এক্সক্লুসিভ

কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ রচনা

সৈয়দ দীদার বখ্‌ত

২০ মে ২০১৯, সোমবার, ৯:০৯ পূর্বাহ্ন

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সমাগত। নানা অধ্যায়ে বিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপঞ্জি। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে গর্জে উঠেছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিকসহ আপামর মুক্তিকামী জনতা। পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউন, গেরিলা যুদ্ধ, ঘটনাবহুল একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই দিনগুলো উঠে এসেছে সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দীদার বখ্‌তের লেখায়।
সাতক্ষীরা তালা এলাকার সশস্ত্র মুক্তি বাহিনীর অধিনায়কত্ব করেছেন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা কামেল বখ্‌ত।
কামেল ছিল সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি। তার দুর্দান্ত সাহসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য সকলের কাছে ছিল গ্রহণযোগ্য। ছাত্র রাজনীতিতে সে ছিল কাজী জাফর-মেনন-রনোর অনুসৃত সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাতক্ষীরা জেলার প্রতিনিধি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কাজী জাফর, মেনন ও রনোর নবগঠিত বামপন্থি কমিউনিস্ট সমন্বয় কমিটির সাতক্ষীরা জেলার প্রতিনিধি। “সমন্বয় কমিটি” দেশ স্বাধীন করার জন্য অন্যান্য বামপন্থি দলগুলোকে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিল। তাছাড়া তারা আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল যারা যুদ্ধে লিপ্ত এবং সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করছে তাদের সঙ্গে যৌথভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার স্বপক্ষে কাজ করার চেষ্টা করছিল। তারই অংশ হিসেবে কামেল সাতক্ষীরা জেলার সশস্ত্র মুক্তি ফৌজ গঠন করছিল। কামেল সমন্বয় কমিটির  সাতক্ষীরা জেলার কমান্ডার ছিল।

আমি এবং প্রদীপ মজুমদার ভাসানীপন্থি ন্যাপের প্রতিনিধি হিসেবে যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমরা সর্বোতভাবে পরামর্শ করে কীভাবে এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করবো তার ছক রচনা করতাম। মূলত ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং যৌথভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করার দায়িত্ব ওই এলাকায় আমার উপর দেয়া হয়েছিল। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে আসার পর পর মোড়ল আব্দুস সালাম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ছালাম মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিল। ছালাম এসে কীভাবে আমরা একসঙ্গে যৌথভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করবো সে সম্পর্কে আমার সঙ্গে আলাপ করে। সশস্ত্রভাবে চলাচলের সময় যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে তার জন্য ‘পাসওয়ার্ড ’ ঠিক করা হলো।

এ সময়ে কপিলমুনিতে রাজাকারদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। তালাতে ঘাঁটি না গাড়তে পেরে তারা বাহিনী নিয়ে তালা থানার অভ্যন্তরে বর্ধিষ্ণু পরিবার এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হানা দিয়ে তাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং লুটপাট শুরু করেছে। খলিল নগরের নিজাম একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। সে সংবাদ দিলো প্রায় প্রতিদিন রাজাকাররা এলাকায় ঢুকছে এবং লুটপাট করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বাড়িঘর উচ্ছেদ করে তাদের বাড়ি দখল ও হত্যা করছে। নির্যাতন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এ সময় ঘোষ নগরের মদন মোহন ঘোষালকে তারা নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে। সৈয়দ আব্দুর রব  (সৈয়দ ইসার চাচা) এবং  সৈয়দ কামাল বখত্‌ এমপি এবং আমাদের মামা তারও একই পরিণতি হলো। এই ঘাঁটির পতন অতি জরুরি। ছালামের সঙ্গে পরামর্শ করে কপিলমুনি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেই আমরা।

এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে হলে আমাদের আধুনিক অস্ত্রের প্রয়োজন। বিশেষ করে এলএমজি, এসএমজি, মর্টার ইত্যাদি ধরনের অস্ত্রের প্রয়োজন। কামেলকে ভারতে ৯ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য পাঠানো হলো।

কামেল যথাসময়ে ভারতে সমন্বয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে দেখা করে। সঙ্গে সঙ্গে মেজর জলিলের সঙ্গেও দেখা করে কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ইউনিট পাঠাবার অনুরোধ করে।

ভারত থেকে লেফটেন্যান্ট আরেফিনের  নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট পাঠানো হলো কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটি উচ্ছেদের জন্য। যথাসময়ে লে. আরেফিন এবং কামেলের নেতৃত্বে সমন্বয় কমিটির মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করেন।

সমস্ত দিনব্যাপী এই আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। আমি ৮/১০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ জেঠুয়া বাজারের অনতিদূরে ব্যাকআপ পজিশনে অবস্থান করছিলাম। সমস্ত দিন গোলাগুলি করেও  কিন্তু কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটির পতন আমরা ঘটাতে সক্ষম হইনি। রাজাকারদের ঘাঁটি থেকে যে প্রতিরোধ করা হয়েছিল তা বিস্ময়কর। দূরপাল্লার এলএমজি দিয়ে রাজাকার ঘাঁটির বিল্ডিং ঝাঁঝরা করা হয়েছিল। কিন্তু ওদের ওখান থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হইনি। তাই সেদিন আমরা ফিরে এসে কীভাবে ঐ ঘাঁটির পতন ঘটানো যায় তার জন্য আমার বাড়ি তেঁতুলিয়াতে মিলিত হই। লে. আরেফিন এবং তার ইউনিটের সকলের থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। লে. আরেফিন বললো- এই রাজাকার ঘাঁটি অত্যন্ত সুরক্ষিত। এই ঘাঁটির পতন ঘটাতে হলে চারদিক থেকে আক্রমণের প্রয়োজন। তার জন্য চাই মর্টার এবং দূরপাল্লার এলএমজি। আরেফিন সাহেব ফিরে গিয়ে আরো মুক্তিযোদ্ধা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবেন বলে আমাদের আশ্বস্ত করলেন।

আমরা কপিলমুনি ঘাঁটির পতন ঘটানোর জন্য তার পরদিন আবার আক্রমণ করবো তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। জালালপুর জেঠুয়ার মাঝামাঝি স্থানে একটি এলএমজি পোস্ট পাহারায় রেখে এসেছিলাম। তার পরদিন খবর পেলাম পাক আর্মির একটি সেমিগানবোট কপিলমুনির উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। গানবোট দৃশ্যমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলএমজি থেকে গুলিবর্ষণ করা হলো। গানবোটের উপরে কয়েকজন পাক আর্মির সেপাই দাঁড়িয়েছিল। গুলিবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তারা পড়ে গেল। আর তখনই গানবোট থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু হলো। আধুনিক গান ফায়ারের সামনে আমাদের ছেলেরা বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। তারা ওখান থেকে পোস্ট উঠিয়ে নদী পার হয়ে আমাদের তেঁতুলিয়ার ঘাঁটিতে চলে আসলো।

