দেশ বিদেশ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাখরাবাদের বিকল্প ম্যানেজমেন্ট

উঠোন বৈঠক করে অবৈধ সংযোগ যুবলীগ নেতার

জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে

২৩ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৯ পূর্বাহ্ন

গ্যাসের মালিক সরকার। আর বিক্রি করার দায়িত্ব বাখরাবাদের। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসবের কর্তৃত্ব অন্যদের হাতে। সরকারের গ্যাস দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামাই করছে তারা। বাখরাবাদের কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন গ্যাসের অবৈধ সংযোগের সিন্ডিকেট শক্তিশালী। যখন খুশি তখনই গ্যাস সংযোগ দিয়ে দিতে পারছে তারা। অফিসিয়ালি ৫ হাজার অবৈধ সংযোগ থাকার কথা স্বীকার করা হচ্ছে। তবে বাস্তবে তা ১৫ হাজার হবে বলে অফিসের অন্য সূত্রে ধারণা পাওয়া গেছে। একেকটি সংযোগের জন্য সর্বনিম্ন ৬০ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকার উপরে নেয়া হয়েছে। সেই হিসাবে অবৈধ সংযোগের সিন্ডিকেট এই ক’বছরে আয় করেছে প্রায় শত কোটি টাকা। সরজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালে সংযোগ বন্ধ হওয়ার আগে বিভিন্ন গ্রামে এই সিন্ডিকেট মাইলের পর মাইল সম্প্রসারণ লাইন বসিয়ে ফেলে অবৈধভাবে। এই সম্প্রসারণ লাইন থেকে শত শত সংযোগ দেয়া হয়। একইভাবে সংযোগ দেয়া হচ্ছে এখনো। মাইলের পর মাইল সম্প্রসারণ লাইন বসানো হচ্ছে। বাখরাবাদ কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত ৫৪ হাজার ফুট অবৈধ লাইন চিহ্নিত করেছে। তবে অবৈধ সংযোগ আর লাইন চিহ্নিত করার মধ্যেই রাতারাতি নতুন লাইন ফেলা হচ্ছে, সংযোগ দেয়া হচ্ছে। বেপরোয়াভাবে এ কাজে ৪/৫ জন জড়িত বলে জানিয়েছেন বাখরাবাদের কর্মকর্তারা।
উঠোন বৈঠক করে অবৈধ সংযোগ: বুধল ইউনিয়নের খাটিহাতা গ্রামের পূর্বপাড়ার আইয়ুব আলীর বাড়িতে গত বছর রমজানে উঠোন বৈঠক হয় গ্রামে গ্যাস সংযোগ দেয়ার ব্যাপারে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সুহিলপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও সদর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহসীন খন্দকার। তাকে ঘিরে হওয়া ওই বৈঠকে গ্যাস সংযোগ পেতে আগ্রহী সবাই উপস্থিত ছিলেন। বুধলের ৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আবু চানকে আহ্বায়ক করে ৮/৯ জনের একটি কমিটিও করা হয় ওই বৈঠকে। আবু চান জানান, গরিব ও অসহায় মানুষের টাকা যাতে মার না যায় সেজন্য তারা এই কমিটি করেন। প্রথমে প্রতি সংযোগের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। কিন্তু পরে সেটি ঠিক থাকেনি। কমিটিরও ঠিক-ঠিকানা নেই এখন। সরাসরি দালালরা কাজ করছে জানিয়ে আবু চান বলেন, সংযোগের জন্য ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয় একেকজনের কাছ থেকে। আবু চানের বাড়িতেও সংযোগ দেয়া হয় ৬০ হাজার টাকা নিয়ে। এ তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার যখন বৈধভাবে গ্যাস দেবে তখনই আমি গ্যাস নেয়ার পক্ষে ছিলাম। কিন্তু আমি দু-আড়াই মাস ঢাকায় থাকার সুবাদে আমার পরিবারকে ম্যানেজ করে দালালরা গ্যাস সংযোগ দিয়ে দেয়। এ নিয়ে পরিবারের সঙ্গে আমার অনেক ঝগড়া হচ্ছে। তিনি জানান, তাদের এলাকায় এখনো প্রতিদিন অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে সহিদ মিয়া ও রহিম মোল্লার বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। গ্রামের ইদ্রিস গ্যাস সংযোগের দালাল হিসেবে কাজ করছে। সে টাকা নিয়ে ঘাটুরায় মহসীনের কাছে দিচ্ছে বলে জানান আবু চান। সরজমিন গ্রামে গেলে অনেকেই জানান, তারা গ্যাস সংযোগ পেতে মহসীন খন্দকারকে টাকা দিয়েছেন। আইয়ুব আলী সংযোগ নিয়েছেন ৭০ হাজার টাকা দিয়ে। এই টাকা দিয়েছেন তিনি মহসীনকে। তিনবছর আগে সংযোগ হলেও বিল বই পাননি এখনো। তার কাছে একটি ডিমান্ড নোট