বিশ্বজমিন

এএফপির রিপোর্ট

স্কুলে শিক্ষা বঞ্চিত হয়ে মাদ্রাসায় ঝুঁকছে রোহিঙ্গা শিশুরা, বাড়ছে উগ্রবাদের আশঙ্কা

মানবজমিন ডেস্ক

১৯ জুন ২০১৯, বুধবার, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ার অধিকার নেই। ফলে তারা শিক্ষা গ্রহণের জন্য ধাবিত হচ্ছে মাদ্রাসার দিকে। সেখানে শিক্ষার মান নিম্নমানের বলে অভিযোগ সমালোচকদের। এর ফলে তাদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশী স্কুলগুলো থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের বের করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারের এমন নীতির সমালোচনা করেছে অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো। অন্যদিকে দাতব্য সংস্থাগুলো ও জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ রোহিঙ্গা শিশুদের ১৮০০ অস্থায়ী স্থাপনায় শিক্ষা দিচ্ছে। সেখানে প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার শিশু পড়াশোনা করছে। কিন্তু তাও শুধু প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত। এই ফারাক পূরণ করতে গিয়ে রোহিঙ্গা গ্রুপগুলো এবং বাংলাদেশী ধর্মীয় গ্রুপগুলো এক হাজারের বেশি মাদ্রাসা স্থাপন করেছে। সেখানে মৌলিক আরবি শিক্ষা থেকে শুরু করে গ্রাজুয়েট স্তর পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষার সবটাই দেয়া হচ্ছে। তবে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক বলেছেন, আমরা জাতীয়তার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে ব্যবধান করি না। বিশেষ করে যখন তাদের মধ্যে শিক্ষার দৃঢ় আগ্রহ থাকে এবং তারা আল্লাহর পথে থাকতে চায়। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে কমপক্ষে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে বাংলাদেশে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ। তাদের আশ্রয় হয় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে কক্সবাজারে। এখানকার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিল আছে। তাদেরকে কর্তৃপক্ষ অস্থায়ীভিত্তিতে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েদের স্থানীয় স্কুলে পড়ার অধিকার প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে একটি প্রজন্ম হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। এএফপি লিখেছে, এ বছর প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার সরকার রোহিঙ্গা শিশুদের বিরুদ্ধে দমননীতি (ক্র্যাকডাউন) চালায়। স্কুলগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয় রোহিঙ্গা শিশুদের বহিষ্কার করতে। এর আগে পর্যন্ত অনেক রোহিঙ্গা শিশু ফাঁক গলিয়ে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

এমনই এক রোহিঙ্গা শিশু লাকি আকতার (১৫)। সে হ্নীলা গ্রামের স্কুল হারিয়েছে। সেখানে এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ছিল শরণার্থী ক্যাম্পের। লাকির সামনে এখন আর কিছুই করার নেই। শুধু মাকে তার খুঁটিনাটি কাজে সহায়তা করে। কান্নায় ভেঙে পড়ে লাকি জানায়, আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব না। এমনই আরেক রোহিঙ্গা শিশু হারেস (১৩)। তাকে টেকনাফের একটি স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বর্তমানে সে লেদা শরণার্থী শিবিরে একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। তার পিতা মোহাম্মদ খালেক বলেন, পড়াশোনা নিয়ে তার জন্য ব্যস্ত থাকা উত্তম। তা নাহলে সে ক্যাম্পের এদিক-ওদিক ঘোরাফিরা করবে। তাতে তার স্বভাব নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

সমালোচকরা সতর্ক করছেন। তারা বলছেন, শিক্ষার জন্য ভাল বিকল্প মাদ্রাসা নয়। তবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলেছে, মাদ্রাসা থেকে সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থায় দীক্ষা দেয়ার বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। এতে আরো বলা হয়, শিশু কিশোরদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ প্রত্যাখ্যান করায় এবং তাদেরকে অনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসার ওপর নির্ভরশীল করে দেয়ার ফলে অবশ্যই ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এর মধ্য দিয়ে ওইসব গ্রুপ এই ক্যাম্পে তাদের উপস্থিতি অর্জন করতে পারে।

নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলো’র উগ্রবাদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মুবাশ্বের হাসান বলেন, সরকারের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা উচিত। রোহিঙ্গা শিশুরা মানসিকভাবে দুর্বল, বিচ্ছিন্ন এবং ক্ষুব্ধ। পাশাপাশি তারা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে খুবই ধর্মপরায়ণ।
এএফপি তার প্রতিবেদনে আরো লিখেছে, বেশ কিছু মাদ্রাসা পরিচালনা করে ইসলামপন্থি গ্রুপ হেফাজতে ইসলাম। ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে আইন বাস্তবায়নের দাবি সহ বিভিন্ন দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ে সহিংস বিক্ষোভ করেছে তারা। ২০১৩ সালে তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী ঢাকায় সমবেত হন। তা থেকে সহিংসতা সৃষ্টি হয়। এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত ও কয়েক শত মানুষ আহত হন। তবে সম্প্রতি এই গ্রুপটি সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছে। তাদের শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই গ্রুপটির একজন সিনিয়র নেতা আজিজুল হক। কট্টরপন্থিদের সঙ্গে এই গ্রুপটির কোনো যোগসূত্র থাকার কথা তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের অনেক মাদ্রাসার কারিকুলাম অনুযায়ী তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মীয় শিক্ষা দিচ্ছে। এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

এই গ্রুপের মুখপাত্র ফজলুল করিম বলেন, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শেষ ভরসা। ধর্মের কারণে তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। সত্যিকার ধর্মীয় শিক্ষাই শুধু এ সম্প্রদায়ের কাছে স্বস্তি আনতে পারে। উল্লেখ্য, সাতটি মাদ্রাসা পরিচালনা করেন ফজলুল করিম। সেখানে পড়াশোনা করছে ২৫০০ শিক্ষার্থী।

কিন্তু সাধারণ স্কুলে পড়ার আগে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন মজিব উল্লাহ। তিনি বলেছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যথাযথ শিক্ষা পাওয়া যায় না। মজিব উল্লাহ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ান একটি মসজিদে নামাজ পড়ান। তিনি বলেন, এসব মাদ্রাসা শুধু কিছু ধর্মীয় শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম তৈরিতে সহায়তা করে। আমাদের সন্তানদেরকে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো উচিত, যেখান থেকে তাদেরকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে সহায়তা করবে। তা নাহলে এই প্রজন্ম একেবারে হারিয়ে যাবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status