বাংলারজমিন

নবাবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সংকট আর দালালদের উৎপাত

নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি

২৬ মে ২০১৯, রবিবার, ৯:৪১ পূর্বাহ্ন

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলা ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাগজ কলমে যে পরিমাণ চিকিৎসক আছে বাস্তবে তা নেই। এক্স-রে মেশিন দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে তালা বন্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। রয়েছে লোকবল সমস্যা, সঙ্গে অবকাঠামোর সমস্যা। অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও নেই চালক। এত সমস্যার কারণে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। সেই সাথে দলাল ও ওষুধ রিপ্রেজেনটেটিভদের উৎপাত। জানা যায়, উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে নবাবগঞ্জ উপজেলার চার লক্ষাধিক মানুষের সরকারি চিকিৎসাসেবা দানের তৈরি ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে নানান সংকটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। ৩৫ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে আছে মাত্র ১৮ জন। ১১ জন চিকিৎসকের কর্মস্থল এখানে হলে তারা দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। অথচ তারা বেতন পাচ্ছেন নবাবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক হিসেবে। অপর ৬টি পদ খালি দীর্ঘদিন ধরে খালি। নাক, কান, গলা, আর্থোপেড্রিক, গাইনি, সার্জারি চিকিৎসক নেই এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শহীদুল ইসলাম জানান, ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যে পরিমাণ চিকিৎসক থাকা প্রযোজন তা এখানে নেই। অল্প সংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে চার লক্ষাধিক লোকের চিকিৎসা দিতে রীতিমতো আমরা হিমশিম খাচ্ছি। এই চিকিৎসক আরও জানান, ৩৫ জন চিকিৎসক থাকার কথা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে এর মধ্যে ৬ জন শূন্য পদে। বাকি ২৯ জনের মধ্যে ১১ জন সরকারি বিশেষ প্রয়োজনে রাজধানী ঢাকার গণভবনসহ বিভিন্ন স্থানে (ডেপুটেশনে) প্রেষণে কর্মরত আছেন। সর্বশেষ ১৮ জন চিকিৎসক দিয়ে পুরো হাসপাতাল চালাতে কষ্টকর হয়ে পড়ে। এর উপর আবার ১০ জন প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ঢাকায় যাওয়া-আসা করে কাজ করায় রোগীরা আরও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয় বলে জানান তিনি। দীর্ঘদিন ৩০ মাস ধরে এক্স-রে মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। আমি অর্ধশতাধিক বার বিষয়টি উপর মহলে চিঠি দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে একটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে যার চালক নেই। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, যে সকল চিকিৎসক ঢাকায় কর্মরত রয়েছেন তারা হলেন জাতীয় সংসদ ভবনে ডা. ইকবাল ও ডা. উল্লাস, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ডা. ইব্রাহিম খলিল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ডা. তাসনুভা মারিয়া, ডা. নাসরিন আক্তার লিনা, ডা. তাহসীন জামান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডা. তাহমিনা ইসলাম, ঢাকা মেডিকেলে ডা. ফাহমিদা, ডা. কাকলি, ডা. মনিকা এবং মুগদা হাসপাতালে ডা. নওরিন বারী। কয়েকদিন হাসপাতালে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসদের বসার কয়েকটি রুমের সামনে রোগীদের লম্বা লাইন অথচ চিকিৎসক নেই। ফাঁকা পড়ে আছে চিকিৎসকের বসার চেয়ারটি। চিকিৎসক না থাকার কারণ জানতে চাইলে অফিসকক্ষে এক কর্মকর্তা বলেন, ঐ চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকজন ঢাকা থেকে আসা-যাওয়া করে রোগী দেখেন। তারা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টায় অফিসে আসেন। ফলে যে চিকিৎসকরা স্থায়ীভাবে রোগী দেখেন তাদের উপর চাপ পড়ে বেশি। রোগীদের ভিড়ে নাজেহাল কর্মরত ডাক্তাররা। এক্স-রে মেশিনের রুমের দরজায় তালা ঝুলছে। প্রায় ৩০ মাস ধরে মেশিনটি নষ্ট। অথচ বার বার আবেদনের পরও মেশিনটি মেরামত বা নতুন মেশিন পাচ্ছেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ নষ্ট থাকায় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বাহির থেকে এক্স-রে করতে হচ্ছে। চিকিৎসকসহ নানা সংকটে প্রাপ্ত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে আসা পাঁচ থেকে ৬০০ রোগী। ওষুধেরও সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে। গত কয়েক মাস পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (টিএসও) ডা. মো. শহীদুল ইসলাম তার রোগী দেখার কথা না থাকলেও রোগীদের প্রবল ভিড় ও চাপ ঠেকাতে তিনি প্রতিদিন ডাক্তার চেম্বারে বসে রোগী সেবা প্রদান করছেন। কথা হয় চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার বাহ্রা ইউনিয়নের আলগীচর এলাকার হাবিবুর রহমানের সাথে তিনি বলেন, আমি শ্বাসকষ্টের রোগী। টাকার অভাবে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারি না। সেখানে চিকিৎসা নিতে অনেক টাকা লাগে। আশা করে যাও সরকারি হাসপাতালে আসলাম তাও দেখি ডাক্তার নাই। আমার মতো গরিব মানুষের কথা চিন্তা করে হলেও এই হাসপাতালটিতে বেশি চিকিৎসক দেওয়ার দাবি জানান এই বৃদ্ধা।

