প্রথম পাতা

অনেক বাস হাওয়া, দুর্ভোগে রাজধানীবাসী

মারুফ কিবরিয়া ও সুদীপ অধিকারী

২৭ মার্চ ২০১৯, বুধবার, ৯:৪০ পূর্বাহ্ন

সকাল ১০টা। ধানমণ্ডি সিটি কলেজ মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আরিফ আহমেদ। চাকরির সুবাদে তাকে প্রতিদিনই যেতে হয় নিকুঞ্জ। সব সময় অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি পেলেও গত এক সপ্তাহ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শুধু আরিফ আহমেদই নন সিটি কলেজ মোড়ে তার মতো সোমবার সকালে দাঁড়িয়ে ছিলেন শতাধিক অফিস ও স্কুল-কলেজগামী যাত্রী। একই দিন সকাল ৯টা। নতুন বাজার মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকজন যাত্রী। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেও উঠতে পারছিলেন না কোনো বাসে। মাঝে মাঝে দুই একটা বাস এলেও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না তাতে।

আবার অধিকাংশ বাস আসছে গেটলক করে। একই অবস্থা রাজধানীর সব এলাকাতে। প্রতিটি স্থানে দীর্ঘ সময় যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো বাসে চড়তে পারছেন না। প্রগতি সরণিতে সুপ্রভাত বাসের চাপায় বিইউপি শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর প্রতিবাদে আন্দোলনের পর থেকে রাজধানীতে লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও চালকের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার হওয়ার এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাস কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জটিলতা এড়াতে অনেক কোম্পানির অর্ধেক বাসই সড়কে নামছে না। এতে পরিবহন সংকট তৈরি হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, অভিযান শেষ হলেই এসব বাস আবার সড়কে নামে। এটি বরাবরই হয়ে আসছে। এসব বাস কিভাবে সড়কে চলে এটিই বড় প্রশ্ন। সোমবার নতুনবাজারে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা তুহিন আহমেদ নামের এক যাত্রী মানবজমিনকে বলেন, আমার অফিস মুগদাতে। এখান থেকে তুরাগেই যাওয়া আসা করি। তিন চারদিন ধরে খুব ঝামেলায় আছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাস পাচ্ছি না। অন্য সময় তুরাগ পরিবহন প্রতি মিনিটে একটা করে আসে। অথচ কয়েকদিন ধরে বিশ পঁচিশ মিনিট পর পর একেকটা বাসের দেখা মিলছে। তাও পুরোপুরি যাত্রী ভরে আসছে। এখান থেকে এসব বাসে ওঠার কোনো অবস্থা থাকছে না। গতকাল মোটরসাইকেল ভাড়া করে অফিসে গিয়েছি। কিন্তু প্রতিদিন তো মোটরসাইকেলে গিয়ে পোষাবে না।

এদিন একই অবস্থায় বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায় মধ্য বাড্ডা থেকে আগারগাঁওগামী বেশ কয়েকজন যাত্রীকে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও তারা কোনো বাসের দেখা পাননি। যাত্রীদের মধ্যে শরীফ উদ্দিন নামের একজন মানবজমিনকে বলেন, প্রতিদিন শ্যামলী যাওয়া আসা করি অগ্রদূত বাসে। সব দিন এখান থেকে বাস খালিই পাই। কিন্তু গত দুই দিন ধরে বাস নেই বললেই চলে। অনেকক্ষণ পর পর একটা বাস আসে। রাস্তায় যানজটও তেমন নেই। তাহলে সমস্যা কোথায়? রোববার বিকালে অফিস থেকে ফেরার পথে অগ্রদূতের বাসটি মহাখালী পার হওয়ার সঙ্গে পুলিশ আটকে দেয়। কাগজপত্রের ঝামেলা থাকায় বাসটি ছাড়েনি। দেরি দেখে অন্য বাসে বাসায় চলে আসি। রামপুরা থেকে কাকরাইলগামী যাত্রী আশিক বলেন, এই সড়কে কাকরাইল যাওয়ার সহজ ব্যবস্থা ছিল সুপ্রভাত বাস। কিন্তু বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটে দুর্ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিহতের পর ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সুপ্রভাত পরিবহনের রুট পারমিট বাতিল হওয়ায় তাদের কোন গাড়ি নেই।