পাক হানাদার বাহিনী জেঠুয়া জালালপুর শ্রীমন্তকাঠি এলাকায় গানবোট থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করে ক্ষান্ত হয়নি। অদূরবর্তী পাইকগাছা থেকে আরো সৈন্য বোঝাই লঞ্চ বহর এসে নদী থেকে ডাঙ্গায় উঠে জেঠুয়া জালালপুর শ্রীমন্তকাঠি এলাকার দোকানপাট, বাড়িঘর পোড়ান শুরু করে এবং যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। আমাদের জানামতে কয়েকশ’ বাড়ি ও দোকানপাট তারা পুড়িয়ে দিয়েছিল। আমাদের জানামতে ২৫/৩০ জনকে (অধিকাংশ বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা) হত্যা করে নদীতে লাশ ফেলে দিয়েছিল। পাক হানাদার বাহিনীর দানবীয় তাণ্ডব সেদিন আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে দেশকে হানাদার মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে নতুনভাবে শপথ নিয়েছিল অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা।
এর দুদিন পরেই পাক হানাদার বাহিনীর একটি সাঁজোয়া নৌবহর তালা থানাতে উপস্থিত হয়। তালা থেকে সশস্ত্র পাক সেনারা তেঁতুলিয়াতে এসে আমাদের বাড়িতে দ্বিতীয়বারের মতো আগুন দেয়। তারা আগুন জ্বালিয়ে স্থান ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে থাকা গ্রামবাসী দ্রুত এসে আগুন নেভায়। এই আগুনে আমাদের কাচারি বাড়ি সহ আরো তিন/চারটি ঘর ভস্মীভূত হয়।

এরপর আমাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য লে. আরেফিন ব্যবস্থা  নেবেন বলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আমাদের সঙ্গে রেখে ভারতে চলে গেলেন। এই যুদ্ধের ফলে আমরা অনুভব করলাম আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান এবং শক্তি আরো বৃদ্ধি ও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। একটি বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত হলাম যতই অত্যাচার-নির্যাতন হোক না কেন- মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে অবিচলভাবে গ্রামবাসী আছেন এবং তাদের সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
রাজাকার বাহিনীতে যারা যোগ দিয়েছেন তারা গ্রামে ফেরার সাহস হারিয়েছেন। অনেকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে- বাহিনীর লুটপাট কর্মকাণ্ড, নির্যাতন, নিরীহ মানুষদের হত্যা করতে না পারায় বাহিনী থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছে। অনেকে সঙ্গে করে রাইফেল নিয়েও পালিয়ে এসেছে। অনুমান করেছি অচিরেই রাজাকার বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে। এদের রিক্রুট করা হয়েছে ৩০০ টাকার বিনিময়ে। যখন দেখছে তাদের বেতন নয়-  লুটপাট করা, নির্যাতন করা, অত্যাচার ও মানুষ হত্যার জন্য তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সেজন্য অনেকেই দল ত্যাগ করে পালিয়ে আসতে শুরু করেছে। যতই দিন যাচ্ছে- মুক্তিযোদ্ধারা নতুন উদ্দীপনায়, অনুপ্রেরণায় দেশকে মুক্ত করার জন্য  সংকল্পবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। আমরা করব জয়- জয় আমাদের হবেই। সেদিন দূরে নয়।

কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি পতনের জন্য লে. আরেফিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়া সমন্বয় কমিটির একদল অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- মারুফ হোসেন তুরান, আশরাফ, মোহর আলী, মুন্সি আকরামুজ্জামান, ইয়াকুব আলী শেখ, আকবর, হায়দার নিজাম, ইমান আলী, বারী মোড়ল, আঃ কাঃ সিরাজ উদ্দীন, আব্দুল ওহাব, বারেক, শামছুর রহমান, সাহাবুদ্দীন, নাসির উদ্দিন, শুকুর মোড়ল, কামরুল ইসলাম (জালালপুর), আফাজ উদ্দীন, জনাব আকুঞ্জি, খালেক (হাতবাস), আবুল হোসেন (ইসলাম কাটি), হাকিম (ছাত্র নেতা) ইত্যাদি। আরো অনেকের নাম মনে নেই। মীর আবুল কালাম আজাদ এবং ইয়াকুব আলী দশম শ্রেণির ছাত্র, সার্বক্ষণিকভাবে তারা ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সহযোগিতা করা ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করেছিল। প্রাণকৃষ্ণ নাথ-এর চায়ের দোকানে বসে খবরাখবর সংগ্রহ করে রাজাকার ও পাক সেনাদের  কার্যক্রমের বিষয়ে অবহিত করতো। (চলবে)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status