিশিয়া ফেরত আজাদ রহমান জানান, লিবিয়া থেকে ইতালিতে পর্যন্ত বড় জাহাজের মাধ্যমে দালালরা প্রেরণ করার কথা বললেও আমাদের নিয়ে উঠায় ছোট নৌকায়। আমরা নৌকায় উঠতে রাজি না হলে আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দেয় দালালরা। তিন দিন না খেয়ে পথে আমরা রক্ত বমি করেছি। নৌকাডুবিতে শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরতে পেরে আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই।
তিউনিশিয়া ফেরত রাজৈর উপজেলার জুয়েল সেজাল জানান, প্রথমে ৫ লাখ টাকার চুক্তিতে আমাদের লিবিয়া নেয়া হয়। লিবিয়া নেয়ার পরে তিউনিশিয়ার সাগর পাড়ে বোটে উঠানোর সময় দালাল মাদারীপুরের রাসেল মিয়া, গোপালগঞ্জের বুলেট ও ফরিদপুরের মমিন আমাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায় এবং ভয়ভীতি দেখায়। লিবিয়া থেকে ইতালি নেয়ার উদ্দেশ্যে ছোট একটি বোটে উঠায়। ঐ বোটে ধারণক্ষমতা মাত্র ২০ জন কিন্তু লোক উঠায় ৭০ থেকে ৮০ জন। কিন্তু আমরা আপত্তি জানালে আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তাদের হাতে থাকা অস্ত্র আমাদের দিকে তাক করে তখন আমরা জীবন রক্ষা করতে ভয়ে বোটে ওঠি। তিন দফায় আমার প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। আর ওই দালালদের কাছে বাংলাদেশ থেকে লোক সংগ্রহ করে পাঠায় মাদারীপুরের আক্তার হোসেন।  
তিউনিশিয়া ফেরত রাজিব মাদবরের বাবা মকবুল মাদবর বলেন, জমি-জমা বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে ও সহায় সম্বল বিক্রি করে আমার ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম বিদেশ। নৌকাডুবিতে ছেলে নিখোঁজের খবর পেয়ে আমি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়েছে। দেশে কৃষিকাজ করে খাওয়াবো। তবুও এই অবৈধ পথে আর সন্তানকে বিদেশ পাঠাবো না। সহায়সম্বল বিক্রি করে প্রায় ১০ লাখ টাকা দালালদের হাতে তুলে দিয়েছি। আমি দালালদের বিচার চাই এবং আমার টাকা ফেরত চাই। দালালরা আমার টাকা পরিশোধ না করলে আমি আইনের আশ্রয় নেব।
মাদারীপুর সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন জানান, শুনেছি ১৭ বাংলাদেশির মধ্যে ৮ জনই মাদারীপুরের এবং দালাল চক্রের বেশির ভাগ সদস্যই মাদারীপুরের বাসিন্দা। ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, তিউনিশিয়া সাগরে ট্রলার ডুবির ঘটনায় নিখোঁজদের মধ্যে ৮ জনের ফিরে আসার খবর পেয়েছি। তারা যদি কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয় তাহলে আমরা তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status