এখন ভরসা শুধু তরঙ্গ প্লাস নামের আরেকটি বাস। সেটার সংখ্যা খুব কম হওয়ায় আমাদের মতো নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রীরা পড়েছি ব্যাপক ভোগান্তিতে। কারণ রিকশা বা মোটরসাইকেল যোগে কাকরাইল যেতে অনেক টাকা ভাড়া লাগে। বাসের সংকট দেখা যায় মিরপুর এলাকাতেও। মিরপুর ১২ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলাচলকারী কয়েকটি কোম্পানির বাস একটির পর একটি বিভিন্ন স্টপেজে যাত্রী ওঠানামা করলেও গত কয়েকদিন ধরে সেই সংখ্যা অনেকটাই কমেছে। ফলে মিরপুর থেকে শহরের অন্যান্য এলাকায় চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীরা পড়েছেন নানা ভোগান্তিতে। মিরপুর ১০ নম্বর ফুটওভার ব্রিজের নিচে অপেক্ষমাণ যাত্রী ফারুক বলেন, সকাল থেকে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে ইউনাইটেড বাসের দেখা পাইনি। একটা বাসও ফাঁকা নাই। সদরঘাট একটা জরুরি কাজ ছিল। যেতে পারছি না। প্রতিদিন এখানে কিছুক্ষণ পর পর বাস ভিড় করতো। এখন আধা ঘণ্টা পর একেকটা বাসের দেখা মিলছে।

সেটাও আগে থেকেই ভরে আসছে। সোমবার সারাদিনই ফার্মগেট এলাকায় শত শত মানুষকে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। তাসলিমা বেগম নামের এক নারী মানবজমিনকে জানান, বাচ্চাটাকে নিয়ে শ্যামলীর শিশু হাসপাতালে যাব। প্রায় ঘণ্টাখানেক ফার্মগেট বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কোনো বাসে উঠতে পারছি না। মাঝে মাঝে দুই একটা বাস এলেও অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে থাকায় তাদের ভিড়ে উঠতে পারছি না। জাকিরুল ইসলাম নামের অপর এক যাত্রী বলেন, শুধু আজকে নয় ছাত্র আন্দোলনের পর থেকে একই অবস্থা। রাজধানীর সব এলাকাতেই গণপরিবহনের সংখ্যা কমে গেছে। তিনি বলেন, বাস চাপা দিয়ে মানুষ মারবে, আর তাদের কিছু বলা যাবে না। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাবে, তাদের মামলা দেয়া যাবে না। অবৈধ বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই মালিক পক্ষ এই কৃত্রিম বাস সংকট সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়। আমরা যেন তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছি। কষ্ট হলেও এই বাস চলকদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনা প্রয়োজন।

শুধু মিরপুর, বাড্ডা, নতুন বাজার ও ফার্মগেট নয় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, পল্টন, মহাখালি, বনানী, এয়ারপোর্ট, নীলক্ষেত, মানিক মিয়া এভিনিউ, আসাদগেট, কলেজগেট, শাহবাগ, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সাধারণ যাত্রী পরিবহনকারী বাস সংকটের একই চিত্র দেখা গেছে কয়েকদিন ধরে। আজিমপুর টু উত্তরা-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী ভিআইপি-২৭ নম্বর বাসের চালক মিরাজ বলেন, গাড়ির কাগজ একটু সমস্যা থাকলেই পুলিশ ধরে মামলা দেয়। হয়রানি করে। সারাদিন যা আয় হয় তার সবই মামলা ভাঙ্গাতে দিয়ে দিতে হয়। তাই এত ঝামেলার হাত থেকে বাঁচতে যেই গাড়ি ও ড্রাইভারের সব কাগজ ঠিক আছে তারা ছাড়া আর কেউ রাস্তায় গাড়ি নামাচ্ছে না। অনেকের গাড়িই গ্যারেজে পড়ে রয়েছে। ফলে গাড়ির সংখ্যা কমে গেছে।

সরজমিনে দেখা যায় আজিমপুর থেকে ছেড়ে আসা বিকাশ, উইনার, স্মার্ট উইনার, বাহন, সেফটি, ২৭, মিরপুর লিংকসহ প্রায় সব পরিবহনের গাড়ির সংখ্যাই অন্য দিনের তুলনায় অনেক কম চলছে। দেওয়ান পরিবহনের নাসির নামের এক চালক বলেন, বাস তো মালিকরা কমাইয়া দিসে। এখন ৩০-৪০টা বাস চলে। কী কারণে কমছে সেটা জানি না। তবে রাস্তায় নামলেই তো মামলার পর মামলা দেয় পুলিশ। মামলা দিতে কোনো কারণ লাগে না। অন্যদিকে তুরাগ কোম্পানির বাস চালকের এক সহকারী শহীদ জানান, মালিকরা না নামাইলে আমাগো কি করার আছে। নামালেই তো মামলা খায়। অনেক ড্রাইভারের লাইসেন্স নাই। অনেক গাড়ির লাইসেন্স থাকে না। আর সু-প্রভাতের চাপায় এক ছাত্র মারা যাওয়ার পর এখন পুলিশ বেশি বেশি মামলা দিচ্ছে। দুই একটা ছোটখাটো ভুল থাকলেও ছাড়ে না।

উল্লেখ্য, গত বছরের জুলাই মাসে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পরও ব্যাপক শিক্ষার্থী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কয়েকদফা পুলিশ সপ্তাহও পালন করেছে ডিএমপি। সে সময় কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি ও চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় সড়কে বাস চলাচল কমে যায়। তখনও যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। পরে কড়াকড়ি কমে গেলে সেই যানবাহন আবার সড়কে নামে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status