প্রথম পাতা

সড়ক নিরাপত্তা সেই একই চিত্র

মারুফ কিবরিয়া

৬ এপ্রিল ২০১৯, শনিবার, ৯:২৯ পূর্বাহ্ন

ফাইল ছবি

বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা। রাজধানীর উত্তর বাড্ডা বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুদূর এসেই নতুন বাজারগামী অগ্রদূত নামের একটি বাস থেকে সব যাত্রী নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাস আর যাবে না। যাত্রীদের নামানোর পরপর বাসটি ঘুরিয়ে নেয়া হলো। যাত্রীরা জানতে চাইলেন চালক ও তার সহকারী কোনো উত্তর না দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছেন। পেছন থেকে আরেক বাসের এক সহকারী এসে বললেন ‘তাড়াতাড়ি ঘুরা। সামনে সার্জেন্ট সব বাস ধরতেছে’। এভাবে একই স্থানে কমপক্ষে সাতটি বাস ঘুরিয়ে নেয়া হয়। এর মধ্যে ছিল, অগ্রদূত  নূর-এ মক্কা, ৬নং বাস। আর এসব বাসে থাকা যাত্রীরাও পড়েন চরম দুর্ভোগে। ঘুরিয়ে নেয়ার কারণ ছিল এদের কারো বাসের লাইসেন্স ছিল না। কোনটিতে চালকের লাইসেন্স কিংবা বাসের ফিটনেস ছিল না।

এ চিত্র সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে ঢাকা সিটি উত্তর করপোরেশনের মেয়র ও অন্যান্যদের সঙ্গে নিরাপদ সড়ক চাই’র আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বৈঠকের আধা ঘন্টা আগের। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেয়র আতিকুল ইসলাম ও প্রশাসনের টানা দুই দফা বৈঠক হলেও  দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এখনো রাজধানীজুড়ে দেখা মেলেনি। উত্তর বাড্ডার ওই চিত্র ছাড়াও শহরের বিভিন্ন স্থানে সড়কে অনিয়ম চলছেই।

যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা, ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়াসহ নানা অনিয়মের মধ্যেই রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা চলে যাচ্ছে।  সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ ও ডিএমপি নানা পদক্ষেপ নিলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়নি।

গত বছর জুলাই মাসে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি পূরণের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ও ডিএমপির উদ্যোগে একাধিক কমিটি গঠন ও পদক্ষেপ নেয়া হলেও শুধুমাত্র সড়কে ট্রাফিক সার্জেন্টের মামলা কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ গত ১৯শে মার্চ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশ ফটকের সামনে আরও একটি দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে সুপ্রভাত বাসের ধাক্কায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হন। এ ঘটনায় ফের শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেন।

এবারো আট দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন তারা। এসব দাবির মুখে আন্দোলন থামাতে শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেন মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। মৌখিক আশ্বাসে আস্থা না পেয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলতে থাকে সে সময়। এর মাঝে শিক্ষার্থীদের  একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর সাতদিনের আল্টিমেটামের ভিত্তিতে আন্দোলন স্থগিত হয়। পরে গত ২৮শে মার্চ সাত দিনের সড়কের শৃঙ্খলার অগ্রগতি নিয়ে আবারো বৈঠকে বসেন মেয়র, বিআরটিএর চেয়ারম্যানসহ সড়ক পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা। ওইদিন সভা চলাকালীন অবস্থায় বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের খবরে বৈঠক শেষ হয়ে যায় কোন সমাধান ছাড়াই। ৪ঠা এপ্রিল ফের বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া নিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ অন্যান্যরা বৈঠকে বসেন। এসময় শিক্ষার্থীরা সড়কে যানবাহনের ফিটনেস টেস্টে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নে বিআরটিএকে নিয়মনীতি মেনে চলা, ঢাকা মহানগরের পরিবহন ব্যবস্থাকে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মধ্যে নিয়ে আসা, চালকদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা, শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া, নগরে ওভারব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন নিয়ে আলোচনা করেন ।

