বাংলারজমিন

‘যৌন হয়রানি কমিটি’ আর কতদূর!

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে

১৮ মে ২০১৯, শনিবার, ৮:৫৬ পূর্বাহ্ন

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি বন্ধে ২০০৯ সালের ১৫ই মে যৌন হয়রানি কমিটির নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। সেই থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ১০টি বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু চট্টগ্রামের তেমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মজীবী নারীর কর্মস্থলে দেখা মিলছে না এই কমিটির। বরং অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যৌন হয়রানি কমিটি সম্পর্কে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কথা জানে না অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। এমনকি কর্মজীবী নারীরাও ওয়াকিবহাল নয়, এ সম্পর্কে। ফলে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হলেও মুখ বুঝে সহ্য করছেন স্কুল শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী নারীরা।

অবশ্যই এ বিষয়ে যারা জানেন তাদের অনেকেরই এখন প্রশ্ন-আর কতদূর গেলে দেখা মিলবে যৌন হয়রানি কমিটির। আর কত উপেক্ষিতই থাকবে যৌন হয়রানি কমিটি গঠনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরিসংখ্যান মতে, চট্টগ্রাম জেলায় সরকারি-বেসরকারি ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ১৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৩১টি মাদরাসা রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাড়া মাধ্যমিক ও মাদরাসাগুলোর সিংহভাগে যৌন হয়রানি রোধে কোনো কমিটি নেই। ফলে যৌন হয়রানির শিকার হলেও শিক্ষার্থীরা কোথাও অভিযোগ করতে পারেন না।

একইভাবে চট্টগ্রাম জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের হিসেব মতে, জেলা-উপজেলায় ১১টি কর্মজীবি নারী হোস্টেলের মধ্যে একটিতেও কোনো যৌন হয়রানি কমিটি নেই। ফলে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হলেও কর্মজীবী নারীরা কোথাও অভিযোগ করতে পারেন না।

অথচ উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়, যতদিন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে যৌন হয়রানি রোধে কোনো আইন প্রণয়ন করা না হয় ততদিন বাংলাদেশ সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের দেয়া নীতিমালা মোতাবেক যৌন হয়রানি কমিটি বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর হবে। ওই রায় ঘোষণার পর দীর্ঘ ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা।     

এ বিষয়ে চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া বলেন, চসিকের সবগুলো স্কুলে হয়তো নেই। কয়েকটাতে আছে। আসলে নির্দিষ্ট করে আমার জানা নেই। তৎক্ষণাৎ অফিস সহকারী সুভাষ চক্রবর্তীকে ডেকে পাঠালে তিনি জানান, আমাদের স্কুলগুলোতে এমন কোনো কমিটি নেই। তাছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও এমন কোনো চিঠি দেয়া হয়নি। সম্ভবত ম্যাডাম (সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তা) থাকা অবস্থায় এ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ঘটনার আকস্মিকতা বুঝে প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা কুলগাঁও সিটি কর্পোরেশন কলেজের অধ্যক্ষকে ফোন করে যৌন হয়রানি রোধে কমিটি সমপর্কে অবগত হন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নোটিশ ই-মেইলে পাঠাতে বলেন। বিষয়টিকে সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য তিনি আরও বলেন, আসলে এখানে একটু ঝামেলা আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ আমাদের কাছে আসে না।

প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে চলে যায়। তারপরেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় আমাদের নজরে এলে আমরা প্রত্যেকটি বিষয় স্কুলে জানাই এবং সে ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। অন্যদিকে স্কুল প্রধানরা বলছেন ভিন্ন কথা। কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকুমার দেবনাথ জানান, মাসখানেক আগেই আমরা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে সবাইকে পাঠিয়েছি। এমনকী সিটি কর্পোরেশনেও পাঠিয়েছি। রমজানের জন্য স্কুল বন্ধ তাই স্কুল চালু হলেই কাজ শুরু করা হবে। জামালখান কুসুম কুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চমপা মজুমদার বলেন, এইতো চলতি মাসের ৩-৪ তারিখে আমাদের কাছে মেইল এসেছে। ৬ তারিখ থেকে তো স্কুল বন্ধ তাই ৫ তারিখেই কমিটি করে থানা মাধ্যমিকে পাঠিয়ে দিয়েছি। স্কুল খুললেই কার্যক্রম শুরু হবে।

অপর্ণাচরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা তো এসবের ব্যাপারে কিছুই জানি না। আর যদি প্রবলেমও হয় তবে কাকে জানাবো? এখন আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। দেখলেন না ফেনীর নুসরাতের কি হাল হলো!

প্রসঙ্গত, কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে ২০০৮ সালের ৭ই আগস্ট হাইকোর্টে জনস্বার্থে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সালমা আলী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ওই রিটের শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৫ই মে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেন। ওই রিট নিষপত্তি করে ২০০৯ সালের ১৫ই মে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞাসহ যৌন হয়রানি রোধে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়ে মামলাটির রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এই রায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ কেন্দ্র গঠন এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ না করার কথাও বলা হয়। এর আগে গত ২৮শে এপ্রিল দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে কমিটি গঠন করা হয়েছে কী না তা জানতে চেয়ে রিট আবেদন করা হয়েছে। এছাড়াও রিটে দুই সপ্তাহের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

গত বছরে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি গঠনের কথা জানে না। আদালতের নির্দেশনার কথা জানেন না ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছুটা সচেতনতা দেখা গেলেও স্কুল বিশেষত মাদ্রাসা পর্যায়ের পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। মাধ্যমিকের বেশিরভাগ কর্তৃপক্ষই জানে না আদালতের নির্দেশনার কথা। যদিও গত এক দশকে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই কার্যকর হয়নি এই নির্দেশনা।

আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে কমিটি করা হয়েছে সেগুলোও অকার্যকর ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে। গত ১০ বছরে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইনও তৈরি হয়নি। আবার যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আলাদা আইন প্রণয়নের দাবিও দেড় দশকে বাস্তবায়ন হয়নি। আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষাসহ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বাড়ছে বলে মনে করছেন অধিকাংশ অভিভাবক।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status