প্রথম পাতা

চুড়িহাট্টায় এখনো আতঙ্ক

শাহনেওয়াজ বাবলু

৩১ মার্চ ২০১৯, রবিবার, ৯:৫২ পূর্বাহ্ন

আগুন। পুরান ঢাকার মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম। ঘুমের মধ্যেও আঁতকে ওঠেন কেউ কেউ। এই বুঝি আগুন লাগলো। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পোড়া লাশ। কানে আসে কান্নার আওয়াজ! এভাবেই আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটে চকবাজার চুড়িহাট্টার বাসিন্দাদের। গত ২০শে ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কেটে গেছে এক মাসেরও বেশি সময়। তারপরও আগুনের বিভীষিকাময় দুঃসহ স্মৃতি তাদের পিছু ছাড়ছে না। অগ্নিকাণ্ডের পর অনেকেই আবার ওই এলাকায় ফিরলেও আগুনের ভয়ে আঁৎকে রয়েছেন তারা। গতকাল সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ওয়াহেদ ম্যানশনটি আগের মতোই পড়ে আছে। ভবনটির ভেতর পুরো অন্ধকার। উল্টো দিকের ভবনের পুড়ে যাওয়া দোকানের একটিতে অস্থায়ী ফলের দোকান দেখা গেছে। এছাড়া মসজিদের পূর্ব পাশের মার্কেটের নিচতলার মুদি দোকনটি চালু করা হয়েছে। এই ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়ার পর আর কোনো কিছুই পাননি তারা।

তবে নোয়াখালীর নাটেশ্বর ইউনিয়নের মারা যাওয়া ১৬ জনকে ওই ইউনিয়ন সমিতির পক্ষ থেকে এক লাখ এবং আহতের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে।  আগামী শুক্রবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধন করার কথা রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের। ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে উদাস মনে দাঁড়িয়েছিলেন আয়মান এন্টারপ্রাইজের দোকানি এমএ রহিম। ওইদিনের ঘটনায় তার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কথা হয় এম এ রহিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, কি বলবো আর, আমাদেরতো সবই শেষ। প্রতিদিনই এখানে আসি। আল্লাহ্‌ এর সঙ্গে যদি আমারেও উঠাইয়া নিয়া যাইত। এই দোকনটাই ছিল আমার একমাত্র অবলম্বন। পরিবারকে নিয়া পথে নামার অবস্থা। এদিকে চুড়িহাট্টায় পাশের ভবনের সিসিটিভিতে ধারণকৃত আগুনের ফুটেজ সাংবাদিকদের দেয়ায় মোহাম্মদ আজমকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক মো. হাসান। এ ঘটনায় গত সোমবার চকবাজার থানায় একটি জিডি করেছেন আজম। জানা যায়, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক তার মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে হোটেল মালিককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকি দেন।

ওয়াহেদ ম্যানশনের দোকানিরা জানান, মালিকের পক্ষ থেকে তাদের দোকানের কাজ শুরু করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তারা জানিয়ে দিয়েছেন যেহেতু এই ভবন এবং মালিকের নামে মামলা রয়েছে তাই তারা এটার নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো কিছুই করতে রাজি নন।  

চুড়িহাট্টা মোড় থেকে পূর্বদিকে কয়েক গজ গেলে বামদিকের গলির শেষ মাথার বাড়ির মালিক মো. মঈন উদ্দিন। তার সামনের ভবনে আগুন লাগায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তার বাড়ির অর্ধেক ভাড়াটিয়া ফিরে এলেও অন্যরা আতঙ্কে ফিরছেন না বলে জানান তিনি। মঈন উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, তাদের অভয় দিচ্ছি যে, কিছু আর হবে না, কিন্তু তারা ভরসা পাচ্ছে না। নন্দ কুমার দত্ত লেনের পাশে হায়দার বখ্‌শ লেনের একটি বাড়ির বাসিন্দা ৫২ বছর বয়সী মো. আনোয়ার হোসেনের চোখে এখনো আটকে আছে ভয়াল সেই রাতের বিভীষিকায়। চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশেই তার বাসা। আগুন লাগার পর ভবনের আর সব বাসিন্দার সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে তিনিও স্বপরিবারে ছুটেছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। দৌড়াতে গিয়ে আহত হন তার স্ত্রী মুনিরা বেগম। সেই রাতের কথা মনে করে শিউরে ওঠেন আনোয়ার। তিনি বলেন, আমরা এখনো ঘুমাতে পারি না। ঘুমের মধ্যেও কান্নার আওয়াজ পাই।

উচ্ছেদ অভিযান চলছে ঢিমেতালে: চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি রাসায়নিক গুদাম ও কারখানার তালিকা ১৫ দিনের মধ্যে জমা দেয়া হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে। একই আশ্বাস এসেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) থেকেও। এরপর গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরাতে সংশ্লিষ্ট সবক’টি সরকারি দপ্তরের প্রতিনিধি নিয়ে অভিযানও শুরু করে বিশেষ একটি টাস্কফোর্স।

প্রথমদিকে খুব জোরেশোরে অভিযান চালালেও আস্তে আস্তে তা ঝিমিয়ে যাচ্ছে। অভিযান চলছে ঢিমেতালে। যদিও টাস্কফোর্সের কেমিক্যাল উচ্ছেদ অভিযান চলার কথা রয়েছে ১লা এপ্রিল পর্যন্ত। অভিযানে এখন পর্যন্ত ৩৭টি রাসায়নিক গুদামের মালিককে কারখানা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছে টাস্কফোর্স। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিনে অভিযান রাখা হয় বন্ধ। এ ছাড়া অভিযানে গেলেও দু’-তিন ঘণ্টা থেকে সাত-আটটি বাড়ি পরিদর্শন শেষে নিজ কার্যালয়ে ফিরে যান কর্মকর্তারা। পাঁচটি টিমের সমন্বয়ে অভিযান চালানোর কথা থাকলেও কোনো কোনোদিন একটি আবার দু’টি টিম অভিযান চালাচ্ছে। যদিও অভিযান চালকরা বলেছেন, অভিযানের সময় ঠিকমতো রাসায়নিক পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে রাসায়নিক সরিয়ে নিয়েছেন। তবে রাসায়নিক সরিয়ে তারা কোথায় রাখছে তা জানার চেষ্টা করছে না টাস্কফোর্স।

সরেজমিন দেখা গেছে, পুরান ঢাকার বিভিন্ন কারখানা থেকে এখনো মালামাল সরানো হয়নি। কয়েকজন ব্যবসায়ী মানবজমিনকে জানান, তারা এখনো কেমিক্যাল কারখানা স্থানান্তরের বিপক্ষে। রাসায়নিক বা কেমিক্যাল কারখানার পরিবর্তে প্লাস্টিক কারখানাগুলোতে শুরুতেই অভিযান চালানো হচ্ছিল বেশি। এ কারণে অভিযানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে পড়ে টাস্কফোর্স। এরপর কয়েক দফা বৈঠকের পর ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে গত ১০ই মার্চ প্লাস্টিককে অভিযানের আওতামুক্ত ঘোষণা করেন ডিএসসিসি’র মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। এরপর থেকে রাসায়নিকের পাশাপাশি পলিথিন কারখানা ও গুদামে অভিযান চলছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরান ঢাকায় এখনো অনেক রাসায়নিক গুদাম রয়েছে। চলমান বিশেষ অভিযানকে বাধা দিয়ে এলাকাতেই কারখানা রাখার চেষ্টা চলছে। তবে ডিএসসিসি’র প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর জাহিদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, অভিযান নিয়মিত চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরাতে পারব বলে তারা আশাবাদী।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status