প্রথম পাতা

রাজেন্দ্রপুর থেকেই টার্গেট করা হয় তানিয়াকে

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে

১৬ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৩২ পূর্বাহ্ন

স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসটি (ঢাকা মেট্রো ব-১৫-৪২৭৪) গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় পৌঁছার পর যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করা হয়। এক এক করে সব যাত্রীর টিকিট পরীক্ষায় দেখা যায়, বাসটির শেষ গন্তব্য পিরিজপুরের একমাত্র যাত্রী নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়া। তখনই বাসচালক নূরুজ্জামান নূরু তানিয়াকে টার্গেট করে। এ কাজে সহযোগিতার জন্য মেয়ে পটানোতে পারদর্শী খালাতো ভাই বোরহানকে নূরু ফোনে বীর উজুলী থেকে বাসে ওঠার কথা বলে। সে অনুযায়ী বোরহান বীর উজুলী থেকে বাসটিতে ওঠে। কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর থেকেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে ওঠে নূরু, বোরহান ও লালন। বাসচালক নূরুজ্জামান নূরু এবং তার সহযোগী লালন মিয়ার আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে বিষয়টি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হয়েছেন। এদিকে শাহিনুর আক্তার তানিয়া হত্যার ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে স্বর্ণলতা পরিবহনের কটিয়াদীর কাউন্টার মাস্টার মো. রফিকুল ইসলাম রফিক। বুধবার বিকালে কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল-মামুন কাউন্টার মাস্টার মো. রফিকুল ইসলাম রফিকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে সন্ধ্যায় কাউন্টার মাস্টার মো. রফিকুল ইসলাম রফিককে কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাজিতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সারোয়ার জাহান ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এনিয়ে রিমান্ডে নেয়া পাঁচ আসামির মধ্যে তিনজন ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। এর আগে গত ১১ই মে মামলার প্রধান আসামি স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসের চালক নূরুজ্জামান নূরু এবং মঙ্গলবার (১৪ই মে) হেলপার লালন মিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া বাকি দুই আসামি লাইনম্যান মো. খোকন মিয়া (৩৮) এবং পিরিজপুরের কাউন্টার মাস্টার মো. বকুল মিয়া ওরফে ল্যাংড়া বকুল (৫০) কে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বুধবার আদালতে সোপর্দ করা হলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। গত ৮ই মে আদালত গ্রেপ্তার হওয়া এই পাঁচ আসামির প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮দিন করে রিমান্ড মঞ্জুরের পর ওইদিন তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে বাসের চালক মো. নূরুজ্জামান নূরু গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোক নয়নবাজার ইউনিয়নের সালুয়াটেকি গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে, হেলপার মো. লালন মিয়া একই ইউনিয়নের বীর উজুলি গ্রামের মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে, কটিয়াদীর কাউন্টার মাস্টার মো. রফিকুল ইসলাম রফিক একই উপজেলার বাড়িসাবর ইউনিয়নের লোহাদি গ্রামের নজর আলীর ছেলে, লাইনম্যান মো. খোকন মিয়া কটিয়াদী উপজেলার ভোগপাড়া এলাকার দুলাল মিয়ার ছেলে এবং পিরিজপুরের কাউন্টার মাস্টার মো. বকুল মিয়া ওরফে ল্যাংড়া বকুল বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের নিলখী মৃত আব্দুস শাহিদ ভূইয়ার ছেলে। অন্যদিকে স্বর্ণলতা পরিবহনের চলন্ত বাসে নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়া হত্যায় কিশোরগঞ্জে প্রতিবাদ এবং ক্ষোভ-বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। বুধবার কিশোরগঞ্জ-নীলগঞ্জ সড়কের নীলগঞ্জ রোডের ঈশা খাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন কর্মসূচিসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়। এসব কর্মসূচি থেকে তানিয়া ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানানো হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাসের কটিয়াদীর কাউন্টার মাস্টার মো. রফিকুল ইসলাম রফিক আদালতে দেয়া তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর দুই ঘন্টারও বেশি সময় চিকিৎসা না পেয়ে তানিয়ার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে। রফিক জানায়, বাসে মুমূর্ষ তানিয়াকে নিয়ে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া হাসপাতালে যাওয়ার পথে কটিয়াদীর ভোগপাড়া থেকে রফিক বাসটিতে ওঠে। তখন বাসটিতে বাসচালক নূরুজ্জামান নূরু, হেলপার লালন মিয়া, বোরহান ও সুপারভাইজার আলআমিনকে পায় রফিক। তখনো মেয়েটির শ্বাসপ্রশ্বাস চলছিল। চালক নূরুজ্জামান নূরু বাস চালিয়ে কাপাসিয়ার দিকে যাওয়ার সময় কটিয়াদী উপজেলার বেতাল যাওয়ার পর সুপারভাইজার আলামিন চালক নূরুকে জানায়, স্বর্ণলতা বাসের এমডি পাভেল তানিয়াকে কটিয়াদী হাসপাতালে রেখে যেতে বলেছেন। সেখান থেকে বাস কটিয়াদীর দিকে আসলে তানিয়াকে হাসপাতালে পাঠাতে দেরি হয়। রাত পৌনে ১১টার দিকে রফিকুল ইসলাম রফিক ও আল আমিন তানিয়াকে কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। কিন্তু তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে মামলার এজাহারভূক্ত দুই আসামি এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসা ধর্ষক বোরহানকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা বাজিতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সারোয়ার জাহান বলেন, তাদেরকে গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
গত ৬ই মে রাতে তানিয়া হত্যাকাণ্ডের পরদিন ৭ই মে রাতে নিহত শাহিনুর আক্তার তানিয়ার পিতা মো. গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে বাসের চালক নূরুজ্জামান নূরু, হেলপার লালন মিয়া, হাসপাতালে তানিয়ার মরদেহ আনয়নকারী আল আমিন এবং পিরিজপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল মামুন এই চারজনের নামোল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা বেশ কয়েকজনকে আসামি করে বাজিতপুর থানায় ধর্ষণ ও হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন।
নিহত শাহিনুর আক্তার তানিয়া কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে। তিনি ঢাকার ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কল্যাণপুর শাখায় সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্মস্থল ঢাকা থেকে বাড়িতে আসার জন্য গত ৬ই মে বিকালে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো ব-১৫-৪২৭৪) ওঠে বাড়ির নিকটতম এলাকা বাজিতপুর উপজেলার বিলপাড় জামতলীতে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হন। গণধর্ষণ শেষে তাকে বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়।
এদিকে পাশবিক এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কিশোরগঞ্জে বুধবার মুখে কালো কাপড় বেঁধে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ শহরের নীলগঞ্জ রোড এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে এই কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. সুলতান উদ্দিন ভূঞা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর অনিল চন্দ্র সাহা, কলা ও সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন প্রফেসর মো. আরজ আলী, লাইব্রেরী সাইন্স বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর নূরুল আমিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান বদরুল হুদা সোহেল, সহকারী প্রক্টর ও ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মাহবুবা অনন্যা, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রভাষক নিবেদিতা দত্ত, আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার, ফরহাদ হোসেন, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশ নেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, দেশে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিষয় যেন এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীরা আজ ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপত্তা পাচ্ছেন না। রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে পাবলিক পরিবহনে নিত্যদিন শ্লীলতহানিসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড এখন নতুন এক আতঙ্কের নাম। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন রাখছি, এসব হত্যকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করবেন এবং প্রতিটি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।
তানিয়া ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় বুধবার কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় আরও কয়েকটি মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এসব মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশ নেয়। এসব কর্মসূচি থেকে তানিয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানান এবং মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারের দাবি জানানো হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status