রয়েছে। যেটি ২০১৫ সালে ইস্যু করা। এর সিরিয়াল নম্বর ১০৫৪১২। এই ডিমান্ড নোটের মাধ্যমেই সংযোগের জন্য তিনি ব্যাংকে (ইউসিবিএল) ৮৮২৫ টাকা জমা করেন। আইয়ুব আলী জানান, এরপর ২০১৬ সালে তিনি সংযোগ পান। কিন্তু বিল বই পাননি আজ পর্যন্ত। বিল বই দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে তাকে। মহসীন খন্দকারকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে সংযোগ নিয়েছেন এ গ্রামেরই মুদি দোকানি মো. কাউসার আহমেদ। তিনি জানান, ব্যাংক ড্রাফটসহ সব খয়খরচ বাবদ তার কাছ থেকে এই টাকা নেয়া হয়েছে। কাউসার গ্রামে গ্যাস সংযোগের যে কমিটি হয়েছিলো এর কোষাধ্যক্ষও ছিলেন। তিনি জানান তার বিল বই ওয়েটিংয়ে রয়েছে বলে জানানো হয়েছে তাকে। আরেকজন মামুন মিয়া সংযোগ নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা দিয়ে। তিনিও টাকা দিয়েছেন মহসীনকে। মামুনের কাছে একটি বিল বই রয়েছে। যার সিরিয়াল নম্বর ১৪০-৩৩৮৪২। পূর্ব পাড়ার জহুরা খাতুনও গত রমজানে সংযোগ নিয়েছেন ৬০ হাজার টাকা দিয়ে। তাকে বিল বইও দেয়া হয়েছে। তিনিও টাকা দিয়েছেন মহসীনকে। এই পাড়ার রহিস মিয়া, সহিদ মিয়া, বদর মিয়া ও নূরুল আমীন জানান, যেদিন কানেকশন ওইদিনই বিল বই দেবে বলে তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়। খাটিহাতা পশ্চিমপাড়ার মতি মিয়ার বাড়িতে এই রমজান শুরুর প্রথমদিন সংযোগ দেয়া হয়। মতি জানান, তিনি ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এর বাইরে ১০ হাজার টাকার গ্যাস সংযোগের মাল কিনেছেন। ঘাটুরার মহসীনের কাছে দেয়ার জন্য ইউনুছ মিয়ার বউ তার কাছ থেকে এই টাকা নিয়েছেন। জয়নাল মিয়া গ্যাস সংযোগের জন্য দিয়েছেন ৬০ হাজার টাকা। তার স্ত্রী হেমেলা জানান, প্রথমে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এরপর বইয়ের জন্য দিয়েছেন আরো ২০ হাজার টাকা। ৩/৪ মাস আগে এই টাকা দিয়েছেন তারা মহসীনের কাছে। এই গ্রামের তাসলিমা, সালাম, অহিদ মিয়া সবাই রমজানের ৩/৪ দিন আগে সংযোগ পান। জানা গেছে, প্রায় ২’শ অবৈধ সংযোগ রয়েছে খাটিহাতা গ্রামে। তাদের কাউকে বিল বই দেয়া হয়েছে। কাউকে বিল বই দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কারো হাতে আছে চাহিদাপত্রের কপি। মোট কথা গ্যাস অফিসের কোনো একটি ডকুমেন্টস ধরিয়ে দিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে টাকা। ১১ই মে খাটিহাতা গ্রামে ঘুরে এ বিষয়ে খোঁজখবর নেয়ার সময় খবর পেয়ে মহসীন খন্দকার একাধিকবার ফোন দেন এ প্রতিবেদকের মোবাইলে। এসব সংযোগ তারই করা বলে স্বীকার করেন। তবে দু-আড়াই বছর আগের পুরনো সংযোগ বলে দাবি তার। ২০১৬ সালে সংযোগ বন্ধ হওয়ার পরও লাগাতার অবৈধভাবে সংযোগ দিয়ে কীভাবে বিল বই দেয়া হচ্ছে সেটিও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এসব বিল বই বা ডিমান্ড নোট আসল কিনা তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বাখরাবাদের কর্মকর্তারা। এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি জাল বিল বই ধরা পড়েছে তাদের হাতে। বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিক্রয় বিভাগের ডিজিএম প্রকৌশলী জাহিদুর রেজা জানান, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে দেখা যায় ২/১ জন এসে তাদের বিল বই দেখাচ্ছে। তাদের জব্দ করার জন্য অন্য এলাকার বিল বইও শো করা হয়। সম্প্রতি ২টি জাল বিল বইও পেয়েছেন তারা। যার একটি সুহিলপুরের হাড়িয়া ছাদিরপুরের মোসাম্মৎ হোসেনা বেগমের নামে (ক্রমিক নম্বর ১৪০-৩৩২২২), আরেকটি একই এলাকার মো. হারুন মিয়ার নামে (ক্রমিক নম্বর ১৪০-৩৩০৫৬)। তিনি জানান, বই দুটিতে তাদের কর্মকর্তা সহকারী ব্যবস্থাপক (রাজস্ব) মো. নাজমুস সাকিবের স্বাক্ষর ও সিল দুটোই জাল। তিনি আরো জানান, তাদের অফিস থেকে ১২’শ বিল বই ছিনতাই হয় ২০১৫-১৬ সালের দিকে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status