কথা হয় রুনা আক্তার নামে এক গৃহবধূর সাথে তিনি তার দুই বছরের এক শিশুকে নিয়ে এসেছেন ডাক্তারের কাছে ডাক্তার সকাল ১০টাও তার চেম্বারে বসেনি। ১১টায় সাড়ে ১১টায় এসে কয়েকটা রোগী দেখেই চলে যান লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা না নিতে পারলে অনেক কষ্ট লাগে।
ছাহেলা বেগম ৫০ কয়েকদিন যাবৎ বুকের ব্যথা নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তারও দেখিয়েছেন তবে ডাক্তার তাকে বুক এক্স-রে করাতে বলেছেন। কিন্তু হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন নষ্ট। প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে এক্স-রে করাতে বলেছেন ডাক্তার। তাহলে সরকারি হাসপাতালের কি প্রয়োজন এমন প্রশ্ন তার।
উপজেলা সদরের এক শিক্ষক বলেন, চালকের অভাবে লাখ-লাখ টাকার একটি অ্যাম্বুলেন্স পড়ে রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। অথচ এগুলো নিয়ে কারো কোনো ম্যাথাব্যথা নেই। উল্টো হাসপাতালে দালালদের ভিড়।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তা ডা. শহীদুল ইসলাম জানান, উপজেলার চার লক্ষাধিক মানুষের জন্য ৫০শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল যথেষ্ট নয়। এটাকে দ্রুত ১০০ শয্যায় করতে হবে। পাশাপাশি এক্স-রে মেশিন, আল্ট্রা মেশিন এবং অ্যাম্বুলেন্সের চালক দ্রুত নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। অবকাঠামোর উন্নয়নেরও বিকল্প নেই। এছাড়া শীঘ্রই সরকারি নিয়ম-নীতির মাধ্যমে শূন্য পদে চিকিৎসক নিয়োগ দিলেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চিকিৎসক সংকট কাটিয়ে উঠবে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। দালালের বিষয়ে তিনি বলেন, আগের চেয়ে এখন অনেক অংশে কমেছে কিছুদিন পর থাকবে না। এক্স-রে মেশিনটি দীর্ঘ ৩০ মাস ধরে নষ্ট। এই পর্যন্ত ১১-১২ বার ইঞ্জিনিয়ার এসেও মেশিনটি ঠিক করতে পারেনি। ব্যাপারটি আমি ডিজি অফিসের সিবিএইচসি ডিপার্টমেন্টে একাধিকবার জানিয়েছি। সর্বশেষ হাসপাতালের সভাপতি ঢাকা-১ আসনের এমপি সালমান এফ রহমান স্যারের নিকট চলতি মাসের ৭ তারিখ আবেদন করা হয়েছে এক্স-রে, আলট্রা ও আরেকটি অ্যাম্বুলেন্সের জন্য।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ এহেছানুল করিম বলেন, গত কয়েকদিন আগে আমি নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটি ভিজিট করেছি। সেখানে চিকিৎসক সংকটসহ বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে’ কয়েকদিনের মধ্যে এসব রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সেখানে ১১ জন চিকিৎসক খাতা কলমে থাকলেও তারা (ডেপুটেশনে) অন্যত্র কাজ করেন অথচ সেখান থেকে বেতন ভাতা উত্তোলন করেন যদি তারা সেখানে কর্মরত থাকতেন তাহলে চিকিৎসক সংকটটা থাকতো না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status