মত-মতান্তর

ফুটা পাইপের গল্প না, হিরোদের গল্প বলি!

শায়ের খান

১০ এপ্রিল ২০১৯, বুধবার, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ন

মানুষের ৯০ শতাংশ পানি। আগুনের জাত শত্রু। পৌরাণিক কাহিনিও তা বলে। মুসলিম মিথ বলছে, শয়তান নিজে আগুনের তৈরি তাই মানুষকে সেজদা করেনি। ঘাড় ধাক্কা খেয়ে স্বর্গ থেকে বেরিয়ে গেছে, কিন্তু ছাড়েনি শয়তানি। মানুষকেও ছলে বলে বের করে নিয়ে এসেছে বেহেশত থেকে। সেই শত্রুতা। পানি আর আগুন। এখনো চলছে। চলবে কেয়ামত পর্যন্ত। কেয়ামত? হ্যাঁ। যদি আগুনের ধ্বংসযজ্ঞ বলি, এই সেদিন ঢাকা দেখেছিল চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। ভয়াবহ সে আগুনের হোলি। হঠাত করেই বিকট শব্দে দিগি¦দিক আক্রমণ করে বসে আগুন। মানেনি ধনী-গরিব, নারী- পুরুষ, আমলা-কামলা। আগুন তা চিনেওনা। গ্রাস করেছে যেদিক থেকে যা পেয়েছে, যাকে পেয়েছে। বসে থাকেনি মানুষও। মানুষ আগুনের চেয়ে বড়। পানির সাগর-মহাসাগর আছে, আগুনের সাগর-মহাসাগর নেই। প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দিয়েছে শক্তির পার্থক্যটা। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ফায়ার ফাইটার্স। সরু গলির জন্য ঢুকতে অসুবিধা হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির। কিন্তু হাল ছাড়েনি ফায়ার ফাইটার্স এ লড়াইয়ে। সারা রাত চলেছে মানবে-দানবে লড়াই। হেরেছে দানব। কিন্তু কেড়ে নিয়ে গেছে অনেক প্রাণ। যখন ভোর হয় হয়, তখন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অসীম বীর আগুন যোদ্ধারা আর প্রাণ কেড়ে নেয়া মৃতপ্রায় আগুন নামের দানব নিভু নিভু। ফজরের নামাজের পর যখন ইমাম সাহেব ডুকরে ডুকরে মোনাজাত ধরলেন, দুহাত তুলে সারারাতের বীর যোদ্ধারাও তখন মোনাজাতে। এক হাতে তখনও পাইপ ধরা যেখান থেকে পানির ধারা শেষ আঘাত করে চলেছে। এই বীরদের কথা কেউ তেমন বলেনি। ভাইরাল-ও হয়নি এদের সারারাতের যুদ্ধ কাহিনী।
বনানীর আগুন যুদ্ধটা একটু অন্যরকম। জানান না দিয়েই আক্রমণ করে বসলো। দিন-দুপুরে। এবার সমতল মাঠে না, আকাশ ছোঁয়া দালানে। ২২ তলা ভবনের ৯ তলায়। আর ঠিক সেই সময়েরই এক বীরের গল্প বলবো আমরা। নাম তার সোহেল রানা। এক অকুতোভয় ফায়ার ফাইটার।
একটু আগে এক উঁচু ভবন থেকে নিচে পড়ে যাওয়া এক মানুষের দুর্ঘটনা তাকে বিমর্ষ করেছে। ফিরে এসেছেন হেড কোয়ার্টারে মন খারাপ করে। দুপুরে খাননি। লাঞ্চের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, বেজে উঠলো ফায়ার এলার্ম। খারাপ খবর। বনানীতে। না খেয়েই আবার ছুটলেন বনানী যুদ্ধে। কামাল আতাতুর্কের এফ আর টাওয়ারের সামনে তখন আলগা মানুষের ভিড়। সোহেল রানার বহর আটকে আম-জনতার কিছুক্ষণ বাক বিত-া। তার ঝুলে নামতে গিয়ে ততক্ষণ একজন পড়ে গেছেন ৮ তলা থেকে। মানুষজন তোয়াক্কা করলেন না সোহেল রানা। চিৎকার করে উপরের সবাইকে বলছেন নামার চেষ্টা না করতে। সান্ত¡Íনা দিয়ে বলছেন, আমরা আসছি, আপনাদের নামিয়ে নিয়ে আসবো ! বীর সোহেল রানা তখনও না খাওয়া। এক ফাইট সেরে আরেক ফাইটে তখন তিনি।