টানা দুই দফা আলোচনার পরও ঢাকার কোনো সড়কে শৃঙ্খলা দেখা যায়নি। গত কয়েকদিনে সরজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর সড়কগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা থাকলেও বাস চালকরা তাদের পুরনো নিয়মেই চলছেন। শুধু অভিযানের খবর শুনলেই যখন তখন বাস থেকে যাত্রী নামিয়ে ঘুরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে যাত্রীরা পড়ছেন চরম ভোগান্তিতে। মিরপুর থেকে গুলিস্তান-সদরঘাট রুটের বাসগুলো বেশিরভাগই সড়কে যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করছে। বুধবার মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্ত্বরে দেখা যায় নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ থাকার পরও কোনো বাস সেখানে থামছে না। যাত্রী যেখানেই পাচ্ছে সেখানেই বাসগুলো দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠাচ্ছে। আবার কার আগে কে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠাবে সেই প্রতিযোগিতাও দেখা যায়। ইউনাইটেড সার্ভিস বাসে বসে কয়েকজন যাত্রী এসব নিয়ে প্রতিবাদ করলেও চালকের সহকারী তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। অন্যদিকে বুধবারই সন্ধ্যার দিকে মালিবাগ রেলগেটে দেখা যায় খিলগাঁও থেকে আসা কয়েকটি বাস একটির সঙ্গে আরেকটি প্রতিযোগিতা করছে। একপর্যায়ে তুরাগ বাসের সঙ্গে রাইদা কোম্পানির একটি বাসের সংঘর্ষও হয়।

সড়কে এসব অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে সময় শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সময় চেয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ওই সভায় তিনি বলেন, তোমাদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করছি না। তবে এসব দাবি পূরণ সময়ের ব্যাপার। আমাদের আরো সময় দিতে হবে। আমরা সব দাবি দাওয়াই ধীরে ধীরে পূরণ করব। আমাদের দেখতে হবে কোথায় দ্রুত কাজ করতে হবে। আর কিছু ক্ষেত্রে তো লংটার্ম চিকিৎসা দিতে হবে। পারসেপশন বুঝতে হবে আমাদের। শিক্ষার্থীদের মতো সাধারণ জনগণকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে আতিকুল বলেন, আমাদের অনেক জঞ্জাল সরাতে হবে। নিরাপদ সড়ক পেতে গেলে- লেটস মুভ টুগেদার। সভায় মালিবাগ রেলগেইট থেকে প্রগতি সরণির কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত সড়ককে ‘মডেল রোড’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন মেয়র। তিনি বলেন, বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট এই সড়ক নিরাপদ করতে তাদের পরামর্শ দেবে। তারপর এই সড়কে কোথায় কোন স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে, তা ঠিক করা হবে।

ঢাকার সড়কে যত্রতত্র বাস থামালে দণ্ডের বিধান করা হচ্ছে জানিয়ে মেয়র বলেন, যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। বাসগুলো যদি এই যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে না দাঁড়ায় তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিআরটিএ’র উদ্দেশে আতিকুল ইসলাম বলেন, জবাবদিহি নিশ্চিৎ করতে হবে। পুরো সিস্টেমটাকে ইমিডিয়েটলি একটা অটোমেশনের মধ্যে আনতে হবে। হালকা যানবাহনের লাইসেন্স নিয়ে কেউ যেন ভারী যানবাহন চালানোর অনুমতি না পায়। সেই সাথে ভারী যানবাহনের লাইসেন্স পেতে যে জটিলতা আছে, তাও নিরসন করতে হবে। সভায় বাস মালিক সমিতির প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। মালিকপক্ষকে চুক্তিভিত্তিক চালক নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার অনুরোধ জানান ঢাকা উত্তরের মেয়র।

শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষিতে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. মশিউর রহমান বলেন, আমরা বিআরটিএকে দালালমুক্ত করতে এরইমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা ১৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেছি। তারা সার্বক্ষণিকভাবে বিআরটিএতে কাজ করছেন এবং অনেক দালালকে শাস্তি দিয়েছেন। ওই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হাই প্রধান, প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল যুবায়ের সালেহীন, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক বিভাগ) মীর রেজাউল আলম, বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী প্রমুখ।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status