শেষের পাতা

চট্টগ্রামেও এত ধর্ষণ!

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে

২০ এপ্রিল ২০১৯, শনিবার, ৯:৪৪ পূর্বাহ্ন

বৈশাখের প্রথম দিনে প্রেমিকের সঙ্গে চট্টগ্রামে বেড়াতে আসেন পটিয়া আরেফিন টেক্সটাইল মিলের এক পোশাককর্মী। চট্টগ্রামের কোনো এক জায়গায় বন্ধুর বাসায় রেখে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে সেই প্রেমিক ও তার বন্ধু। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয় ওই পোশাককর্মীকে। এদিকে গতকাল চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানার কাঠগড় মাইজপাড়া রাজাপুকুর এলাকায় শাহিনা আক্তার (৩০) নামে এক নারীকে ধর্ষণের পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। সকাল ১১টার দিকে শাহিনা আক্তারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বৈশাখের প্রথম পাঁচ দিনে চট্টগ্রামে ঘটে আরো ৯টি ধর্ষণের ঘটনা। রয়েছে মাদরাসার এক শিশুকে বলৎকার ও  চলন্ত বাসে চবি ছাত্রীসহ ৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, নগরীর চারটি থানায় দায়ের করা ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মামলা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু পাঁচ দিন নয়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তিন মাস ও ২০১৮ সালে সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনার প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির এ তথ্য পাওয়া যায়। যাকে মহামারী বলে আখ্যায়িত করেছেন জেলা লিগ্যাল এইড ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। জেলা লিগ্যাল এইড চট্টগ্রাম অফিস সহকারী এরশাদুল ইসলাম বলেন, দরিদ্র ও অসহায় নির্যাতিত নারীদের আইনি পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে থাকি আমরা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ধারণ ক্ষমতার প্রায় চারগুণ বেশি আইনি পরামর্শ ও সহায়তার জন্য আবেদন পাচ্ছি। এক পরিসংখ্যানে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে ৭৮৮টি, ২০১৮ সালে ৯০৮টি, ২০১৯ সালে গত তিন মাসে ৩১১টি নারী নির্যাতন মামলার আইনি পরার্মশ দিয়েছি আমরা। যার শতভাগই ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণ এখন মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে চট্টগ্রামে। 

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন চট্টগ্রামের বিশেষ প্রতিনিধি আমিনুল হক বাবু বলেন, চট্টগ্রামে ধর্ষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা মহামারী আকারে রূপ নিয়েছে। দিনে গড়ে ৩-৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে চট্টগ্রামে। সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিকতা স্খলন, ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে বিকৃত রুচির মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সামাজিক এই অপরাধ বাড়ছে। এক্ষেত্রে শুধু পুরুষ নয়, নারীরাও দায়ী।  

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সমন্বয়ক ডা. মাফরুহা নিগার জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা পর্যন্ত চমেক হাসপাতালের ওসিসিতে ১১ জন নারী ও ২ জন শিশু চিকিৎসাধীন রয়েছে। যারা ধর্ষণের শিকার। এরমধ্যে পটিয়া উপজেলার আরেফিন টেক্সটাইলের পোশাককর্মীর কথা উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ১৬ বছরের এই কিশোরী বৈশাখের প্রথম দিন ধর্ষণের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এখনো সে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে।

কিশোরীর ভাই জানান, পটিয়া উপজেলার কচুয়াই গ্রামের রিপন (২৬) বৈশাখের প্রথম দিনে বেড়াতে নিয়ে এসে চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক জায়গায় তার বন্ধুর বাসায় আমার বোনকে রেখে তারা ধর্ষণ করে। এদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারা আমার বোনকে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেখে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে বোনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে দেয়া হয়।
এদিন চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজীদ থানার একটি মাদ্রাসায় হাবিবুর রহমান হাবিব নামে ১২ বছরের এক শিশুকে বলাৎকারের পর মাদ্রাসার মসজিদের জানালার গ্রিলে বেঁেধ ঝুলিয়ে মারা হয়। এ ঘটনার মাদ্রাসার ৫ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পরের দিন সোমবার ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানা হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের মহানগর গ্রামের রূপক কান্তি দের স্ত্রী মামুনি দে কে (২৪) ধর্ষণের পর গলা কেটে হত্যা করে একই গ্রামের সানি দে, চয়ন দে ও জয় দে। এ ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে বলে জানান ভুজপুর খানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মো. আবদুল্লাহ।

এদিকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক পোশাক কর্মীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের কথা ফাঁস করে দেয়ার কথা বলায় তার শরীরে জলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা এবং খারাপ মেয়ে অপবাদ দিয়ে মাথার চুল কেটে দেয়। সে চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদ মীর ফ্যাশন নামে এক প্রতিষ্ঠানের কর্মী।

এ ঘটনায় মঙ্গলবার অভিযান চালিয়ে তার কথিত প্রেমিক নিজাম উদ্দিন (৩০) সহ নির্যাতনকারী ৬ নারী-পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদিন কর্ণফুলী ও সাতকানিয়া উপজেলায় ঘটে আরো দুটি ধর্ষণের ঘটনা। এরমধ্যে ধর্ষিতা তার প্রেমিক জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে কর্ণফুলী থানায় মামলা দায়ের করে।

কর্ণফুলী থানার ওসি আলমগীর মাহমুদ জানান, জামাল উদ্দীন কর্ণফুলী উপজেলার ফজল সওদাগরের বাড়ির মৃত রহমত আলীর পুত্র। বুধবার ধর্ষিতার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

তরুণীর অভিযোগ, বিগত এক বছর আগে জামাল উদ্দীন তার সঙ্গে প্রেমের সমপর্ক গড়ে তুলে। এরপর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। নিরুপায় ওই তরুণী তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যান করে। একই দিনে সাতকানিয়ায় এক কিশোরীকে (১৫) অপহরণের পর ধর্ষণ করে। এ অভিযোগে মোহাম্মদ বাবুল প্রকাশ জাহাঙ্গীর (৩৫) নামে একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ সময় ওই বাড়ি থেকে অপহৃত কিশোরীকেও উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার বাবুল বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের বাদামতলী এলাকার মৃত আবদুর রহমানের ছেলে বলে জানান সাতকানিয়া থানার এসআই নজরুল ইসলাম। এছাড়া গতকাল পতেঙ্গা থানার কাঠগড় মাইজপাড়া রাজাপুকুর এলাকায় শাহীনা আক্তার নামে এক নারীকে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে। আগুন নেভানোর পর পুড়ে প্রায় ছাই হওয়া শাহীনা আক্তারের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পতেঙ্গা ফায়ার স্টেশনের অফিসার শামসুল আলম বলেন, তিন কক্ষবিশিষ্ট সেমিপাকা বসতঘরে দুই ভাই গফুর মিয়া ও আব্দুস সাত্তার পরিবার নিয়ে থাকেন। সেখানে আগুন লাগে। যা নেভাতে ১০ মিনিট সময় লেগেছে। বাসাটির একটি কক্ষ থেকে শাহীনার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। শাহীনার স্বামী মুছার অভিযোগ, শাহীনা বড় বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। বড় বোনের স্বামী গফুর চরিত্রহীন। শাহীনাকে ধর্ষণের পর পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনি মামলা করবেন বলে জানান।   

ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার দায়িত্বে থাকা পুলিশ উপপরির্দশক আবুল বাসার জানান, গত রোববার থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর আগের ১৩ দিনে ২৭টি, মার্চ মাসে ৯৪টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৭৩টি, জানুয়ারি মাসে ৭৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ২০১৮ সালে ৬৪৯টি, ২০১৭ সালে ৪৯৭টি ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status