এই ক্রেনটা ২০ তলা পর্যন্ত উঠতে পারবে। দুশ্চিন্তা সোহেলের ২২ তলা নিয়ে। ৯ তলায় গনগণে আগুন। আগুন যখন নিজেই আটকা পড়ে তাপমাত্রা বেড়ে যায় ওর। এখানেও তাই হচ্ছে। প্রায় ২০০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় আগুনের কাছে ঘেঁষতে অসুবিধা হচ্ছে সোহেল রানার। এদিকে বাঁচার জন্য বহুতল এই দালান থেকে নারী-পুরুষের আকুতি ভেসে আসছে। অন্তঃসত্ত্বা এক নারী কেঁদে ফেলে বললো, আমি মরে গেলে অসুবিধা নাই, আমার পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচান। অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করলো সোহেল রানার মনে। তারও এক শিশু সন্তান আছে। মানুষকে দ্রুত বাঁচাতে হবে। এই ক্রেন ৩০০ কেজি ভার বহন করে। মানে গড়ে ৪-৫ জন। সোহেল ঝুঁকি নিলেন। একসঙ্গে ৭-৮ জন করে নামালেন। একই সঙ্গে চলতে লাগলো আগুন নেভানোর যুদ্ধ। সেই অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ মোট ৪০ জনকে আগুনের থাবা থেকে বাঁচালেন। প্রচ- হিট ও ধোঁয়া সোহেল রানার শ্বাসনালী চেপে ধরলো। নিজেই আটকে গেলেন নিজ যন্ত্রে। ফ্র্যাকচার হলো তার কয়েকটি হাড়। ভর্তি হলেন সিএমএইচে। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হলো তাকে। অন্তঃসত্ত্বা সেই নারীর নাম সেঁজুতি। সোহেল রানাকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার জন্য সারাজীবন দোয়া করবেন বলেছেন সেঁজুতি। আর উত্তেজনার ভিড়ে সবাই ভুলে গেছে কড়াইল বস্তি থেকে আসা এক নায়ক জসিমের কথা। জসিম স্পাইডার ম্যানের মতো ৮ তলা বেয়ে উপরে উঠেছিল। দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় এক তরুণীকে কাঁধ পেতে পাশের বিল্ডিঙে পার করে দিয়েছিল।
এসব ভাইরাল হয়নি। ভাইরাল হয়েছে এক শিশু। মাটিতে পানির ফুটোর উপর বসে সে পলিথিন দিয়ে পানি আটকাচ্ছিল। বীর হয়ে গেছে সে। এক প্রবাসী তাকে ৫ হাজার ডলার দেয়ার ঘোষণাও দিলেন। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ওকে বললো- সুপারম্যান। তাকে নিয়ে টক শো হলো, আলোচনা-সমালোচনাও হলো। বিতর্কের জন্ম হলো।
খারাপ সংবাদ আপাতত: দুটো। সেই স্পাইডারম্যান জসিমের সঙ্গে সাংবাদিকরা কথা বলতে গেলে সে হাত জোড় করে বলেছে-‘ভাইজান, ট্যাকা পয়সা লাগবো না, আমারে পচাইয়েন না ! ' আর মর্মন্তুদ সংবাদ হচ্ছে সিঙ্গাপুরে আমাদের বীর ফায়ার ফাইটার সোহেল রানা মারা গেছেন। আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসীব করুন।
আমরা কি খবর রেখেছি চুড়িহাট্টার সেই রাতভর যুদ্ধ করা আগুন যোদ্ধাদের? ভাইরাল করেছি কি তাদের সেই সারারাত যুদ্ধের কিছু বীরগাথা অভিজ্ঞতা? শহীদ সোহেল রানার সারাদিন না খেয়ে আগুন যুদ্ধের কিছু ভাইরাল হয়েছিলো কি? এসব ছাপিয়ে পাইপের ফুটো বন্ধ করা যোদ্ধাকে ভাইরাল করে বিশ্বকে আমরা কি মেসেজ দিলাম? মেসেজ দিলাম, এদেশের ফায়ার সার্ভিসের পাইপ ফুটো !
স্পাইডারম্যান বীর জসিমের ভাষায় বলতে হয়- দেশকে প্রেম করেন, এমন কিছু ভাইরাল করেন যাতে বিশ্বের সামনে দেশের ভাবমূর্তি উঁচু হয়, কিন্তু পচাইয়েন না ।
দেশপ্রেম অমূল্য। ৩০ লাখ জীবন, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আর বীর মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু দেশ স্বাধীন করেছিলেন মোবাইলের টাচ স্ক্রিন ঘষে ঘষে না।
শায়ের খান : লেখক, নাট্যকার, ফিল্ম মেকার
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status